ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

সুধা মূর্তি: সাদামাটা ও সরলতা তাকে করেছে অনন্য

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২০:৫৮, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ | আপডেট: ২১:১৮, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০

সুধা মূর্তি

সুধা মূর্তি

‘নারীদের আবেদন করার প্রয়োজন নেই’ টেলকো’র চাকরির বিজ্ঞাপনের নীচে লেখা ছিল এই কথামালা। দেখে আরও রাগ চড়ে গেল সুধা কুলকার্নির। ঠিক করলেন, এই চাকরিই করতে হবে। আবেদন তো করলেনই। সেইসঙ্গে স্বয়ং চিঠি লিখলেন জে আর ডি টাটাকে। জানতে চাইলেন, এই লিঙ্গ বৈষম্যের কারণ কী? নিরাশ হতে হলো না সুধাকে। উত্তরও এলো। ‘বিশেষ ইন্টারভিউ’র বন্দোবস্ত করা হলো সুধার জন্য। চাকরির জন্য মনোনীত হলেন তিনি। ডেভলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার হয়ে যোগ দিলেন ‘টেলকো’তে। তিনি সুধা মূর্তি। 

ভারতের বৃহত্তম অটোমোবাইল কারখানা টাটা প্রকৌশল ও লোকোমোটিভ কোম্পানিতে (টেলকো) নিয়োগকৃত প্রথম নারী কর্মী ছিলেন সুধা মুর্তি। টাটা ইঞ্জিনিয়ারিং। একজন ভারতীয় প্রকৌশল শিক্ষক এবং কন্নড় ও ইংরেজিতে ভারতীয় বিখ্যাত লেখক। তিনি ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘পদ্মশ্রী’তে ভূষিত হন।

তিনি দেখলেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে নারী তার স্বাধীনতা ও স্বীকৃতি হারাচ্ছে। নিজের যোগ্যতাগুলোকে কাজে লাগাতে পারছে না। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত এমনকি উচ্চবিত্ত নারীদেরও রেহাই নাই। তবে অনেক নারী নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন, তাঁর জন্য তাঁকে অনেক বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করতে হয়েছে। 

তিনি ইনফোসিস ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন এবং গেটস ফাউন্ডেশনের জনস্বাস্থ্য সেবা উদ্যোগেরও সদস্য। তিনি খুব সরল মনের মানুষ। সুধা মূর্তি মনে করেন- মানুষ সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে গেলেও তাঁর পা দুটি সব সময় মাটিতেই থাকে।

১৯৯৬ সালে তিনি ইনফোসিস ফাউন্ডেশন শুরু করেন এবং আজ পর্যন্ত তিনি ইনফোসিস ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি এবং ব্যাঙ্গালোর বিশ্ববিদ্যালয়ের পিজি সেন্টারে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে রয়েছেন। তিনি ক্রাইস্ট ইউনিভার্সিটিতেও শিক্ষকতা করেন। তিনি অনেক বই লিখেছেন এবং প্রকাশ করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে দুটি ভ্রমণকাহিনী, দুটি কারিগরি বই, ছয়টি উপন্যাস এবং তিনটি শিক্ষামূলক বই।

গ্রামীণ উন্নয়নের প্রচেষ্টায় অংশগ্রহণ করে বেশ কয়েকটি অনাথ আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। করেছেন কর্ণাটকের সমস্ত সরকারি স্কুলে কম্পিউটার ও লাইব্রেরির সুবিধা প্রদানের আন্দোলনকে সমর্থন এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ভারতের মূর্তি শাস্ত্রীয় গ্রন্থাগার’ প্রতিষ্ঠা। 

কর্ণাটকের সকল স্কুলের কম্পিউটার ও লাইব্রেরী সুবিধা চালু করার জন্য কম্পিউটার বিজ্ঞান শিখিয়ে মুর্তি একটি সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৯৫ সালে ব্যাঙ্গালোরের রোটারি ক্লাব থেকে তিনি ‘সেরা শিক্ষক পুরস্কার’ পান। মূর্তি তার সামাজিক কাজ এবং কন্নড় ও ইংরেজি সাহিত্যে তার অবদানের জন্য সর্বাধিক পরিচিত। তার ‘ডলার বহু’ একটি বিখ্যাত উপন্যাস। ২০০১ সালে জী টিভিতে এই উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে, একটি টেলিভিশন সিরিজ প্রদর্শিত হয়। মূর্তি মারাঠি চলচ্চিত্র পিতৃঋণ এবং কন্নড় চলচ্চিত্র প্রার্থনা-তে অভিনয়ও করেছেন।

জয় করে নেয়ার এই ধারা গোটা ছাত্রীজীবন ধরেই সঙ্গী ছিল মেধাবী সুধার। তাঁর বাবা আর এইচ কুলকার্নি ছিলেন সার্জন। মা বিমলা ছিলেন গৃহবধূ। সুধার জন্ম ১৯৫০ সালের ১৯ আগস্ট। সুধা মূর্তি বিয়ে করেন এন আর নারায়ণ মূর্তিকে, পুণেতে টেলকোতে প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত অবস্থায়। এই দম্পতির দুটি সন্তান আছে অক্ষতা এবং রোহান। তার মেয়ে অক্ষতা স্ট্যানফোর্ডের সহপাঠী, এক ব্রিটিশ ভারতীয়, ঋষি সুনাককে বিয়ে করেছিলেন। ঋষি যুক্তরাজ্যের দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত, হেজ-ফান্ডে তিনি একজন অংশীদার।

ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং-এ সুধা ছিলেন স্বর্ণপদকজয়ী। তিনি কম্পিউটার সায়েন্সে এম-ই করেন ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স থেকে। সেখানেও তিনি প্রথম। স্বর্ণপদক পেলেন ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স থেকে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময়েও তাঁর ব্যাচে সুধা ছিলেন একাই ছাত্রী। 

তবে সব নিয়ম মেনে নিয়েই সুধা মূর্তি কলেজে আসতেন। সুধা মূর্তি জানান, তাঁর স্বামী নারায়ণ মূর্তির সরল মনের জন্য তিনিও স্বামীর স্বভাবের প্রতি অনুপ্রাণিত হয়ে সরল জীবন যাপন করেন। তিনি ব্যাঙ্গালোর শহরে কয়েকশ টয়লেট এবং গ্রামীণ এলাকায় ১০ হাজার টয়লেট নির্মাণ করে গ্রামীণ এলাকায় সাহায্য করছেন।

সুধা মূর্তির নিজস্ব লাইব্রেরীতে ২০০০ এর বেশি বই রয়েছে। পুণায় টেলকোতে কাজ করার সময় বইপাগল সুধা বই নিতেন এক বন্ধুর কাছ থেকে। দেখতেন, প্রায় সব বইয়েই একজনের নাম লেখা, ‘নারায়ণ মূর্তি’। কৌতূহলী সুধা আলাপ করলেন নারায়ণের সঙ্গে। দুই জনেই বই পড়তে খুব ভালবাসতেন। বন্ধুত্ব জমতে দেরি হলো না। সুধার ভাল লাগত নারায়ণের সাদামাটা ভাব। তাঁদের বিয়ে হয়েছিল ১৯৭৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি। বেঙ্গালুরুতে মূর্তি পরিবারের বাড়িতে বসেছিল বিয়ের আসর। মোট খরচ ৮০০ টাকা। তার মধ্যে দু’জনেই যুগিয়েছিলেন ৪০০ টাকা করে। বিয়ে উপলক্ষে জীবনে প্রথম সিল্ক শাড়ি পেয়েছিলেন সুধা। এর মধ্যে ১৯৮১ সালে নারায়ণ মূর্তি জানালেন, তিনি আর চাকরি করবেন না। শুরু করবেন ব্যবসা। দু’জনের পারিবারিক দিক দিয়ে ব্যবসার কোনও ইতিহাস ছিল না। স্বামীর সিদ্ধান্তে প্রাথমিকভাবে তীব্র আপত্তি ছিল সুধার। 

পরে সেই আপত্তি দূরে সরিয়ে রেখে সুধা-ই হয়ে ওঠেন নারায়ণের উদ্যোগ ‘ইনফোসিস’র অন্যতম কাণ্ডারী। একদিকে, সুধা তখন ছোট্ট দুই সন্তানের মা। অন্যদিকে তিনি-ই ইনফোসিসের প্রোগ্রামার, স্বামীর সেক্রেটারি, অফিসের রাঁধুনি ও কেরানী। তার আগেই স্বামীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন সঞ্চিত অর্থও। ইনফোসিস’র জন্য তিনি অন্য সংস্থায় চাকরিও করতেন। 

কিন্তু কিছুদিন এভাবে চলার পরেই সুধা আর তথ্য প্রযুক্তি সংস্থা ইনফোসিস-এর সঙ্গে থাকলেন না। কারণ, নারায়ণ মূর্তি জানালেন, তিনি চান না ইনফোসিসে স্বামী স্ত্রী দু’জনে নিযুক্ত থাকুক। সুধা থাকতে চাইলে তিনি সানন্দে সরে দাঁড়াবেন। ১৯৯৬ সালে তৈরি এই সংস্থার সমাজসেবার বিস্তৃত শাখায় ব্রতী। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীদের স্বনির্ভরতা, জনস্বাস্থ্য-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেবার অগ্রণী ভূমিকা এই সংস্থার। 
ভারতীয় শিল্পপতিদের মধ্যে‌ অন্যতম নারায়ণ মূর্তি। সাম্প্রতিক নথি অনুযায়ী, তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় আড়াইশো কোটি ডলার। কিন্তু সবকিছুর পরেও মূর্তি দম্পতি বিশ্বাস সাধারণ জীবনযাপনে। বাকি শিল্পপতিদের ঘরনির মতো মহার্ঘ্য সাজপোশাক তো দূরে থাক, গত প্রায় দু’দশকের বেশি সময় হল, সুধা মূর্তি কোনও শাড়িই কেনেননি।

এমএস/এনএস/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি