ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪

সমৃদ্ধ বাংলাদেশ : বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনার ধারাক্রম

ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন

প্রকাশিত : ২০:২৭, ২০ আগস্ট ২০২১ | আপডেট: ১০:০০, ২১ আগস্ট ২০২১

করোনায় বিপর্যস্ত উন্নত থেকে উন্নয়নশীল বেশিরভাগ দেশই। করোনাকালীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীসহ বিভিন পেশার মানুষের জন্য দরকার মাস্ক, সার্জিক্যাল গাউন, নন সার্জিক্যাল গাউন, কভারল, হেড কভার ও স্যু কভার ইত্যাদি। সমন্বিত এসব উপকরণকে বলা হচ্ছে পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইক্যুইপমেন্ট (পিপিই)। ২০২০ সালের মার্চের শেষ সপ্তাহে আমেরিকান রাষ্ট্রদূত রবার্ট মিলার আমাদের সাথে সাক্ষাত করে একটি চিঠি দেন। তাতে এসব বিষয়সহ তিনি ২২ টি স্বাস্থ্য উপকরণের চাহিদা উল্লেখ করেন। আমি বিষয়টি গণমাধ্যমে বলি। তখন আমার বক্তব্য নিয়ে অনেকেই সমালোচনা শুরু করেন। তাদের কথিত যুক্তি ছিল, ‘আমেরিকা’র মতো দেশ কেন বাংলাদেশ থেকে স্বাস্থ্য উপকরণ চাইবে! 

যাই হোক, বাংলাদেশ কেবল উন্নত দেশের পথে এগোচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আমেরিকার মতো উন্নত দেশের এই ধরণের চিঠি খানিকটা অবাকই করে দেয়। তবে এ চিঠির পর আমাদের সক্ষমতার বিষয়টিও নতুন করে অনুধাবনে আসে। আমাদের মনে একটু সংশয় ছিল, এত অল্প সময়ে আমরা পিপিইসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য সামগ্রী বানাতে পারবো কি না। যদিও পোশাক রপ্তানিতে আমরা বিশে^ বরাবরই শীর্ষ কাতারেই থাকি। যদিও ‘পিপিই’ সাধারণ কোনো পোশাক বা ফ্যাশন আইটেম নয়। টেইলরিংয়ের সাধারণ নিয়মকানুন পিপিই’র জন্য প্রযোজ্য হবে কি না- আমাদের সংশয়। কারণ, এগুলো তৈরির জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যার একটি নির্দিষ্ট গাইডলাইন রয়েছে, যা মেনে চলতে হয়। এফডিএ, সিই এবং বাংলাদেশে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদনও দরকার হয়। আবার যথাযথ যন্ত্রপাতি ও দক্ষ কর্মীর বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা তৎক্ষণাৎ ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের সাথে আলাপ করি। তাদের কাছ থেকে আমরা আশ^স্ত হই, বাংলাদেশ সঠিক মানের মাস্ক, সার্জিক্যাল গাউন, নন সার্জিক্যাল গাউন, কভারল, হেড কভার, স্যু কভারসহ মানসম্মত পিপিই তৈরি করতে পারবে। এরপর মে মাসের শেষ সপ্তাহে স্বল্পতম সময়ে আমেরিকায় প্রথমবারের মতো ৬৫ লাখ পিপিই রপ্তানি করলো বাংলাদেশ। এখন সব মিলিয়ে প্রায় এক কোটিরও বেশি পিপিই আমেরিকাসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে রপ্তানি করা হয়েছে। মাত্র দু’মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে আমাদের তৈরি পোশাক ব্যবসায়ীরা তাদের দক্ষ জনবল ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী পিপিই তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। করোনার মতো দুর্যোগেও মানসম্মত স্বাস্থ্য উপকরণ তৈরি, সার্বিক বিবেচনায় করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশের সফলতা আজ বিশ^ব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছে। 

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী বা পিপিই রপ্তানির খবরে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও। পাশাপাশি, দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের ক্রমবর্ধমান উন্নতিতে দেশটির অত্যন্ত প্রভাবশালী সংস্থা জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ব্যুরোও প্রশংসা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পিপিই রপ্তানি সম্পর্কে পম্পেও বলেন, এটি একটি তাৎপর্যপূর্ণ মাইলফলক। এ ধরণের আন্তর্জাতিক অংশিদারিত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত এক টুইট বার্তায় বলেন, বাংলাদেশকে বিশ^মানের বৃহৎ আকারের পিপিই উৎপাদনকারী দেশগুলোর কাতারে স্বাগত জানাতে পেরে আনন্দিত। রি-টুইট করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পম্পেও লিখেন, ‘‘আমি এই তাৎপর্যপূর্ণ মাইলফলকের জন্য রাষ্ট্রদূত মিলারের সঙ্গে একমত হয়ে বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানাতে চাই। বিশ^জুড়ে করোনা মোকাবিলায় সম্মুখ সারিতে থাকা সাহায্যকর্মীদের এখন পিপিই প্রয়োজন। এসব পিপিই যোগানে কোম্পানিগুলো এখন নজর দিচ্ছে। ফলে এ ধরণের আন্তর্জাতিক অংশিদারিত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’’

প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে চাই, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ১৫ তারিখে তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সাথে এক বৈঠকে মিলিত হই। উষ্ণ ও আন্তরিক পরিবেশে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে বাণিজ্যিক পণ্য আদান-প্রদানের বিষয়ে নতুন উদ্যোগ গ্রহণ, দ্বি-পাক্ষিক পর্যায়ে আরও বেশি প্রতিনিধিদল প্রেরণ, মেলা ও প্রদর্শনীতে দুই দেশের ব্যবসায়ীদের বেশি বেশি অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্ব উঠে আসে। নির্যাতিত ও দুর্গত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে আশ্রয় প্রদানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূয়সী প্রশংসা করেন তুরস্কের রাষ্ট্রপতি। এ বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক ও আন্তর্জাতিক  ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সকল বিষয়ে তিনি বাংলাদেশের পাশে থাকবেন বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সামরিক খাতে চলমান সহযোগিতা আরও শক্তিশালী করার বিষয়েও প্রাসঙ্গিক আলোচনা উঠে আসে এই বৈঠকে। এ সময় বিদ্যমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে তুরস্ক থেকে আরও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রেরণে আশ^াস প্রদান করেন রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। ২০২১ সালের প্রথম দিকে ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলনে তুরস্কের রাষ্ট্রপতি ও বর্তমান চেয়ার এরদোয়ান যোগদানের বিষয়ে সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন। তিনি নতুন সদস্য রাষ্ট্র যুক্ত করে ডি-৮ সম্প্রসারণের ব্যাপারেও জোর দেন। দু’দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব দেন। যার মধ্যে রয়েছে বিদ্যমান শুল্কবাধা এড়িয়ে নতুন পণ্য, বস্ত্র, ওষুধ ও অন্যান্য খাতের বিনিয়োগ।

এছাড়া উভয় দেশে বাণিজ্য মেলায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। বাংলাদেশে তুরস্কের আর্থিক সহযোগিতায় একটি আধুনিক হাসপাতাল নির্মাণের প্রয়োজনীয় জমি বরাদ্দের জন্য তুরস্কের রাষ্ট্রপতি প্রস্তাব দেন। ওই বৈঠকে বিস্ময় নিয়ে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় গণমাধ্যমের খবরে দেখলাম, বাংলাদেশে কয়েক মিলিয়নের মতো মানুষ মারা যেতে পারে, আক্রান্ত হতে পারে অন্তত কোটিরও বেশি। আর করোনার প্রভাবে ধ্বসে যাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি! কিন্তু এত কম লোক মারা গেলো, আক্রান্তও কম। আবার অর্থনীতিও তুলনামূলক সন্তোষজনক গতিতেই এগোচ্ছে। এটা কিভাবে সম্ভব?’’ আমি হেসে করোনা মোকাবেলায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বহুমুখী পদক্ষেপ তুলে ধরলাম। শুনে তিনি খুশি হলেন। 

করোনার প্রথম দিক থেকেই বাংলাদেশের প্রস্ততি ছিল মোটামুটি আশাব্যঞ্জক। ৮ মার্চ আমাদের দেশে প্রথমবারের মতো করোনা রোগী সনাক্ত হয়। তবে করোনা মহামারীর শুরু থেকেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই অতিমারীর হাত থেকে দেশবাসীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিনরাত নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। শুধু কোভিড-১৯ মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা বাস্তবায়নে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা নির্দেশনা সংরক্ষণ করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে করোনা মহামারির মত দুর্যোগ মোকাবেলার কথা ভেবে এসব নির্দেশনা সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। এই সময়ে প্রধানমন্ত্রী প্রতিটি বিষয়ে সার্বক্ষণিক খোঁজ খবর রাখছেন এবং সে অনুযায়ী প্রতিনিয়ত বিভিন্ন নির্দেশনা দিচ্ছেন। করোনা মোকাবেলায় সরকারের অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতেও কাজে লাগতে পারে ভেবে এসব নির্দেশনা সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন

প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রতিটি বিষয় মনিটর করছেন এবং প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী নিজের জীবনের চেয়ে দেশ ও দেশের জনগণকে বড় মনে করেন বলেই ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও তিনি নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।

করোনা মহামারী থেকে মানুষের জীবন বাঁচাতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা, জনগণকে সচেতন করা এবং ক্ষতিগ্রস্থ মানুষকে অর্থ ও খাদ্য সহায়তার পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি চাঙ্গা রাখতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন নির্দেশনার পাশাপাশি কোভিড-১৯ মহামারী থেকে মানুষের জীবন বাঁচাতে এবং জীবিকা নিশ্চিত করতে এখন পর্যন্ত এক লাখ ১২ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকার (জিডিপি’র ৪ দশমিক ৩ শতাংশ) ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার।

এছাড়া উন্নয়ন কর্মকা-ও এগিয়ে চলছে সমানতালে। এই যে, গত ২৯ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেল সেতুর নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যমুনা নদীর ৩০০ ফিট উজানে সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের মধ্য দিয়ে এ নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন তিনি। এই সেতু নির্মাণ হলে রেল সংযোগে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ সময় ঘোষণা দেন, পুরো দেশকে অত্যাধুনিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হবে। ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ডাবল-লাইন ডুয়েল-গেজের এই রেল সেতু নির্মাণের ফলে এ অঞ্চলে যোগাযোগব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি হবে।  এই ডুয়েলগেজ ডাবল-ট্র্যাক সেতুটি দেশের বৃহত্তম ডেডিকেটেড  রেল সেতু হবে। নতুন সেতুর ওপর দিয়ে ব্রডগেজ লাইনে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার এবং মিটার গেজ লাইনটিতে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার বেগে রেল চলতে সক্ষম হবে। বঙ্গবন্ধু  শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু নির্মিত হলে ৮৮টি রেল চলাচল করতে সক্ষম হবে। প্রকল্পটি ২০২৫ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এই সেতুতে ব্যয় ধরা হয়েছে নয় হাজার ৭৩৪ কোটি ৭ লাখ টাকা। 

আবার, দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাসহ লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আর্থিক অগ্রগতি নিশ্চিত করতে সরকার মেগাপ্রকল্প গ্রহণ করেছে। অবকাঠামো উন্নয়নে মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে দেশের প্রবৃদ্ধি আরও বেগবান হবে। বড় বড় প্রকল্পের দিকে বিশেষ নজর দেয়ার জন্য সরকার দশটি মেগা প্রকল্পকে ফাস্টট্র্যাকভুক্ত করেছে। সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ফাস্টট্র্যাকভুক্ত মেগা প্রকল্পগুলো হচ্ছে- পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মেট্রোরেল প্রকল্প, এলএনজি টার্মিনাল ও গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প, পায়রা গভীর সমদ্রবন্দর, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ, দোহাজারী-রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু-মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পযন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্প। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অর্থের সংস্থান নিয়ে অনেকে অহেতুক সমালোচনা করেন। প্রকৃত তথ্য হলো, সময়ের পরিক্রমায় দেশের উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বৈদেশিক সহায়তার ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ফলে খাদ্য সহায়তার দরকার হয় না। জাতীয় আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় অনুদানের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাচ্ছে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থা হতে মূলত খাদ্য সহায়তা, পণ্য সহায়তা এবং প্রকল্প সহায়তা পেয়েছে। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বৈদেশিক সহায়তার ৮৫ দশমিক ৫০ শতাংশই ছিল খাদ্য ও পণ্য সহায়তা, আর মাত্র ১৪ দশমিক ৫০ শতাংশ ছিল প্রকল্প সহায়তা। অন্যদিকে, মোট সহায়তার ৮৮ দশমিক ২০ শতাংশ ছিল অনুদান এবং ঋণ ছিল ১১ দশমিক ৮০ শতাংশ। পক্ষান্তরে, ২০২০ অর্থবছরে প্রাপ্ত মোট বৈদেশিক সহায়তার মধ্যে প্রকল্প সহায়তার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ। এ সময়ে প্রাপ্ত মোট সহায়তার ৯৬ দশমিক ১৩ শতাংশ এসেছে ঋণ সহায়তা হিসেবে। 

এই যে, সরকারের বহুমুখী উন্নয়ন কর্মসূচির কারণে মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, বেড়েছে ক্রয় ক্ষমতা। জীবনযাত্রার মান বেড়েছে আগের তুলনায় বহুগুণ। জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের দিক থেকে গেল কয়েক বছরের বৃত্ত ভেঙে ৮ শতাংশের মাইলফলক অতিক্রম করে বাংলাদেশ। করোনাকালেও গত অর্থবছর শেষে দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়ায় ৫ দশমিক ২০ এ। অর্থনীতির এই যে ফুলে ফেঁপে ওঠা, তার নিরিখেই বাংলাদেশ চমকে দিচ্ছে বিশ^কে। নানা দেশের জন্য বাংলাদেশ এক অনুকরণীয় মডেল। বিশ^ নেতারাও উচ্ছ্বসিত বাংলাদেশের অব্যাহত উন্নয়ন কর্মকা- নিয়ে। এটা কী ভাবে সম্ভব হল- অবাক বিস্ময়! অর্থনীতি তো আর ম্যাজিক নয়। জাদুদ-ের পরশে যার ভোল পাল্টানো যায় না। অনেক কষ্টে সিঁড়ি ভেঙে উপরে ওঠা। পিছলে পড়লে ফের উত্তরণের সংকল্প। বিশ্বব্যাংক, এশীয় ব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও হতভম্ব। বলছে দেশটা করেছে কী! আমরা তো ভেবেছিলাম বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির সূচক কোনমতো ছ’য়ের ঘরেই আবদ্ধ থাকবে বহুকাল। এখন দেখছি, তারা সাত পেরিয়েছে, আটের ঘরও পেছনে ফেলে যাচ্ছে আরও সামনে। ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়নের ফলে মানুষের জীবন হয়েছে আরামপ্রদ ও ব্যস্তময়। বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রা ছড়িয়ে পড়ছে গোটা বিশ্বব্যাপী। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে একে ‘উন্নয়নের মডেল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতির উদীয়মান এই অগ্রযাত্রাকে ‘স্টার অব ডিজেস্টার ম্যানেজমেন্ট’ বলছেন বিশ্বের অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরাও। নিউইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের ভাষায় এদেশের অগ্রযাত্রা হলো ‘ঝঃধহফধৎফ নবধৎবৎ ড়ভ ঝড়ঁঃয অংরধ। নিউইয়র্ক টাইমস এর ‘ঝঁপপবংং রহ ধ ষধহফ কহড়হি ভড়ৎ উরংধংঃবৎং’ শিরোনামের প্রবন্ধে বলা হয়েছে, মহিলাদের উন্নয়নে বাংলাদেশ যা করেছে, তা অন্য মুসলমান দেশের জন্য অকল্পনীয়; অবিশ্বাস্য। 

এই যে, ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল নিয়ে এক সময়ে যে তুচ্ছতাচ্ছিল্য, তলাবিহীন ঝুড়ির কটাক্ষ, তা থেকে উদীয়মান অর্থনীতির তারকা হিসেবে খ্যাতি। সত্যি, মনের গহীনে ডেকে যায় আনন্দের বান। পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে বাংলাদেশকে টেনে সামনে নেওয়ার যে দুঃসাধ্য অভিযাত্রা, তার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের অর্থনীতির অগ্রগতির উপমাগুলো এমনি এমনি রাজনৈতিক বক্তৃতার রাশিমালায় গ্রোথিত হয়নি। পরিপ্রেক্ষিত ছাড়া যুক্ত হয়নি সরকারি প্রেস নোটে, কিংবা উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনার প্রস্তাবনায়। শব্দগুলোর মূল ভিত্তি রচিত হয়েছিল, একাত্তরে, বা তারও আগে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা থেকে। সেই সময়ে রোপিত বীজের পরিষ্ফুটন, পরিমার্জন, পরিবর্ধন, সংশোধন আর পরিচর্যার পরে আজকের অবস্থান।  

বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার প্রকৃতি, রোদ হাওয়া- তার আপন প্রয়োজনেই জন্ম দিয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। কেননা তাঁর জন্ম না হলে বাংলা মা খুঁজে পেত না নিজের সার্বভৌম ঠিকানা। হ্যাঁ, শেখ মুজিবুর নামের প্রচ- আবেগের বিস্ফোরণেই যেমন অভ্যুদয় হয়েছিল বাংলাদেশ নামে বাঙালির একমাত্র স্বাধীন রাষ্ট্রের, তেমনই এ দেশের প্রকৃতিও যেন নিজ হাতে গোপালগঞ্জের এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানকে ধীরে ধীরে তৈরি করে দিয়েছে অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির অস্তিত্বের স্বপ্নের পুরোধা, প্রবাদ পুরুষ। তিনি বাঙালির স্বপ্নের মানব। তিনি খোকাবাবু থেকে কখনো হয়ে উঠেছেন মহাপুরুষ। কারো কাছে তিনি মহামানব, কেউ ডেকেছেন মহাপ্রাণ নামে। কারো কাছে মনে হয়েছে তিনি কিংবদন্তির জীবন্ত নায়ক, কেউ চিনেছেন তাঁকে দানবীর হিসেবে। সর্বশেষ তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাবে ভূষিত হন। এসবের কোনো নামই মিথ্যে নয়। এর পেছনে বড় কারণ আছে। সেটা হলো এই যে, আমাদের এই হতভাগ্য সমাজের উন্নয়নে অনন্য অবদান রাখেন এমন মানুষের সংখ্যা খুব অল্প। বেশিরভাগেরই সামর্থ্য থাকে না, যাদের থাকে তারা স্বার্থবিমগ্ন ও আত্মসুখপরায়ণ হয়। তারা দানদক্ষিণা বা সমাজ ও মানুষের উন্নয়নের ধার ধারে না। সেই সঙ্গে খ্যাতির বিড়ম্বনায় হয়তো কিছু মানুষ সমাজের উন্নয়নে অল্পস্বল্প অবদান রাখার চেষ্টা করেন। তবে সেটা বিরক্তিতে, কেউ করেন বাধ্য হয়ে। কেউবা অদৃশ্য কোনো মতলবে। বঙ্গবন্ধুর অসামান্য অবদান কোনো বিনিময় ছাড়াই, সামনে-পিছনে না তাকিয়ে কেবল মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে। বঙ্গবন্ধুর এই অসামান্য হয়ে ওঠার একটা কারণও আছে, তা হলো এই যে, আমাদের সমাজের বেশিরভাগ মানুষই ভীরু, বীরের সংখ্যা অতি অল্প। তাই যে কোনো ক্ষেত্রে হোক বীরত্ব যিনি দেখান, সাহস করেন, এগিয়ে যান; তাঁর প্রতি ভেতর থেকেই সকলের শ্রদ্ধা ও ভক্তি জেগে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটেছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। লাল-সবুজের পতাকার ইতিহাসে বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু নামটি অবিচ্ছেদ্য। হাজার বছরর বাঙালির ইতিহাস পরাধীনতার গ্লানিময়। পরাজিত শক্তির শোষণ-পীড়ন, আধিপত্য মেনে নিয়েই বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছে। সেই বিকাশের ইতিহাসে ধর্মীয় ভাব-আন্দোলন থাকলেও স্বাধীনতার প্রশ্নটি ছিল অকল্পনীয়। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকালে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ভারতবর্ষ স্বাধীন করার প্রচেষ্টা ছিল বটে। তবে তাতে বাংলা ও বাঙালির স্বাধীনতার প্রসঙ্গটি স্থান পায়নি। পেয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর চেতনায়।

১০০ বছর আগে। তখন বাংলাদেশের জন্ম হয়নি, ভারতবর্ষ ফুঁঁসছে। একদিকে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সশস্ত্র লড়াই, অন্যদিকে গাঁন্ধীজীর অহিংস আন্দোলনের পথে স্বাধীনতার আন্দোলন। সেই সময়েই ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ এই জনপদে একটি শিশুর জন্ম হল। এখনকার বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার, সে সময়ের গোপালগঞ্জ মহকুমার বর্তমানে জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। শিশুটির বাবা শেখ লুৎফর রহমান, মা মোসাম্মৎ সাহারা খাতুন। তাঁদের ছয় সন্তানের মাঝের তৃতীয় সন্তানই শেখ মুজিবুর রহমান। সাধারণের ঘরে জন্মেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তাঁর কথাবার্তাও ছিল সাধারণের ভাষায়। সাধারণের দুঃখ, কষ্ট তাকে সবসময়ই আলোড়িত করতো। মর্মাহত করতো। তাই ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে, অন্যপ্রান্তে।  

টুঙ্গিপাড়ার খোকা মিয়া শুরুতে ছিলেন দুরন্ত কিশোর, উদ্যমী তরুণ। গ্রামের মুরব্বিদের কাছে মুজিবর, কিশোরদের সম্ভাষণ ছিল মুজিব ভাই। এরপর মুজিবর রহমান, অথবা শেখ মুজিবর রহমান। তার পর বহুদিন ধরে মানুষের মুখে মুখে তার নাম ছিল ‘শেখ সাহেব’। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন পরিচয় ‘বঙ্গবন্ধু’। একাত্তরের পর তিনিই স্বাধীন দেশের স্থপতি ‘জাতির পিতা’। তিন দশক কালের মধ্যে এভাবেই ঘটেছিল তার অবস্থানের উত্তরণ।

অসাধারণ নেতৃত্বের গুণাবলির স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ সে সময় আর কারো মধ্যে দেখা যায়নি। এমনকি বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্র্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ সে নেতৃত্বের অভাব বোধ করেছে গভীরভাবে। ব্রিটিশ শাসন থেকে বের হয়ে আসার জন্য পূর্ব বাংলায় মাস্টারদা সূর্যসেন, নেতাজি সুভাষ বসুসহ অনেকেই চেষ্টা করেছেন। সূচনা করেছেন সশস্ত্র সংগ্রামেরও। কিন্তু তা অসময়োচিত, অপরিকল্পিত হওয়ায় এবং এতে সাধারণ জনগণকে সম্পকৃক্ত করতে না পারায় তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়নি। সফল হয়নি সেসব আন্দোলন। 
বঙ্গবন্ধু পেরেছিলেন। তিনি মাটি ও মানুষের নেতা ছিলেন বলেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নটি সত্য হয়েছিল। রাজনৈতিক-সামাজিক ধারাবাহিক বিবর্তনের মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের মহানায়কের এই অবস্থানে উত্থিত হতে পেরেছিলেন। দেশ, দেশের মানুষ ও রাজনীতি ব্যাপারে তাঁর ভাবনা-চিন্তা, আদর্শবোধ-জীবনদর্শন ইত্যাদি অনুষঙ্গ আত্ম-পরিচয়ের মৌলিক উপাদানগুলো ক্রমান্বয়ে বিকশিত হয়েছে। তার সার্বিক বিবর্তনের গতি ছিল সামনের দিকে, প্রগতি অভিমুখে। তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের লোক, ছিলেন জনতার নেতা। মানুষের কাছ থেকে তিনি গ্রহণ করতে পারতেন, বিচার-বিবেচনার রসদ সঞ্চয় করতে পারতেন। সব বিষয়ে শেষ ভরসা করতেন মানুষের ওপরে। মানুষের ওপর, জনতার ওপর তাঁর এহেন অপার ভালোবাসা ও নৈকট্যই তাঁর ক্রমবিবর্তনের প্রগতিমুখীন হওয়াটাকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছে।

বাল্যকালে পারিবারিক আবহের কারণেই শেখ মুজিব মানবপ্রেমী হয়ে ওঠেন। অন্যায়, অবিচার আর প্রতিহিংসার বিরুদ্ধে প্রচ- ঘৃণা আর ক্লেদ তৈরি হয় সেই কচি মনেই। টুঙ্গিপাড়া গ্রামেই শেখ মুজিবুর রহমান ধন-ধান্যে পুষ্পে ভরা শস্য-শ্যামলা রূপসী বাংলাকে দেখেছেন। তিনি আবহমান বাংলার আলো-বাতাসে লালিত ও বর্ধিত হয়েছেন। তিনি শাশ্বত গ্রামীণ সমাজের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না ছেলেবেলা থেকেই গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন। গ্রামের মাটি আর মানুষ তাঁকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করতো। শৈশব থেকেই তিনি তৎকালীন সমাজজীবনে প্রজাপীড়ন দেখেছেন, দেখেছেন জমিদার, তালুকদার ও মহাজনদের শোষণ ও অত্যাচারের চিত্র। আর সে সময়েই মনে গেঁথে নিয়েছিলেন সাধারণের অভাব দুর করার দৃঢ় এক প্রত্যয়। 

আজকের প্রজন্মের কোনও বাঙালি তরুণ কল্পনাও করতে পারবেন না, বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা একদা কতটা সাগরের ঢেউয়ের মতো উত্তাল ছিল, কতটা বিস্তৃত ছিল আকাশের পরিসীমার মতো! যার সূচনা ঘটেছিল চল্লিশের দশকের শেষ প্রান্ত থেকেই। তার পর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটাতেই যেন, তার নেতৃত্বের বিকাশ ত্বরান্বিত হয়েছিল বায়ান্নœ সালের মহান একুশের ভাষা আন্দোলনের চেতনার স্ফূরণের ভেতর দিয়ে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষাভাষী মানুষ যতই উপলব্ধি করতে পারল মাতৃভাষাকে লালন করতে, নিজস্ব সংস্কৃতিকে পালন করতে স্বাধীনতার কোনও বিকল্প নেই, শোষণ নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচার জন্য লড়াই অবশ্যম্ভাবী ততই যেন বঙ্গবন্ধু ধীরে ধীরে পরিণত হয়ে উঠলেন তাঁদের মানসনেতায়। ঘটনা পরম্পরায় সত্তরের নির্বাচনকে ঘিরে তিনি রূপান্তরিত হলেন বাংলার জনগণের আশা-আকাঙ্খার প্রতীকে। তাঁকে ঘিরেই অবয়ব পেল বাঙালি জাতিসত্তা, ঐক্যবদ্ধ হল বাঙালি নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায়। রচিত হল বাঙালি জাতির মুক্তির পথ।

পাকিস্তান যে সৃষ্টি হলো, সে থেকে শুরু হলো বাঙালিদের বঞ্চণার শিকার হওয়ার। তা কি আর এক দিক থেকে! আঘাত এলো বাংলা ভাষায়, ক্ষত বিক্ষত হলো অসাম্প্রদায়িকতার সম্প্রীতি। আবার, ব্রিটিশ আমলে যে সংগঠনগুলো হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগুচ্ছিল, যাতে খানিকটা আশার আলো দেখা যাচ্ছিল, তাতেও সওয়ার হয়ে বসলেন প্রতিক্রিয়াশীলরাই। এতে মানসিকভাবে খানিকটা হোঁচটই খেলেন শেখ মুজিবুর রহমান। অসাধারণ ধী শক্তি আর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে বুঝে নিলেন, আর যাই হোক, এটা দিয়ে অন্তত বাঙালিদের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে না। আসবে না সার্বভৌমত্বও। এর পর থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে সামনে এগোতে শুরু করলেন। নেতৃত্বের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যেই সম্পৃক্ত হলেন সাধারণ কর্মচারিদের দাবির সংগ্রামে। 

মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল কর্মকা-ের সঙ্গেও যাচ্ছিল না বঙ্গবন্ধুর নীতি আদর্শ। তাই সে পথে আর হাঁটলেন না। প্রতিবাদ করেন। পরবর্তীতে ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত আওয়ামী লীগের একজন প্রধান সংগঠক হয়ে ওঠেন। অসাধারণ ত্যাগ আর কৌশলী কর্মযজ্ঞে রাজনীতির মাঠ দখলে খুব একটা সময় লাগেনি তাঁর। অল্পদিনেই সর্বস্তরের মানুষের কাছে অতি পরিচিত হয়ে উঠেন। সাধারণদের কাছেও ছিলেন ব্যাপক জনপ্রিয়। যার অংশ হিসেবে প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় তিনি দুই বার মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। 

রাজনৈতিক অস্থিরতা আর নেতাদের দায়িত্বহীনতায় তিনি বুঝতে সক্ষম হন, বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে দলীয় সিদ্ধান্ত কিংবা নেতাদের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করা ঠিক হবে না। দলের ভিন্নরূপ সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও এ্যাসেমব্লিতে ন্যাপ উত্থাপিত স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিতে তিনি অস্বীকৃতি জানান।

১৯৫৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান গণপরিষদে করাচিকে ফেডারেল রাজধানী করা হয়। সে সময় গভর্নরের বেতন করা হয় ৬ হাজার রুপি। সে সময় শেখ মুজিব গর্জে উঠেন। তিনি কঠোর  ভাষায় এর প্রতিবাদ করেন। প্রশ্ন তোলেন, যেখানে একজন পিয়নের বেতন মাত্র ৫০ রুপি, সেখানে কী করে গভর্নরকে এত বেতন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। পুর্ববঙ্গের জনগণকে ধোঁকা না দেয়ার জন্য তিনি পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের পরামর্শ দিয়েছিলেন। অনির্বাচিত গভর্নর জেনারেলের হাতে অসীম ক্ষমতা প্রদানের বিরোধিতা করেন ১৯৫৫ সালের ১ অক্টোবরের অধিবেশনে। সংদের দৈনন্দিন কর্মসূচি বাংলায় ছাপানোর দাবি তোলেন পরের বছরের ১৭ জানুয়ারির অধিবেশনে। বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের দাবি করেন ওই বছরেরই ১৪ ফেব্রুয়ারির অধিবেশনে। এসব বক্তৃতায় তিনি বারবার সাম্যের কথা বলেন। গরিবদের ওপর জেলজুলুম বন্ধ করতে বলেন। ইসলামের নামে শোষণ, অত্যাচার বন্ধের আহবান জানান। 

১৯৫৪ সালের নির্বাচনী প্রচারে একবার গ্রামে গেছেন বঙ্গবন্ধু। সে সময় প্রত্যন্ত এক গ্রামের এক বৃদ্ধা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। ‘আমি যে গ্রামেই যেতাম, জনসাধারণ শুধু আমাকে ভোট দেওয়ার ওয়াদা করতেন না, আমাকে বসিয়ে পানদানে পান এবং কিছু টাকা আমার সামনে নজরানা হিসেবে হাজির করতেন। না নিলে রাগ করতেন। আমার মনে আছে, খুবই গরিব এক বৃদ্ধ মহিলা কয়েক ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে, শুনেছে এই পথে আমি যাব, আমাকে দেখে আমার হাত ধরে বলল, বাবা, আমার এই কুঁড়েঘরে তোমায় একটু বসতে হবে। আমি তার হাত ধরেই তার বাড়িতে যাই। অনেক লোক আমার সঙ্গে, আমাকে একটা পাটি বিছিয়ে বসতে দিয়ে এক বাটি দুধ, একটা পান ও চারআনা পয়সা এনে আমার সামনে ধরে বলল, ‘খাও বাবা, আর পয়সা কয়টা তুমি নেও, আমার  তো কিছুই নাই।’ আমার চোখে পানি এলো। সেই দিনই আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, মানুষেরে ধোঁকা আমি দিতে পারবো না।” বঙ্গবন্ধুরর  অর্থনৈতিক মুক্তির পথে এটাই ছিল অর্থনৈতিক মুক্তির নীতি।

রাজনৈতিকভাবে আরও সংগঠিত আন্দোলন শুরু করেন। লক্ষ্য স্বাধীনতা অর্জন। ৬৬ সালে স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে সামনে রেখে বাঙালির স্বাধিকারের জন্য ৬ দফা দাবি পেশ করেন। এগিয়ে যেতে থাকেন দৃঢ় চেতাভাবে। চোখেমুখে তখন একটাই স্বপ্ন, বাঙালির স্বার্থ, দেশের স্বাধিকার। ‘বাংলাদেশ শ্মশান কেন’ তাঁর অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন চলতে থাকে দুর্বার গতিতে। পাকিস্তানিদের দীর্ঘদিনের প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ কে স্বাধীনতার পক্ষে অপরিহর্যতা হিসেবেই তুলে ধরতে পেরেছিলেন তিনি। দলমত নির্বিশেষে দেশবাসী তাঁর সঙ্গে একাত্ম হতে শুরু করে ছয় দফাকে কেন্দ্র করেই। সরকার তখন মরিয়া। যে কোনো উপায়ে বঙ্গবন্ধুকে স্তব্ধ করে দিতে চায় পাক সরকার। ইতিহাসের পক্ষে এবং ইতিহাস সৃষ্টির মতো প্রজ্ঞা, প্রত্যয় ও দক্ষতাসম্পন্ন নেতৃত্বের কাছে হার মানে সকল ষড়যন্ত্র। তাই কাজে আসলো না আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাও। বরং এসব ষড়যন্ত্র তাঁকে নেতা হিসেবে পাকাপোক্ত করে তুলে। অদ্বিতীয় উচ্চতায় উঠে আসে জনপ্রিয়তা। এভাবেই তিনি হয়ে যান বাঙালির একক ও অবিসংবাদিত নেতা। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর মুক্ত হয়ে আসেন মহানায়ক। বাঙালির জননন্দিত নেতা হয়ে উঠেন ‘বঙ্গবন্ধু’।

১৯৭০ সালের নির্বাচনের প্রস্তুতির শেষ পর্যায় তখন। ১২ নভেম্বরের ঘুর্ণিঝড় বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চেতনায় নতুন এক মাত্রা যোগ করে। একদিকে যেমন তিনি বুঝতে পারলেন, দুর্যোগ-দুর্বিপাকে বাঙালি কতটা অসহায়, পাকিস্তান সরকার কতটা নির্বিকার, অন্যদিকে অনুভব করলেন, গরিব-দুঃখী মানুষগুলোর কী কষ্ট। তাই তাঁদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য চাই সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনা। সেই পরিকল্পনার কিছু অংশ তিনি প্রকাশ করলেন, ১৯৭০ সালের শেষ দিকে, পাকিস্তান টেলিভিশনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে, তাঁর প্রাক-নির্বাচনি ভাষণে। সেদিনের ভাষণে তিনি এমন সব বিষয়ের অবতারণা করেছিলেন, যার সঙ্গে গণমানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের সরাসরি যোগ ছিল। তিনি শুরুতেই একচেটিয়াবাদ ও কার্টেলের বিরুদ্ধে মুখ খুললেন। বললেন, ভূমি-সংস্কার না করার ফলে দরিদ্র কৃষকদের অবস্থা দিন দিন আরো খারাপ হচ্ছে। ৯০ লাখ শ্রমজীবী মানুষ বেকার। পাশাপাশি তিনি তুলে ধরেন অর্থনৈতিক বৈষম্যের ভয়াবহ এক চিত্র। গ্রামাঞ্চলে প্রায় দুর্ভিক্ষাবস্থার কথা জানালেন। আর বললেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে তিনি কী কী করবেন। বৈষম্য দুর করবেন। সমবায় সমিতি গড়ে তুলবেন। শিল্পের প্রসারে ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পকে গুরুত্ব দিবেন। কৃষি ব্যবস্থা সংস্কার করবেন। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করে দিবেন। গ্রামে গ্রামে বিজলিবাতি দিবেন। পুঁজি বিনিয়োগ করবেন শিক্ষাখাতে। নিম্ব আয়ের মানুষদের জন্য বাসগৃহ নির্মাণ করবেন। প্রতি ইউনিয়নে পল্লী চিকিৎসাকেন্দ্র খুলবেন। অর্থনীতির সর্বক্ষেত্রে ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে সবকিছুর পুনর্বিন্যাস করবেন। নয়া মজুরি কাঠামো তৈরি করবেন। জনগণের সরকার কায়েম করবেন। ’৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তাঁর দল স্মরণকালের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হয়। জাতীয় পরিষদের বৈঠক বাতিল করা হয়।  

তীব্র প্রতিবাদে গর্জে ওঠে সমগ্র বাঙালি জাতি। বঙ্গবন্ধু জনতার ক্রোধ ও স্বাধিকারের প্রত্যয়কে ধারণ করে জাতিকে স্বাধীনতার সংগ্রামের পথে এগিয়ে নেন। ৭ মার্চের ভাষণে তিনি বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করো’। সে ভাষণ ছিল সংগ্রামের প্রারম্ভিকা। ছিল মুক্তির সূচনা। জনযুদ্ধের নির্দেশক এ ভাষণ একটি জাতির উন্মুখ চেতনাকে স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল। 

এ কণ্ঠ কাঁপিয়ে দিয়েছিল সমগ্র দুনিয়ার মুক্তিকামী মানুষকেও। তাই বিশ্বের বড়ো বড়ো জননেতাকেও ছাড়িয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধু। সমগ্র দেশবাসী এই ভাষণ শুনে শিহরিত হয়েছেন। সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছেন, বাংলাদেশ আর পাকিস্তানে গ-িবদ্ধ নেই। আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতাপ্রাপ্তি সময়ের ব্যাপার মাত্র। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে এলো স্বাধীনতার ঘোষণা। বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন স্বাধীনতার জন্য জাগ্রত জাতির ঐক্যের প্রতীক। স্বাধীনতার স্থপতি। জাতির জনক। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের আকাশে পতপত করে উড়লো লাল সবুজের নতুন পতাকা। দেশ হয় হানাদার মুক্ত।

'৭২'র ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু সদ্য স্বাধীন স্বদেশের মাটিতে প্রথম পা রাখেন। বঙ্গবন্ধু বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরলেন। শুরু করলেন, ‘অন্ধকার থেকে আলোর পথে’ যাত্রা। বঙ্গবন্ধু ছিলেন ব্যাপক অগ্রগতির জন্য দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক পরিকল্পনার প্রবর্তক। তার অর্থনৈতিক আদর্শ ও কৌশল ছিল- নিজস্ব সম্পদের ওপর দেশকে দাঁড় করানো। এক ধ্বংসস্তুপের ওপর দাঁড়িয়ে তিনি ঘোষণা দিলেন, সোনার বাংলা গড়ে তোলার। অঙ্গীকার অনুযায়ী, চমৎকার একটি সংবিধান দিলেন মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই। সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের কথা লেখা আছে সংবিধানের পাতায় পাতায়। জাতিকে উপহার দিলেন, প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, যার মূল লক্ষ্য ছিল সম্পদের সামাজিকীকরণ। 

দেশ-বিদেশে অবস্থানরত শ্রেষ্ঠ বাঙালি মেধার সম্মিলন ঘটালেন তিনি পরিকল্পনা কমিশনে। যাত্রাতেই বললেন, ‘আমাদের চাষীরা হলো সবচেয়ে দুঃখী ও নির্যাতিত শ্রেণি। তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য আমাদের উদ্যোগের বিরাট অংশ অবশ্যই তাদের পেছনে নিয়োজিত করতে হবে।’ 
দেশ স্বাধীন হলো। সারা দেশের মাঠে ফসল নেই। কৃষকরা গত নয় মাস বিপর্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। ফসল উৎপাদন নগন্য। সাড়ে সাত কোটি মানুষের খাদ্য দরকার। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই তো আর এত ফসল উৎপাদন করা যায় না। কৃষকের অবস্থাও নেই ফসল উৎপাদনের। এতদিন সরাসরি যুুদ্ধে অংশগ্রহণ, ভারতে আশ্রয় গ্রহণ বা পালিয়ে বেড়ানোর ফলে কৃষকের সংসার ও মাঠ অগোছালো। এসব গুছিয়ে নিতে সময় দরকার। দরকার বীজ, চাষাবাদের গরু, হাল, লাঙল। এসব আবার নতুন করে গোছাতে কিছু প্রস্তুতি দরকার। 

বঙ্গবন্ধু তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিলেন, অভাবগ্রস্ত অবস্থা কাটিয়ে উঠতে ৩০ লাখ টন খাদ্য আমদানি করতে হবে। আর, অতিঅসহায় কৃষকদের বিনামূল্যে সার, সেচ, উন্নত বীজ ও কৃষি উপকরণ সরবরাহ করতে হবে। অন্যদের মাঝে এসব বিতরণ করতে হবে স্বল্পমূল্যে, যা এখন তাঁর মেয়ে করছেন। একই সঙ্গে সব কৃষকদের কৃষি ঋণ মওকুফ করে দেয়ার ঘোষণা দিলেন। সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহারের ঘোষণাও দিলেন। কৃষকদের মাঝে খাস জমি বিতরণ করলেন। আর, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করা হলো। তিনি কৃষিতে প্রয়োজনীয় অর্থায়নের জন্যে কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন। উন্নত বীজ ও প্রযুক্তি ব্যবহারের উদ্যোগ নেন, উচ্চতর কৃষি গবেষণা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। বঙ্গবন্ধু এসব করলেন কৃষি নির্ভর সমৃদ্ধ অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্য। কৃষক-শ্রমিকদের তিনি খুবই শ্রদ্ধার সাথে দেখতেন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি, জাতীয় সংসদের ভাষণে বলেছিলেন, ‘করাপশন আমার বাংলার কৃষকরা করে না। করাপশন আমার বাংলার মজদুররা করে না। করাপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ’। বঙ্গবন্ধুর এমন অসংখ্য উক্তি ও ভাষণ রয়েছে, যাতে তিনি কৃষক-শ্রমিক শ্রেণিকে গুরুত্ব দিয়েছেন, সম্মান করেছেন। কারণ, তিনি জানতেন, এরাই সমৃদ্ধ বাংলাদেশের ভিত্তি। 

বঙ্গবন্ধু যখন স্বাধীন বাংলার দায়িত্ব নিলেন, সে সময়ে কৃষকদের স্বার্থ সবচেয়ে আগে বিবেচনা করলেন। আমার মনে পড়ে, ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে প্রায় ৫০১ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। তার মধ্যে প্রায় ১০০ কোটি টাকাই ছিল কৃষিক্ষেত্রের উন্নয়নে, কৃষকদের স্বার্থে। বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন, কৃষকরা বাঁচলে, স্বনির্ভর হবে দেশের অর্থনীতি। 

প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মুখবন্ধে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও পরিকল্পনা  কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, কোনো পরিকল্পনাই, এমনকি সবচেয়ে সুন্দরভাবে গ্রথিত পরিকল্পনাও কোনো ভালো ফল অর্জন করতে পারে না, যদি না জনগণের সার্বিক সহযোগিতা নিশ্চিত হয়। বললেন, ‘সম্পদের বণ্টন ব্যবস্থায় সমতা আনতে হবে।’ শুধু কথা নয়, কাজেও তাঁর কথার প্রতিফলন ঘটলো। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ, কৃষকদের কৃষি-উপকরণ সরবরাহের লক্ষ্যে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ গ্রহণ, শিল্পের জাতীয়করণ প্রভৃতি অর্থনৈতিক নীতি সংস্কারের সূচনা করে তিনি সাধারণের প্রতি তাঁর পক্ষপাতিত্বের সাক্ষর রেখেছিলেন। এই ধাঁচের নীতি গ্রহণের মধ্য দিয়ে তিনি সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির পক্ষে যে অবস্থান নিয়েছিলেন, তা পরিষ্কার। এভাবেই তিনি নিজে স্বপ্ন দেখলেন, জাতিকে সমৃদ্ধির স্বপ্ন দেখালেন। বললেন, ‘শ্মশান বাংলাকে সোনার বাংলা করে গড়ে তুলতে চাই। সে বাংলায় আগামী দিনের মায়েরা হাসবে, শিশুরা খেলবে। আমরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তুলবো।’ এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তিনি রাতদিন পরিশ্রম করেছেন। বিধ্বস্ত এক অর্থনীতিকে চাঙ্গা করেছেন ।

ভঙ্গুর অর্থনীতিকে মজবুত করতে পারে সুচিন্তিত পরিকল্পনা। বঙ্গবন্ধু সেই সত্য বুঝতে পেরেছিলেন। দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদদের নিয়ে তিনি পরিকল্পনা কমিশন গঠন করলেন। তাঁদের দায়িত্ব দেওয়া হলো, সদ্য স্বাধীন দেশের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পরিকল্পনা গ্রহণের। তাঁরা প্রণয়ন করেন দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৭২-১৯৭৬)। এটি নিছক একটি পরিকল্পনা দলিল ছিল না, ছিল স্বপ্ন পুরোনরে পদক্ষেপ। এই পরিকল্পনার ভিত্তি ছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। যা ছুঁয়ে যায় বঙ্গবন্ধুর ছয়দফার আন্দোলন। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার পায় অবকাঠামো নির্মাণ। তিনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন পুনর্বাসন ও নির্মাণ কেন্দ্র নির্মাণে। এ তালিকায় ছিল বন্দর, রাস্তাঘাট, কলকারখানা, সেতু, কালভার্ট, স্কুল-কলেজ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ। শিক্ষা, পরিকল্পিত পরিবার সম্বলিত জনসংখ্যানীতি, দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং আয় ও সুযোগ বৈষম্য হ্রাসকরণেও বঙ্গবন্ধুর ছিল সজাগ দৃষ্টি।

বঙ্গবন্ধু বিকেন্দ্রীকরণ চেয়েছিলেন। কুড়িগ্রাম বা টেকনাফ থেকে প্রশাসনিক কাজের জন্য মানুষকে ঢাকায় আসতে হবে। সময় নষ্ট হবে। গুণতে হবে অতিরিক্ত খরচ। বঙ্গবন্ধু তা চাননি। তিনি জেলা পরিষদ গঠন করলেন। প্রশাসনে আমূল সংস্কার এনে জেলা গভর্নর পদ্ধতিতে সকল প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে বিকেন্দ্রীকরণ করার বিরাট পরিকল্পনার ঘোষণা করেন। তিনি জেলা গভর্নরদের নিয়ে প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আয়োজন করেন। জেলা পরিষদ শক্তিশালী হলে, দেশও শক্তিশালী হবে। তৃণমূলের উন্নয়ন নিশ্চিতের মাধ্যমেই সম্ভব দেশের প্রকৃত উন্নয়ন- এই ভাবনাটা তিনি দৃঢ়ভাবে ধারন করতেন। 

বঙ্গবন্ধু দীর্ঘসময় আন্দোলন সংগ্রামে কাটিয়েছেন। তাঁর প্রশাসনিক নেতৃত্বদানের অভিজ্ঞতা সময়ের হিসাবে হয়তো কম, কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে অনেক বেশি। সদ্যস্বাধীন দেশে, বিদেশ থেকে দেশে ফিরেই তিনি ভারতীয় সেনা দেশে পাঠিয়ে দিলেন। ফিলিপাইনে এখনো আমেরিকান সেনারা ঘোরাফেরা করে। সেই কয়েক দশক পার হয়ে গেলেও, বিদেশী সেনামুক্ত হতে পারেনি জাপান। অথচ, মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে- বাংলাদেশকে সম্পূর্ণরূপে বিদেশী সেনা মুক্ত করার জন্য চরম সাহসের দরকার, যেটা ছিল বঙ্গবন্ধুর। তাঁর নেতৃত্বে সদ্য স্বাধীন দেশে বড় ধরনের কোনো বিশৃঙ্খলা ঘটেনি। সশস্ত্র সংগ্রামে স্বাধীনতা অর্জিত অন্যান্য দেশের ন্যায় বিপুল প্রাণহানি এখানে ঘটেনি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে একটি কার্যকর ও সর্বজনে গ্রহণযোগ্য শাসনব্যবস্থায় নিয়ে আসেন জাতির জনক।

স্বাধীন দেশের পুনর্গঠনে বিদেশী অর্থের দরকার। বিশ্বব্যাংক এ ক্ষেত্রে এগিয়ে এলেও চিরাচরিত শর্তের বেড়াজাল থেকে বের হতে পারে না। বঙ্গবন্ধু বিশ্বব্যাংককে বলেন, বিশ্বব্যাংকের নেতৃত্বে যে এইড কনসোর্টিয়াম হয়ে থাকে, তা ঢাকায় করতে হবে। বিশ্বব্যাংক পাল্টা শর্ত দেয়, পাকিস্তানের দেনার ভার বাংলাদেশকে নেয়ার। বঙ্গবন্ধু পরিকল্পনা কমিশনের সহায়তা নেন। তিনি বিশ্বব্যাংককে বলেন, পাকিস্তান আগে বাংলাদেশ কে স্বীকৃতি দিক- পরে না হয় দেখা যাবে। ঋণ নয় কেবল, বাংলাদেশের সম্পদ ভাগাভাগির বিষয়টিও আলোচনা করা যাবে। যুক্তি-পাল্টা যুক্তি, এভাবে তেয়াত্তরের এইড কনসোর্টিয়ামের সভা কিন্তু ঢাকাতেই অনুষ্ঠিত হয়। 

বঙ্গবন্ধু ঘরহীন মানুষদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন। তিনি অনেক আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করেন। ঘরহীন লোকদের ঘরের ব্যবস্থা করেন। আমি তখন মুজিব নগর সরকারের আঞ্চলিক প্রশাসকের নির্দেশনায় ভারতে আশ্রয় নেয়া প্রায় এক কোটি শরনার্থীর অনেকেই দেশে ফিরিয়ে আনার গুরুতর দায়িত্বপালন করি। সে সময় খাদ্য, যাতায়াত ও বাসস্থান নিশ্চিত করা কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা প্রদানও ছিল প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও সাহসিকতায় সে সব সমস্যার উত্তরণ সম্ভব হয়েছিল। সে সময় ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হোসেন আবেদ শার্লায় শরনার্থীদের ঘর বানানোর জন্য ভারত থেকে বাঁশ আমদানি করতে চান, তবে ভারত তাতে বাধা দিলে বঙ্গবন্ধুর সরকার বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হন। সরকারের হস্তক্ষেপে বিষয়টির ত্বড়িত সমাধা হয়। আমরা সরকারি কর্মকর্তারা সে সময় দিন রাত কাজ করতাম। আমাদের মাঝে অনন্ত কাজের প্রেরণা ঢুঁকিয়ে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। শিক্ষার প্রসারে তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় ছাব্বিশ হাজার শিক্ষককে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেন। সারাদেশে তীব্র গতিতে এগিয়ে চলে পুনর্গঠনের কাজ। এগারো হাজার স্কুল তৈরি করেন, বিধ্বস্ত সেতু, রাস্তা, রেল যোগাযোগ ইত্যাদি পুন:স্থাপন করেন। বাড়ির পাশে খোলা জায়গায় ফল, শাকসবজি চাষ করতে বললেন। পুকুরে মাছ চাষ করতে বললেন। আমরা অল্প কদিনেই নেতিবাচক থেকে ইতিবাচক ধারার উন্নয়নে চলে এলাম। জিনিষপত্রের দাম কমে যেতে শুরু করলো। 

একটি দেশের যুদ্ধ পরবর্তী অবস্থা তত্ত্ব বা গাণিতিক হিসাব দিয়ে পরিসংখ্যান করা যায় না। বিধ্বস্ত অর্থনীতিতে বঙ্গবন্ধু যে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তা ইতিহাসের পাতায় বাস্তব কর্মসূচি হিসেবে দেদীপ্যমান। সে সময়ে তিনি বাস্তবতা উপলব্ধি করে অনেক বিস্ময়কর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যা পরবর্তীতে দেশের অর্থনীতির শক্ত ভিত তৈরিতে সহায়ক হয়েছিল। 

স্বাধীনতার পর পর ইংল্যান্ডে গেলাম সরকারি একটা কাজে। সে সময় লন্ডনপ্রবাসী সিলেটীরা দেশ পুনর্গঠনে অতি উৎসাহী। এরাই বাংলাদেশ বিমান চালু করেন, দেশে বৈদেশিক মুদ্রার যোগান দেন। বিদেশী সহায়তার বিষয়টি আলোচনায় আসলে তারা জানালেন যে, সরকার যদি তাদের নিজ নিজ তহবিল দিয়ে দ্রব্য সামগ্রী আনতে অনুমতি দেয়, যেমন শিশুদের জন্য গুঁড়ো দুধ, ব্লেডসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র, তাহলে তারা তা আনতে পারবেন। বহু ঠেলাঠেলির পর সরকারি আমলারা যখন তার অনুমোদনে অস্বীকৃতি জানালেন, তখন বিষয়টি বঙ্গবন্ধুর কাছে পেশ করা হলে তিনি জানতে চান, কিসের জন্য অনুমোদন প্রয়োজন। এতে কি উপকার হবে। যখন তাঁকে বললাম যে, এর ফলে দুধের শিশু বিকল্প খাদ্য হিসেবে গুঁড়ো দুধ সহজে খেতে পারবে। এটা শুনে তিনি তাৎক্ষণিক তা অনুমোদন করেন। শিশুর প্রতি এমনি ছিল তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা। প্রবাসীদের নিজ বৈদেশিক মুদ্রায় পণ্য আমদানি ‘ওয়েজ আর্নার স্কীম’ নামে সমধিক পরিচিত। সে সময় এক পাউন্ডে আঠারো টাকা হতো। আর, এক পাউন্ডে পাওয়া যেতো ৭৫টি ব্লেডের প্যাকেট। প্রতি প্যাকেটে ৫টি ব্লেড থাকতো, যা দেশে আনলে প্রতিটি ব্লেড বিক্রি হতো ৫ টাকায়। একইভাবে শিশু খাদ্য হিসেবে গুঁড়ো দুধও সস্তায় আমদানি সম্ভব হয়।

এখানে উল্লেখ্য যে, আমি দেশে ফিরে এসে বিষয়টি প্রস্তাব আকারে মাননীয় স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী দেওয়ান গাজীর মাধ্যমে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠাই। তবে তৎকালীন বাণিজ্য মন্ত্রী এম আর সিদ্দিকী এবং ওই মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বরত সচিব জনাব নুরুল ইসলাম তা নাকচ করে দিলেন। প্রস্তাবনাটি আঁতুর ঘরেই বিনস্ট হয়ে গেলো। বেশ কিছু সময় পার হয়ে গেলো এরই মাঝে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে এলেন আবু হেনা কামরুজ্জামান। জনাব দেওয়ান ফরিদ গাজী এবং হেনা ভাইয়ের ঘনিষ্ঠতা ছিল প্রবল। সে জন্য প্রস্তাবটি আবার নতুন করে পেশ করা হলো। এবারও সচিব সাহেব নাকচ করে দিলেন। সচিবের যুক্তি ছিল, প্রস্তাবনাটি গৃহীত হলে কেবল কয়েকজন সিলেটি প্রবাসীর উপকার পাবে, তাদের বাণিজ্য হবে। দেশের কিছু হবে না। তার এমন অদুরদর্শী সিদ্ধান্তে আমরা বেশ মর্মাহত হলাম। সে সময় প্রতি ছয় মাস পর পর বাণিজ্য নীতি ঘোষণা করা হতো। 

একদিন দেওয়ান ফরিদ গাজির অফিসে বসে আড্ডা হচ্ছে। সিলেট এলাকা থেকে অনেক নেতাকর্মী আসছেন দেখা করার জন্য। এদেরই একজন কম্যান্ডান্ড মানিক চৌধুরী, এমপি। তিনি বললেন, মোমেন, আপনার নেতাকে নিয়ে চলেন নেতার কাছে যাই। যেই বলা, সেই কাজ। সবাই মিলে ছুটলাম নেতার কাছে।  বঙ্গবন্ধু জিগাইলেন, দেওয়ান সাহেব, কেন এসেছেন। দেওয়ান সাহেব বিস্তারিত বললেন।
বিদেশী অর্থ সহযোগিতার পরিবর্তে প্রবাসীদের অর্থে শিশুখাদ্য আমদানির কথা শুনে আশ্চর্যান্বিত হলেন বঙ্গবন্ধু। বললেন, শিশুদের জন্য, অ্যাঁ, শিশুদের জন্য? এটা তো অ্যালাও করা উচিত। পরে সংশ্লিস্ট সেক্রেটারিকে ডেকে তিনি হুকুম দিয়ে দিলেন। শিশুদের জন্য বঙ্গবন্ধুর এমনই ছিল দরদ ভরা মন। 

আরেকবার ইন্ডিয়াতে গিয়েছি, ইসকাপ সম্মেলনে। বাংলাদেশ সেবার ইসকাপের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রাথী। সে সময়ে নারু রিপাবলিক নামে একটা দেশও সম্মেলনে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রাথী। আমার সে দেশ সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না। আমাদের ছিল অল্প কয়েকজনের প্রতিনিধি দল। বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী ছিলেন দলের নেতা। প্রতিনিধি দলের উপ-দল নেতা অতিরিক্ত সচিব আশরাফুজ্জামান সাহেব আমাকে ডেকে বললেন, নারু রিপাবলিকের রিসেপশনে যেতে হবে। আর সময়মত নেতার জন্য ভোটটা চাইতে হবে। এখনকার মত গুগল ছিল না সে সময়। তাদের সম্পর্কে ধারনা নেই। সাদা চামড়ার নারোর অ্যাম্বাসেডরের সঙ্গে একটু কথা বলে এগোলেই তাদের প্রেসিডেন্টের সাথে পরিচয় হয়। লম্বা চেহারার প্রেসিডেন্ট। তবে, দেখতে সাদা নয়, অদ্ভুত রকমের কালো। বেশ মোটাশোটা, বিরাট দেহ, তবে খুব হাসিখুশি মেজাজের। অল্পক্ষণেই আলাপ জমে উঠলো। 

দেশে তখন বন্যা। ১৯৭৪ সাল। বড় বন্যা হয়েছে। সৌজন্যসূচক আলাপের পর, কথায় কথায় দেশের প্রসঙ্গ উঠালাম। দেশ কেবল স্বাধীন হয়েছে। আমরা এখনো গুছিয়ে উঠতে পারিনি। এর মধ্যেই শুরু হলো বড় আকারের বন্যা। প্রকৃতি যেন আমাদের উপর বেশিই নাখোশ। মরার ওপর খাড়ার ঘায়ের মতো অবস্থা। পারলে আমাদের কিছু সাহায্য দাও। বিদেশী সাহায্য গ্রহণের জন্য আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ভান্ডার রয়েছে। তিনি সব শুনে টুনে দরদ দেখালেন। শেষে ঘোষণা দিলেন, তারা আমাদের দেড় মিলিয়ন অষ্ট্রেলিয়ান ডলার সাহায্য দিবে। ইন্দোনেশিয়ার এডাম মালিকও ছিলেন একজন শক্তিশালী প্রার্থী, যাকে তার ভীষণ অপছন্দ। এই ফাঁকে আমি কিন্তু আমার নেতার জন্য ভোট চাওয়ার সুযোগটাও হাতছাড়া করিনি। উল্লেখ্য যে, ওই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাংলাদেশ বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়।

প্রেসিডেন্ট ড. হেমার ডি- রোবাটের অফার পেয়ে আমি তো মহাখুশি। পারিতো দৌড়াতে দৌড়াতে এসে আমাদের টিমকে খুশির খবরটি জানিয়ে দেই। খবরটি শুনে সবাই খুশি। তবে সাহায্য গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরুর পর দেখা দিলো বিপত্তি। দিল্লী মিশনের উপ-প্রধান আতাউল করিম বেজায় মুশকিলে পড়লেন। দেখা গেলো, তারা আমাদের স্বীকৃতি দেয়নি। আমরাও দেইনি। স্বীকৃতি না হলে চেক নেই কিভাবে? তখন পানি সম্পদ মন্ত্রী শারনিয়াবত সাহেবও ছিলেন একই হোটেলে। তার রুমে সাবই দলেবলে গেলাম। ল্যান্ড ফোনে কয়েকবার চেষ্টার পর বঙ্গবন্ধুকে পাওয়া গেলো। তিনি সব শুনলেন। খুশি হলেন। এর পর বললেন, যাও, আমি নারু রিপাবলিককে স্বীকৃতি দিয়ে দিলাম। ইন্দিরা গান্ধীর উপস্থিতিতে বিজ্ঞান ভবনে চেক হস্তান্তর হলো। মিললো কাঙ্খিত অষ্ট্রেলিয়ান ডলার। 

দেশে ফেরার কয়েক দিন পর। মাননীয় মন্ত্রী গেলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। সঙ্গে আমাকে নিয়ে গেলেন। বঙ্গবন্ধু আমাদের দেখে উঠে দাঁড়ালেন। আমাকে পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি বিশালদেহী মানুষ ছিলেন। সেই তুলনায় তাঁর হাত ছিল অত্যন্ত নরম ও উঞ্চ। আমি এখনো সেই অনুভূতি উপলব্ধি করি। এর পর জিজ্ঞাসা করলেন, কোন ডলার বড়, অষ্ট্রেলিয়ান ডলার না কি আমেরিকান ডলার। রুমের সবাই হো হো করে হেসে উঠলেন। দেশের অর্থনীতির ভিত মজবুত করতে, এমন উপস্থিত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অনেক। বিনিমযে দেশ পেয়েছে সহযোগিতার খোলা দরজা। 

আরেকটি ঘটনা। চীন ১৯৭১ সালে জাতিসংঘে ভেটো দেয়ার ক্ষমতা পায়। ক্ষমতা পাওয়ার পরই তারা আমাদের সদস্য পদ না পাওয়ার জন্য পাকিস্তানের পক্ষ হয়ে ভেটো দেয়। আঞ্চলিক রাজনীতিতে পাকিস্তানকে হাতে রাখা ছিল চীনের অন্যতম লক্ষ্য, এখনো আছে। পাকিস্তানকে খুশি করতে, জাতিসংঘের সদস্যপদ প্রদানের ক্ষেত্রে চীন ভেটো দেয়। ব্যস, সদস্যপদ লাভে ঝুলে যায় বাংলাদেশের আবেদন। বঙ্গবন্ধু বিষয়টি বুঝলেন। তিনি দুটো কাজ হাকডাক না বাজিয়ে করলেন। প্রথম, বাংলাদেশ তখন ভারত থেকে কয়লা আমদানী করতো। তখনো চীনের কাছ থেকে আমাদের স্বীকৃতি মেলেনি। ভারত থেকে কয়লা আমদানী করলে সস্তা হবে, তবে কখনো কখনো সময় মত আসে না এবং চীন থেকে আমদানী করলে দাম সামান্য বেশি পড়বে। সচিব তাই চীন থেকে আনা বাদ দিয়ে দিলেন। মাননীয় মন্ত্রী তাই ফাইলটি বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে গেলেন এবং বঙ্গবন্ধু সাথে সাথে অনুমোদন দিয়ে বল্লেন,“ ব্যবসা হলে সম্পর্ক ও হবে।” এর কিছুদিন আগে আমরা নয়াদিল্লীতে এসকাফ সম্মেলনে চৈনিক প্রতিনিধি দলের সাথে সাক্ষাৎ করি। এটাই ছিল বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ের সাক্ষাৎ। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানের সঙ্গে চিরায়ত দ্বন্দ্ব থাকা সত্বেও দেশের বৃহত্তর স্বার্থে বঙ্গবন্ধু সে দেশে অনুষ্ঠিত ও-আই-সি শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান করেন। যদিও প্রতিবেশী দেশ এতে একটু মনঃক্ষুন্ন হয়েছিল। এতে পাকিস্তান আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট হলো, আমাদের স্বীকৃতি দিলো। পরে স্বীকৃতি মিললো চীনের কাছ থেকেও। সে বছর আর জাতিসংঘে সদস্যপদ পাওয়ার ক্ষেত্রে চীনের কাছ থেকে আপত্তি আসেনি। বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য হয়ে গেলো। 

আরেকটি ঘটনা। ১৯৬৯ সাল। উত্তাল জন সমুদ্রের চাপে জেল থেকে মুক্ত হয়ে তিনি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের আর টি সি বা গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করেন। আমি তখন রাওয়ালপিন্ডির সেটেলাইট টাউনে থাকি।  বঙ্গবন্ধু আসছেন শুনে রাওয়ালপিন্ডির “ ইস্ট পাকিস্তান” হাউজে সারাক্ষণ উনার পাশে পাশে আছি। সেই সম্মেলনের এক পাশে বঙ্গবন্ধুর শখ, তিনি সাদ্দাদের বেহেশত দেখবেন!  অর্থ্যাৎ ঘুরে দেখবেন আইয়ব খানের ইসলামাবাদ শহর। তবে তিনি পাকিস্তানের সরকারি টিকটিকির গাড়ি দিয়ে যাবেন না। বঙ্গবন্ধু বললেন, মোমেন, আমি টিকটিকির গাড়িতে করে ইসলামাবাদ দেখতে যেতে পারবো না। তুমি গাড়ি ম্যানেজ করো। আমি দ্রুতগতিতে গাড়ি ম্যানেজ করলাম। কিন্তু তিনি নির্দেশ প্রদানের পরই ব্যস্ত হেয় গেলেন। এই মিটিং তো সেই সিটিং। তাঁর আর ব্যস্ততা শেষ হয় না। গাড়ি ম্যানেজের পর আমি তাঁর পেছন পেছন ঘুরি। ফাঁক পেলেই বলে উঠি, নেতা, যাবেন না কি? তার আর ব্যস্ততা শেষ হয় না। অবশেষে ঢাকায় ফিরে গেলেন। ইসলামাবাদ দেখা হলো না।

পিন্ডী থেকে ফিরে একদিন বত্রিশ নম্বরে গেছি। অনেকের সামনে ডেকে বললেন, মোমেন, এই দিকে এসো, বসো। এর পর সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, মোমেন আমারে ইসলামাবাদ দেখায়নি। তাঁর মেধ্য রসিকতাও ছিল প্রচুর। দেশের স্বার্থে এই রকম হাজারো ইচ্ছাকে জলাঞ্জলি দেয়ার ঘটনা আছে বঙ্গবন্ধুর সারাটা জীবন জুড়ে।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন দুরদর্শী শাসক। তাঁর অল্প কদিনের শাসনামালেই ঘুরে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশ। ভাগ্য আমাদের সঙ্গে ইতিবাচক আচরণ করেনি। ফলে পঁচাত্তরের আগস্টের মর্মান্তিক করুণ পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে। তবে, আশার কথা হলো, বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শন অনুসরণ করলে, বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে, কোনো বাধা ছাড়াই। 

চাক্ষুষ নানা অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, ইতিহাসের পাতা থেকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম মুছে ফেলার অনেক অপচেষ্টা হয়েছে এই রাষ্ট্রের জন্মলগ্ম থেকেই। তবে, সবংশে তাঁকে নির্মম হত্যার পরেও তিনি থেকে গেছেন বাঙালির হৃদয় ও মননের সমস্ত সত্তা জুড়ে। তাঁর এই অর্জন সম্ভব হয়েছে তাঁর সারা জীবনের ত্যাগের বিনিময়ে; সত্য ও ন্যায়ের জন্য তাঁর দৃঢ়চিত্ততা ও ত্যাগ; যে ত্যাগ ছিল বাংলা ও বাঙালির জন্য সর্বৈব নিবেদিত। স্বাধীনতা প্রাপ্তির চার বছর যেতে না যেতেই যারা হত্যা করতে  চেয়েছিল মুজিবকে, তাদের জানা ছিল না, পুরো বাংলা আর বাংলাদেশটাই ধারণ করে রয়েছে শেখ মুজিবের অবয়ব, তার অস্তিত্ব কখনও মুছে ফেলা সম্ভব নয়। বরঞ্চ দিন যত যাবে, বাংলা আর বাঙালির কাছে ততই মহান হয়ে উঠবেন তাদের প্রাণপুরুষ, সকল বিতর্ক উর্ধ্বে ঠেলে আজ তিনি মহান জাতিরজনক। বাংলার আত্মপরিচয়ের ঠিকানা জানার জন্য মুজিবকে বুকের ভেতর রাখাটা শুধু জরুরিই নয়, বিকল্পহীনও। 

লেখক-পররাষ্ট্রমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
 
আরকে//


 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি