ঢাকা, মঙ্গলবার   ১৩ মে ২০২৫

‘আমার মা কিছু করে না’

আরিফা সুলতানা

প্রকাশিত : ১৩:৪৫, ২৬ জুন ২০২২

Ekushey Television Ltd.

এদেশে বেশিরভাগ পরিবারের পুরুষ সদস্যরা অর্থ উপার্জনের জন্য তাদের শ্রমশক্তি বাহিরের কাজে ব্যয় করেন। অর্থাৎ তারা সরাসরি অর্থ উপার্জনের কাজে নিয়োজিত। সেখানে তারা বাড়তি কাজ (ওভার টাইমের) অর্থও হাতে হাতে পান। 

বাইরে যে কর্মজীবী নারীরা আছেন তাদের ক্ষেত্রেও একই হিসাব প্রযোজ্য (অনেক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ বেতন বৈষম্য থাকলেও)। 

বিপরীতে যে নারী ২৪X৭ 'সংসারে' কাজ করছে, তার মাসিক বা বাৎসরিক উপার্জন জাতীয় আয়ে ও আমাদের মস্তিষ্কে কতটুকু যোগ হচ্ছে? 

সময়ের ব্যবহার নিয়ে ২০২২ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ সমীক্ষায় দেখা যায়, নারীরা গড়ে ১১ দশমিক ৬ ঘণ্টা এসব কাজে ব্যয় করেন। অন্যদিকে পুরুষেরা সংসারের কাজে ব্যয় করেন মাত্র ১ দশমিক ৬ ঘণ্টা। 

এছাড়া বিশ্বের মোট উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে নারীর গৃহকর্ম থেকে ১০ থেকে ৩৫ শতাংশ উৎপাদিত হয় । যার জন্য তারা আলাদা কোনো অর্থ পায় না। এ হিসাবে বিশ্ব অর্থনীতি থেকে প্রতি বছর ১৬ ট্রিলিয়ন ডলারের হিসাব হারিয়ে যাচ্ছে; যা গণনা করা হচ্ছে না (২০১৯ এর জাতিসংঘের সংশোধিত আয়ের হিসেব)।  

নারীর কাজের অর্থনৈতিক স্বীকৃতি না থাকায় তাদের উৎপাদনশীল শক্তি হিসবে গণ্য করা হচ্ছে না। শহুরে শ্রমজীবী-কর্মজীবী নারীর বাইরেও কৃষি, বনায়ন, মাছ চাষ, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালনের মতো উৎপাদনশীল কাজে নিয়োজিত দুই কোটির বেশি নারীর কাজের অর্থমূল্য একই রকম প্রায় হিসেব ছাড়া। 

অক্সফামের এক গবেষণা (২০১৯) বলছে, এশিয়া অঞ্চলে ব্যাপক পরিসরে ধান চাষের ক্ষেত্রে শ্রমের শতকরা ৫০ ভাগের বেশি কাজ করেন নারীরাই। তাদের পরিশ্রম করতে হয় হাড়ভাঙা, অথচ একই কাজের জন্য পারিশ্রমিক পান পুরুষের চেয়ে অর্ধেক। সামান্য পারিশ্রমিক যা তারা পান, তাও প্রায় সবই পরিবারের জন্য ব্যয় করেন। ফলে বিশ্বের গ্রামাঞ্চলে ৫০ কোটি নারী দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেন। 

অক্সফামের অন্য একটি গবেষণায় দেখা যায়, ধান উৎপাদনে প্রয়োজনীয় ২২টি কাজের মধ্যে ১৭টিই করেন নারীরা। অথচ বাংলাদেশে জমির মালিকানার ক্ষেত্রে নারীদের হার পুরুষের ৫ ভাগের ১ ভাগ। যে কারণে বেশি পরিশ্রম করেও সমাজে নারীরা আগের মতোই দরিদ্র এবং ক্ষমতাহীন থেকে যাচ্ছেন এবং সংসারেও ক্ষমতা বা মর্যাদার দিক থেকে অধীনস্থ থাকছেন। 

এই আর্থিক হিসাবের বাইরে সমাজে প্রতিষ্ঠিত পুরুষতান্ত্রিক (নারী-পুরুষ উভয়েই) চিন্তায় নারীর কাজের মূল্যায়ণ এমন- ‘সারাদিন ঘরে বসে কি কাজ করো! বাইরে যেয়ে দুই টাকা ইনকাম করে তারপর দেখ কেমন কষ্ট’; ‘স্বামীর ঘাড়ে বসে না থেকে নিজে উপার্জন করে চলো’; ‘আমার আত্মসম্মান আছে, নিজের উপার্জন করা টাকায় চলি’ (ঘরে যে নারীর শ্রম শোষণ করা হচ্ছে, তিনি আত্মসম্মানহীন!)।  

কিন্তু সমাজে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকা মানুষগুলো কখনই এসব প্রশ্নে যান না- পরিবার আর সমাজের কি কি ধরনের তাপ ও চাপের ফলে দেশে বাল্যবিবাহ বাড়ছে? বিয়ের পর পড়াশোনার সুযোগ বঞ্চিত হচ্ছে কতজন নারী? পড়াশোনা সম্পন্ন করলেও বাইরের কাজে পরিবারের বাধার মুখে পড়ছেন কত নারী? সংসারের কাজে বেশি সময় দেওয়ার কারণে শ্রমবাজারে প্রবেশ করতে ব্যার্থ হচ্ছেন কত শতজন? এছাড়া বাচ্চা ছোট হওয়ায় এবং বাচ্চার দায়িত্ব মূলত মায়ের কাঁধে পড়ায় শ্রমবাজারে নারীর প্রবেশ ও পুনঃপ্রবেশের ক্ষেত্রে কতটা প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়? 

অতঃপর এতো এতো প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে যে পরিবারে নারীরা বাইরে কর্মরত আছেন, সেখানে পুরুষ সদস্যরা সংসার-সন্তান লালন-পালন ও বয়স্কদের দেখভালের দায়িত্ব কতখানি পালন করেন এবং নারীরা কত পরিমাণ করেন? এছাড়াও যে পরিবার শুধুমাত্র নারীর উপার্জিত অর্থে লালিত-পালিত হয়, সেখানেও বা পুরুষ সদস্য সংসারের দায়িত্ব কতটুকু পালন করেন? শ্রম বাজারে, সমাজে বা পরিবারের মনস্তত্ত্বে নারীর শ্রম সবসময়ই 'সস্তা বা মূল্যহীন' কেন? সর্বোপরি পরিবারের কাজের দায়িত্ব মূলত এবং মূলত নারীর কেন? নারী কি জেনেটিক্যালি ঘরের কাজ শিখে জন্মায়?

প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তর তো জানা...

তাই আমরা কোনো প্রশ্ন তুলব না। আমরা বলব না, পুরুষের সুবিধা অনুযায়ী সাজানো এই সমাজের ফাঁদে পা দিয়ে মেয়ে তুমি নিজের অস্তিত্বের প্রশ্ন তোলো। তোমার জীবনের পরিপূর্ণতা শুধু ‘মহিমান্বিত মা' বা 'সফল পুরুষের' স্ত্রী  হওয়ার মধ্যে দিয়ে নয়। আমাদের মেয়ে সন্তানকে এতো পরিশ্রম করে পড়ালেখা শিখিয়ে বড় করা হচ্ছে, মূল্যহীন শ্রমিক হওয়ার জন্য নয়। পরিবার শুধুমাত্র নারীর নয়, কাজ একমাত্র তার নয়। 

আমরা শুধু পুরুষতন্ত্রের মস্তিষ্কপ্রসূত কথাগুলো পুনরাবৃত্তি করব- ‘মেয়েরা হলো পানির মতো, যেই পাত্রে রাখে সেই পাত্রের আকার ধারণ করে। তাই তাদের যথাসময়ে পাত্রস্থ করতে হয়’। ‘মেয়েরা জন্মের পর বাবা, ভাই আর পরে স্বামী-ছেলে সন্তানের ঘাড়ে বসে খায়’।‘যে নারী সংসারে শ্রম দেয় এবং সরাসরি অর্থ উপার্জন করে না সেই নারীর জীবন পরজীবী ছত্রাকের সমতুল্য’। 
এ কারণে পরিবারের সদস্য বলে, 'বাড়ির বউ' তো গৃহিণী, কিছুই করে না। আমাদের সন্তানরাও এসব দেখে আর ছোটবেলা থেকে বলতে শেখে, আমার মা কিছু করে না!

এএইচএস/এমএম
 


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি