ঢাকা, বুধবার   ১৪ মে ২০২৫

অদ্ভুত উটের পিঠে চলছে স্বদেশ

সাব্বির আহমেদ

প্রকাশিত : ১৪:২৪, ৫ মে ২০২০ | আপডেট: ১৪:২৫, ৫ মে ২০২০

সাব্বির আহমেদ

সাব্বির আহমেদ

Ekushey Television Ltd.

বেশ কয়েকটি দেশ এ পর্যন্ত লকডাউন শিথিল করেছে; অফিস, আদালত, কারখানা, রেস্টুরেন্ট, দোকানপাট কিছু কিছু খুলেছে। যারা লকডাউন শিথিল করেছে তারা প্রত্যেকেই তা করেছে নিজ নিজ দেশে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করার পর। কেউ কেউ করেছে নতুন করোনা আক্রান্ত প্রায় বন্ধ হওয়ার পর (চীন, ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড)। অন্য কয়েকটি দেশ করেছে আক্রান্তের সংখ্যা চূড়ান্তে পৌঁছানোর পর (ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, ইত্যাদি)। চূড়ান্তে পৌঁছানোর পর মানে হচ্ছে যখন তাদের একদিনে আক্রান্ত সর্বোচ্চ হয়েছিল তার পরেও তারা বেশ কয়েকদিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছে। যখন তারা দেখেছে যে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন আসলেই কমছে তখন তারা ধীরে ধীরে একটা একটা করে বিধিনিষেধ তুলে দিয়েছে। বাংলাদেশ উল্টো। এখানে যখন দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা বেশ ভালভাবে বাড়তে শুরু করল তখন বাংলাদেশ দুই ধাপে লকডাউন নিয়ম প্রায় তুলে দিয়েছে।

জানুয়ারি মাস থেকে পাওয়া করোনায় আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যাগুলো ইন্টারনেটে পাওয়া যাচ্ছে। সে সংখ্যাগুলো দিয়ে একেকটা দেশে আক্রান্ত হবার ট্রেন্ড এবং আমাদের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ থেকে জানা যায় মে মাসের মধ্যে বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত হবে ৫০ হাজার থেকে ১ লক্ষ মানুষ। মৃত্যুও বাড়বে আনুপাতিক হারে। এইসব ধারণা করা হয়েছিল লকডাউন পরিস্থিতি কঠোর থাকা অবস্থায়। এখন ঢাকার রাস্তায় জ্যাম ফিরে আসতে শুরু করেছে, দোকানপাট খুললেই মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়বে ঈদের কেনাকাটা করতে। তখন অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা কেউ জানে না।

বলা হয়েছিল করোনা স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানায় কাজ করতে হবে। সবাই জানে, এদেশে কেউ নিয়ম-নীতি মানে না। সেটা জেনেও সেই নিয়মনীতির আড়ালে কারখানা খুলে দেয়া হল। যথারীতি কেউ স্বাস্থ্যবিধি মানল না। আসলে নিয়মনীতি মানার ব্যাপারটা ছিল কথার কথা। লক্ষ লক্ষ মানুষ পেটের দায়ে, চাকরি বাঁচানোর জন্য কারখানায় যাওয়া শুরু করল। মানুষের মেলামেশা বাড়ল। করোনা আক্রান্ত বাড়তে থাকল। এখন দিনে ৬/৭শ আক্রান্ত হচ্ছে অন্যান্য দেশের ট্রেন্ডের মতই বাংলাদেশ পরিস্থিতি এগিয়ে যাচ্ছে। সেটা ঠিক থাকলে সামনের দিনগুলোতে দিনে হাজার, দুই হাজার, তিন হাজার করে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকবে।

সরকার ঘোষণা করল সাধারণ ছুটি। ছুটিতে থাকলে কারো বেতন কাটা যায়? এখানে তাও করা হচ্ছে। গতকাল কারখানা মালিকেরা শ্রমমন্ত্রীর (অতীতের বিখ্যাত শ্রমিক নেত্রী) সঙ্গে বৈঠক করে শ্রমিকদের কারখানায় অনুপস্থিত থাকার অজুহাতে এপ্রিল মাসের বেতনের ৬৫% দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এপ্রিল মাসের বেতনের ৬০% দেয়া হবে মে মাসে আর বাকি ৫% পরবর্তীতে। ছুটির জন্য বেতন কাটার উদাহরণ দুনিয়ায় আর কোথাও কেউ শুনেছি কি-না জানিনা। নগদ অর্থের অভাবে কারখানা শ্রমিকদের বেতন দিতে যাতে অসুবিধা না হয় তার জন্য সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দিল নামমাত্র সুদে। ঋণের সুদ স্থগিত করল। রফতানিকারকদের দিল আরও অনেক রকম সুবিধা। এসবে লাভটা কি হল? কার জন্য সরকার প্রণোদনা দিল?

চাল চুরির সময়োপযোগী এবং বেশ ভাল বিচার হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়েছে চাল চুরি। বিচার হচ্ছে না মাস্ক, পিপিই চুরির। উল্টো যারা ওসবের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন তাদের ওসডি করে বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছে। তাদের ভাগ্যে কি আছে তা কেউ বলতে পারে না। নিম্ন মানের পিপিই সরবরাহ করার ফলে করোনা আক্রান্ত হয়েছে কয়কশ ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্য কর্মীরা। এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে দুই জন ডাক্তারের। নিরাপত্তা আতঙ্কে ভুগেছে কয়েক লক্ষ চিকিৎসা যোদ্ধা পরিবার। মাস্ক, পিপিই’র মান নিয়ে যখন প্রশ্ন ওঠে তখন ব্যাক্তিগত পরিসরে দেখেছি পরিবার গুলো কি পরিমাণ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। অনেকেই সরকারের দেয়া জিনিস না পরে নিজের খরচে তা জোগাড় করে পাবলিকের ডিউটি করেছে। আমার বৃহত্তর পরিবারেই রয়েছে এমন চিকিৎসক। স্বাস্থ্যকর্মী হাসপাতালে গেছে দিনরাত আতঙ্কে কেটেছে পরিবারের সদস্যদের। করোনাযুদ্ধের প্রথম সারির যোদ্ধাদের নিরাপত্তা নিয়ে এমন জোচ্চুরি যারা করল। তাদের কিছুই হল না।

করোনায় আক্রান্ত হয়ে ডাক্তারের মৃত্যু হলে গণমাধ্যমে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আওয়াজ হয়। পুলিশ মরলে কিছুই হয় না। জান-প্রাণ দিয়ে পথে পথে মানুষদের লকডাউন বোঝাতে গিয়ে এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্তের খবরে হয়েছে ৯৫৩ জন পুলিশ সদস্য। মরে গেছে ৫ জন। স্বাস্থ্যকর্মিদের মত এরাও করোনা যোদ্ধা। করোনায় মৃত পুলিশ সদস্যদের ছবি, সংবাদ গণমাধ্যমে আসলে, সামাজিক মাধ্যমে আলোচনা হলে তাদের পরিবারগুলো অন্তত দেশের মানুষের সমবেদনা অনুভব করার সুযোগ পেত, কিছুটা শান্তনা পেত। এ পর্যন্ত সরকারের যতগুলো টিম করোনা মোকাবেলায় কাজ করছে তাদের মধ্যে পুলিশের ভূমিকা সবচেয়ে উজ্জ্বল। তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের কোন অভিযোগ নেই। তারা পাড়ায় পাড়ায় গিটার বাজিয়ে, গান গেয়ে সাধারণ মানুষকে আনন্দ দিয়েছে, উজ্জীবিত করেছে। এরা মূলত সরকারের খামখেয়ালী সিদ্ধান্তের শিকার। লকডাউন কেনই বা দেয়া হল, কেনই বা তা আবার ব্যাপকভাবে শিথিল করা হল, কেনই বা এই মানুষগুলো রাস্তায় রাস্তায় নাদান পাবলিকরে লকডাউন বোঝাতে গিয়ে জান দিল। সবকিছুই এখন অনর্থক মনে হচ্ছে।

ডাক্তারদের অনাচার করোনা হাসপাতালে কিছু কমছে বলে ধারণা হচ্ছে। মৃত্যুর সংখ্যা কমেছে সেখানে। বেড়েছে মৃতের তুলনায় সুস্থ হওয়া রোগীর সংখ্যা। এখনও চিকিৎসা পাচ্ছে না সর্দি-কাশি-জ্বরের উপসর্গ থাকা রোগীরা। গতকাল এরকম দুটি ঘটনা এসেছে আজকের ডেইলি স্টারে। একটা কম বয়স্ক ছেলেতো হাসপাতালের গেটে অপেক্ষা করতে করতে মরেই গেল। জবাবদিহি করার কেউ নেই। করোনাকালের প্রায় দুই মাস অতিবাহিত হয়ে গেলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত সর্দি-কাশি-জ্বরের উপসর্গ থাকা রোগীদের চিকিৎসার ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারল না। হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে মানুষ মরছে। এদের কথা শোনার কেউ নেই। চিকিৎসা না পেয়ে মরে যাওয়া মানুষের কষ্টের কথা, তাদের পরিবারের কান্না প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছায় না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন এক রকম সরকার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে আরেক রকম। প্রশাসনের দুর্নীতি, আর সমন্বয়হীনতার জন্য সিদ্ধান্ত যা নেয়া হচ্ছে তাও ঠিকমত বাস্তবায়ন হচ্ছে না। করোনা পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে এবং যাবে তা বিশেষজ্ঞদের মতামতের পরেও অনুধাবন করতে ব্যর্থ হচ্ছে সরকার। এই যে সব উল্টাপাল্টা কর্মকাণ্ড হচ্ছে তার কারণ কি? কারণ বোধ হয় একটাই – করোনার ভয়াবহতা বুঝতে ব্যর্থ হয়ে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা। দেড় মাসের বেশি সময় ধরে সবকিছু বন্ধ থাকায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যবসায়ীরা নয়; দিন এনে দিন খাওয়া জনগণ। তাদের অনেকের কাছে এখন পর্যন্ত ত্রাণ পৌঁছায়নি। যারা পেয়েছেন তারাও পেয়েছেন অপর্যাপ্ত। দেড় মাস আগে এদের নগদ সহায়তা দেবার কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত তা দেয়া যায়নি। 

এখন বলা হচ্ছে ঈদের আগে ৫০ লক্ষ পরিবারকে ২,৪০০ করে টাকা দেয়া হবে। যা মোটেই যথেষ্ট নয়। কাজ হারিয়েছে ৫ কোটির বেশি মানুষ। অন্তত ১.৫ কোটি পরিবারকে নগদ সহায়তা দেয়া দরকার। যে পরিবার মাসে ২০,০০০ টাকা আয় করত যাদের কোন সঞ্চয় নেই যারা দুই মাস ধরে আয় করতে পারছে না সেসব পরিবারের ২,৪০০ টাকা দিয়ে কি হবে? এই মানুষগুলোকে পর্যাপ্ত পরিমাণ নগদ সহায়তা দিতে পারলে করোনা ঝুঁকি না বাড়িয়েই শক্তিশালী থাকত কৃষক তথা মূল অর্থনীতি।

প্রায় এক লক্ষ কোটি টাকার প্রণোদনার প্রায় পুরোটাই মাঝারি এবং বড় ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিচ্ছে। ছোট ব্যবসায়ীদের হিসেব-নিকেশ, একাউন্টিং সিস্টেম ঠিক থাকে না। এটা সবাই জানে। তারপরও বাংলাদেশ ব্যাংক এমন নিয়ম করেছে যে ছোট ব্যবসায়ীরা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের উদ্যোগক্তারা সরকারের প্রণোদনার সুবিধা নিতে পারছে না। রাস্তার ধারে না খেয়ে থাকা মানুষের লাইন দিন দিন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। রফতানীমুখি শিল্পের শ্রমিকদের বেতন ও মজুরীর জন্য বাড়তি ৫,০০০ কোটি টাকা দেওয়া হল। সেই শ্রমিকদের এখন সরকার ঘোষিত ছুটির জরিমানা দিয়ে বেতন পাবে ৬০%। শ্রমিক যদি ঠিক মত বেতনই না পায় তাহলে কার জন্য প্রণোদনা? মালিকের জন্য? করোনার অজুহাতে জনগণের করের পয়সা গুটিকয় ব্যবসায়ীর পকেটে গুঁজে দেয়াই কি এই প্রণোদনার উদ্দেশ্য? এসব প্রশ্নের উত্তর নেই।

সামাজিক ক্ষতি কমানোর সময় এখনও আছে। অফিস, আদালত, কারখানা, দোকানপাট খুলে দিয়ে যে ভয়াবহ ঝুঁকি নেয়া হয়েছে তাতে সামনের দিনগুলোতে ব্যাপকভাবে করোনা ছড়িয়ে পড়ার, মৃত্যুর সম্ভবনা দেখে আতংকিত হয়ে পড়েছে দেশবাসী। সিঙ্গাপুর একবার লকডাউন শিথিল করে বিপদ বাড়িয়েছে। তাদের আবার দ্বিতীয় দফা লকডাউন কঠোর করতে হয়েছে। ভুল করা অপরাধ নয়। ভুল স্বীকার না করা, ভুল সংশোধন না করা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। সবকিছু আবার বন্ধ করা দরকার। ঈদ বাণিজ্যের চেয়ে, রফতানি অর্থের চেয়ে মানুষের জীবন অনেক বড়। এখনই ভুল সংশোধন করা না হলে সামনে আর সুযোগ পাওয়া যাবে না। সামাজিক অসন্তোষ চরমে পৌঁছাতে পারে। অরাজকতা সৃষ্টি বা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। তা থেকে ফায়দা নেবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা। কেঁপে উঠবে সরকার। বাংলাদেশপন্থী এই সরকারটা জনগণের খুব দরকার।

লেখকঃ চার্টার্ড একাউন্টেন্ট (এফসিএ) এবং লিড কনসালট্যান্ট ও চেয়ারম্যান, ঢাকা কনসাল্টিং লিমিটেড। 

এমবি//


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি