ঢাকা, রবিবার   ১৩ অক্টোবর ২০২৪

খান কিচেন : সাধ্যের মধ্যে স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের ফেরিওয়ালা

প্রকাশিত : ১৬:২৩, ১২ নভেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ১৭:১৮, ২১ নভেম্বর ২০১৭

‘‘আমার স্বামী চাকরিজীবী। আমিও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। সকাল হলেই দু’জনের তাড়া থাকে অফিসের। ইচ্ছা হয় সকালে একটু স্বাস্থ্যসম্মত খাবার তৈরি করি নিজেদের জন্য। কিন্তু অফিস সময় মেনে চলার জন্য তা আর সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই হাতের কাছের কোনো রেষ্টুরেন্টে পরাটা কিংবা রুটি দিয়েই সকালের নাস্তাটা সারি। দুপুরেও বাইরের খাবার খেতে হয়। জানি বাহিরের খাবার স্বাস্থসম্মত নয়, তারপরও কোনো উপায় নেই।’’— কথাগুলো বলছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী নুপুর আক্তার (ছদ্ম নাম)।

আশ্চর্য হলেও সত্য নুপুর আক্তারের এ কথাগুলো দারুণ এক ধারণা এনে দেয় আফরোজা খান-এর মাথায়। যে ধারণা থেকে আফরোজা খান এখন ‘খান কিচেন’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। প্রতিদিন যেখানে রান্না হচ্ছে লাখো মানুষের খাবার। যেখানে কর্মসংস্থান হচ্ছে চার হাজার মানুষের। রাজধানীর নতুন বাজারের পূর্ব পাশে বেরাইদ এলাকায় ১৫ বিঘা জমির উপর নিজ উদ্যোগে রান্নাঘরটি প্রতিষ্ঠা করছেন তিনি। এটি দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় রান্নাঘর বলে দাবি করেন তিনি।

নারী উদ্যোক্তা আফরোজা খান একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে ‘খান কিচেন’প্রতিষ্ঠার শুরুর কথা জানাতে গিয়ে বলেন, ‘বেশ কয়েক বছর আগে আমি আমার এক পরিচিত জনকে (নুপুর আক্তার) অফিসে দুপুরের খাবার খেতে দেখি। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, কি খাচ্ছেন? কি দিয়ে খাচ্ছেন? জবাবে নূপুর আক্তার আমাকে বলেছিলেন, ‘আপা এটা হোটেল থেকে আনা খাবার। দেখেন কেমন তেল ভাসছে। আমারও মনে হয়, এ খাবার খেলে বেশিদিন হয়তো বা বাঁচবো না। বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে হয়তো অল্প বয়সেই বিছানায় পড়ে যাব। কিন্তু কি করবো? বাসায় সকালে খাবার তৈরির সময় পায় না। তাই ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও নিরুপায় হয়ে স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি নিয়ে এসব খাবার খেতে হয়।’’

আফরোজা খান বলেন, ‘‘সেদিন নূপুরের সেই কথায় আমার খুবই কষ্ট লেগেছিল। সেই কষ্ট থেকে দারুণ একটা ধারণাও মাথায় এসেছিল। যে ধারণা থেকেই আমি আজ ‘খান কিচেন’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। আমার লক্ষ্য উদ্দেশ্য একটাই, তা হলো, ব্যস্তময় নগর জীবনে সাধ ও সাধ্যের মধ্যে স্বাস্থ্যসম্মত দেশি খাবার নিশ্চিত করা। কারণ, ঢাকায় বসবাসরত বেশিরভাগ মানুষই চাকরিজীবী। এ নগরীতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে সাড়ে ৪৪ হাজার লোক বসবাস করেন, যাদের অধিকাংশই মধ্যবিত্ত কর্মজীবী। যাদের অধিকাংশ মানুষ ভোগেন পেটের পীড়ায়। এর অন্যতম কারণ অস্বাস্থ্যকর খাবার।’’

‘‘যারা বাহিরের কোনো হোটেলে দুপুরের খাবার খাই, সেই খাবারগুলো কতটা স্বাস্থ্যসম্মত তা যাচাইয়ের ফুরসত থাকে না। আর হোটেল বা বাহিরের সেই খাবারগুলোর স্বাস্থ্যঝুঁকি যেমন থেকে যায়, তেমন দামও অপেক্ষাকৃত বেশি হয়। আবার অফিস ছেড়ে হোটেলে বা বাহিরে গিয়ে খাবার খেতেও অনেক সময় নষ্ট হয় চাকরিজীবিদের। তাই সাধ, সাধ্য, স্বাস্থ্য আর সময়ের বিষয় মাথায় রেখে আমি ‘খান কিচেন’প্রতিষ্ঠা করেছি। যেন নগরবাসীকে অন্তত দুপুরে  স্বাস্থ্যঝুঁকির খাবার না খেতে হয়। পুষ্টিসম্মত দেশি গরম খাবার খেয়ে যেন তাদের স্বাস্থ্যের দিকটা ঠিক থাকে। তাই অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তি ব্যবহার করে গড়ে তোলা হয়েছে লক্ষাধিক মানুষের রান্নাযজ্ঞ খাবার প্রস্তুত প্রতিষ্ঠান খান কিচেন।’’

বিশ্বের আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি ব্যবহার করে মানুষের হাতের স্পর্শ ছাড়াই ‘খান কিচেন’ এ লাখো মানুষের জন্য রান্না হচ্ছে খাবার।

আফরোজা খান বলেন, ‘‘এখানে প্রতিদিন লক্ষাধিক মানুষের খাবার রান্না হবে। হাতের স্পর্শ ছাড়া মেশিনে হবে কাজ। কর্মজীবীদের কাছে ‘খান কিচেন’ ঘরের গরম খাবারের স্বাদের অভাব ঘোচাবে বলে আমরা আশাবাদী। আমরা মতিঝিল, বনানী, ফার্মগেট এলাকার বিভিন্ন হোটেল, খাবার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এবং কর্মজীবী মানুষের উপর জরিপ করেছি। এরপর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মেগা কিচেন দেখে এবং রিসার্চ করে নিজেদের পরিকল্পনা এবং চাহিদামতো মেশিন এনেছি। ছয় মাস পরীক্ষামূলক চালিয়েছি। মানুষের খুব ভালো সাড়া পেয়েছি। আমাদের খাবার এখন বারিধারা, গুলশান এলাকায় সরবরাহ করা হচ্ছে। পরে পুরো ঢাকায় শুরু করব। বর্তমানে ২০ হাজারের কাছাকাছি অর্ডার পাচ্ছি।’’

‘খান কিচেন’র নির্বাহী পরিচালক আলিফ খান একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে বলেন, ‘‘জার্মান প্রযুক্তি ব্যবহার করে এশিয়ার বৃহৎ খাবার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান গড়েছি আমরা। উৎপাদন পদ্ধতিতে আমরাই প্রথম ব্যবহার করছি বিশ্বে খাবার ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের সর্বাধুনিক পদ্ধতি ফোরজি (ফোর্থ জেনারেশন) হাই এফিসিয়েন্সি ক্লাসিফায়ার প্রযুক্তি। এছাড়া আমরা নিশ্চিত করেছি স্টিম ইনজেকশন সিস্টেম, অ্যাপেক্সি ফ্লোর এবং ইলেকট্রিক পদ্ধতিতে পরিবেশবান্ধব খাবার। আর এ খাবার তৈরিতে আমাদের সঙ্গে আছেন বিশ্ববিখ্যাত রন্ধনশিল্পী টনি খান।’’

স্বাদের ব্যাপারে ‘খান কিচেন’র শেফ টনি খান বলেন, ‘‘মানুষকে তো মেশিন দেখিয়ে খাওয়ানো যাবে না। খাবারে যেন মায়ের হাতের স্বাদ থাকে এবং তেল, লবণ আর মসলার পরিমাণ যেন স্বাস্থ্যসম্মত থাকে। এসব বিষয়ে সচেতন থেকে আমরা খাবার তৈরি করছি। আর খাবারের মেন্যুতে স্যুপ, ডাল, শাক-সবজি, মাছ, মাংস এবং মিষ্টান্নও থাকছে। এছাড়া উৎসব বা সময় বুঝে বিশেষ খাবারের ব্যবস্থাও করা হয়। একজন মানুষের প্রতিদিন যে পরিমাণ খাবারের প্রয়োজন এক বেলাতে তার সবটুকুই আছে আমাদের মেন্যুতে। এছাড়া স্পেশাল খাবারের ব্যবস্থাও আছে।

এই রান্নাঘরে ঢোকার আগে বাইরে জুতা খুলে আলাদা জুতা পরতে হয়। বাইরের পোশাক পাল্টে প্রতিটি বিভাগের কর্মীদের পরতে হয় রান্নাঘরে প্রবেশের জন্য নির্ধারিত পোশাক। রান্না ঘরে ব্যবহার করা হয়েছে সবুজ রঙের অ্যাপোক্সি ফ্লোর। টাইলসের মেঝেতে ময়লা জমার সুযোগ থাকে কিন্তু এই মেঝেতে ব্যাকটেরিয়া নিঁখুতভাবে পরিষ্কার করা যায়। এখানে রাইস স্টিমার মেশিনে আধা ঘণ্টায় ৩৮০ কেজি চাল থেকে ভাত রান্না হয়। এরকম ১০টি মেশিনে রান্না হয় ভাত। আরও কয়েকটি মেশিন রয়েছে সংযোজনের অপেক্ষায়। আছে চাল ধোয়া, সবজির খোসা ছাড়ানো, প্রয়োজন মতো কাটা এবং মসলা পেস্ট করার, মাছ কাটা ও মাংস কাটার মেশিনও।

ভোজন রসিকদের সুবিধার্থে খান’স কিচেন ব্যবহার করছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে বানানো বাক্স, যা বাইরের আর্দ্রতা থেকে খাবারকে সুরক্ষিত ও টাটকা রাখতে সহায়ক। ফলে খাবার গরম থাকবে ছয় ঘণ্টারও বেশি সময়। সর্বোচ্চ মানের কাঁচামাল, উৎপাদনের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি, কম্পিউটারাইজড ল্যাবরেটরি, নিজস্ব প্যাকেজিং ইউনিটের আধুনিক ব্যবহার নিশ্চিত করে শতভাগ গুণগতমান বজায় রাখতে চান সংশ্লিষ্টরা।

রান্নাঘর কয়েকটি নিরাপদ জোনে ভাগ করা হয়েছে। কাঁচা দ্রব্য মজুদের স্থান ও কিচেনে প্রবেশ থেকে শুরু করেই প্রতিটি পর্যায়ে রয়েছে সুরক্ষিত পদ্ধতি। রান্নার পর তার স্বাদ ও মান পরীক্ষার জন্য রয়েছে অটোমেটিক মেশিন। নির্ধারিত তাপমাত্রা আনার পর তা অটোমেটিকভাবে বক্সে ভরে সরবরাহের জন্য সংরক্ষণে রাখা হয়।

‘খান কিচেন’ নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থার মাধ্যমে গ্রাহকদের চাহিদা অনুসারে খাবার পৌঁছে দিচ্ছে। খাবারের দামও নাগালের মধ্যে। আমাদের দুই ধরণের খাবার আছে। প্রিমিয়াম মেন্যু ও এক্সিকিউটিভ মেন্যু।

প্রিমিয়াম মেন্যুতে আছে স্টিম রাইস, ভেজিটেবল স্যুপ, মুরগি অথবা মাছ, সবজি এবং মিষ্টান্ন। মাছ এবং মাংসের বিভিন্ন ধরনের ডিশ থাকে এই মেন্যুতে। দাম পড়বে ১৩৫ টাকা। আর এক্সিকিউটিভ মেন্যুতে আছে ভাত, মুরগি ভুনা অথবা মাছ, ডাল, সবজি বা ভাজি। এর দাম পড়বে ৯৫ টাকা। বিভিন্ন দিন বিভিন্ন ধরনের মেন্যু থাকে। বিকাল ৫টার মধ্যে ১৬৫২০ নম্বরে ফোন করলেই গ্রাহকের কাছে পৌঁছে যাবে দুপুরের খাবার। তবে সর্বনিম্ন ৪টি খাবারের অর্ডার দিতে হবে। খাবারের বিল পরিশোধ করতে হবে খাওয়ার পর বাক্স ফেরত নেয়ার সময়।

আরকে/ডব্লিউএন


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি