বাবাও চান নি আমি আর্টিস্টের দূরূহ জীবন বেছে নিই: মুর্তজা বশীর
প্রকাশিত : ০০:০১, ১৭ আগস্ট ২০১৮ | আপডেট: ১৯:১৭, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮
আজ শুক্রবার ১৭ আগস্ট শিল্পী মর্তুজা বশিরের ৮৭ তম জন্মদিন। বাবা ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ আর মা মরগুবা খাতুনের ৯ ছেলে- মেয়ের মধ্যে সবার ছোট মুর্তজা বশীর জন্ম ১৯৩২ সালে। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার কারণে তাকে দেশ ত্যাগ করতে হয়। তার জন্মদিন উপলক্ষে এ ভাষা সংগ্রামী জীবনের নানা দিক একুশে টিভি অনলাইন পাঠকের জন্য তুলে ধরা হল।
কেমন আছেন?
মুর্তজা বশীর : ভালো আছি। তেমন কোনো শারীরিক অসুস্থতা নেই। হৃদয়ে তো পেসমেকার বসানো। ফুসফুসটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। কেবল অক্সিজেনের ঘাটতি পড়ে যায়। কথা বললে, কাজ করলে বা ছবি আঁকলে ফুসফুসের ওপর চাপ পড়ে। তখন অক্সিজেন কমে যায়। ডাক্তার আমাকে বলেছেন, ২৪ ঘণ্টায় ৭-৮ ঘণ্টা আমাকে অক্সিজেন নিতে হবে। আমি সবসময়ই আর্লি রাইজার। সকাল ৬টার মধ্যে ঘুম থেকে উঠে যাই। এখনো এরকম ৬টার দিকে ঘুম ভেঙে যায় কিন্তু শুয়ে থাকি। প্রথমেই অক্সিমিটার দিয়ে শরীরের অক্সিজেনের মাত্রা দেখে নিই। কম থাকলে সোয়া আটটা পর্যন্ত আমি বিছানায় শুয়ে অক্সিজেন নিতে থাকি। মাঝে মাঝে নেবুলাইজারও দিতে হয়। সোয়া আটটায় বিছানা থেকে নামি। ফ্রেশ হয়ে নয়টায় নাশতা খাই। নাশতায় কখনো হাতেবেলা রুটি কখনো পাউরুটি। সঙ্গে ডিম পোচ বা অমলেট। ভাজি তেমন পছন্দ নয় আমার। তারপর চা। গ্রিন টি। গত ত্রিশ বছর ধরে গ্রিন টি খাই। একসময় প্রচুর সিগারেট খেতাম। ছেড়ে দিয়েছি। ২০১৩ সাল থেকে খাই না। ডাক্তারের বারণ। অ্যালকোহলও তেমন খাই না। যদিও এটাতে ডাক্তারের বারণ নেই।
কেমন করে সময় কাটে এখন ?
মুর্তজা বশীর : বাসায়ই থাকি। বন্ধুবান্ধব তো একে একে চলে গেছে প্রায় সবাই। শামসুর রাহমান, কামরুল হাসান, সাঈদ আহমেদ, আমিনুল ইসলাম এরাই আমার বন্ধু ছিলেন। আমার দুই মেয়ে এক ছেলে। ছেলেমেয়েরাও যার যার সংসারে ব্যস্ত। শুধু বড় মেয়েটাই কাছাকাছি থাকে। ছোট মেয়ে থাকে চট্টগ্রামে, ব্যাংকার। ছেলেটা ব্যাংকে চাকরি করে। কিন্তু দেশ নিয়ে সে হতাশ। আমেরিকা চলে যেতে চায়। আমরা দুজনেই, আমি আর আমার স্ত্রীই থাকি বাসায়। আমার স্ত্রী অসুস্থ। সে-ই তো এতকাল সামলেছে সব। ছেলে মেয়ে সংসার সব। এখন তাকেই দেখতে হয়।
ছেলেমেয়েরা কেউ বাবার মতো চিত্রশিল্পী হলো না বলে কষ্ট পান?
মুর্তজা বশীর : না। ছেলেমেয়েরা কেউ আঁকাআঁকি করে না। ছোট মেয়েটা চেয়েছিল। আমি উৎসাহ দিইনি। চিত্রশিল্পীর জীবন বড় কষ্টের। আমি চাইনি আমার ছেলেমেয়েরা এই কষ্ট করুক।
আপনার বাবাও চাননি আপনি আর্টিস্টের দূরূহ জীবন বেছে নেন। মুর্তজা বশীর : ছোটবেলায় আমি আসলে ভাবিনি আর্টিস্ট হব। কমিউনিস্ট পার্টি চেয়েছিল বলে আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। আমার বাবাও বলেছিলেন, প্যারিসে আমি দেখেছি আর্টিস্টের জীবন খুব কষ্টের। আমি চাই না আমার ছেলে সেই কষ্টের ভেতর দিয়ে যাক। পরে অবশ্য রাজি হন তিনি। বাবার টাকায় ইতালিতে পড়তে যাই। ১৯৫৬ সাল থেকে ৫৮ সাল পর্যন্ত ইতালির ফ্লোরেন্সে ছিলাম। আমার বাবা অবশ্য চেয়েছিলেন আমি ইউরোপ যাই।
মানে রঙের ওপর শিল্পীর দখল থাকবে, শিল্পীর ওপর রঙের না?
মুর্তজা বশীর : হ্যাঁ। আমার স্ত্রী একটা কথা বলে, আমি নাকি অনেকটা উটের মতো। মানে যখন কাজ করি না, একেবারেই করি না। আবার যখন কাজ করি, একেবারে খাওয়া-দাওয়া ভুলে। হয়ত একমাস-দুমাস টানা কাজ করলাম। সাধারণত আমি কখনো রাতে ছবি আঁকি না। আমি মদ্যপ অবস্থায়ও ছবি আঁকি না। আমি বিদেশে দেখেছি, আমাদের দেশেও দেখেছি অনেক শিল্পী মদ খেয়ে ছবি আঁকেন। হুইস্কি, ভদকা, জিন খেতে খেতে ছবি আঁকেন। কিন্তু কখনো অ্যালকোহলের ইনফ্লুয়েন্সে ছবি আঁকি না। ছবি আঁকা আমার কাছে প্রার্থনার মতো। সকালে ঘুম থেকে উঠে স্নান করি, দাড়ি কাটি, আফটার সেভ লোশন লাগাই, গায়ে পারফিউম লাগাই। একেবারে পবিত্র হয়ে আমি ছবি আঁকতে বসি। একেবারে টানা নয়টা পর্যন্ত। তারপর ব্রেকফাস্ট করতে যাই।
যখন ছবি আঁকেন না তখন কী কোনো অস্থিরতা কাজ করে?
মুর্তজা বশীর : না। তখন তো ভাবতে থাকি কী আঁকব। একটা গল্প আছে, লিওনার্দো ভিঞ্চিকে যখন দ্য লাস্ট সাপার আঁকার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়, তখন উনি আঁকবেন বলে জানান, কিন্তু আঁকেন না। ঘোরেন ফেরেন, কিন্তু আঁকেন না। তখন অন্য আগ্রহী শিল্পীরা ডিউকের কাছে অভিযোগ করলেন, কী এক শিল্পী নিয়ে এলেন, সে তো ঘোরে-ফেরে কাজ করে না। ডিউক ভিঞ্চিকে ডেকে বললেন, কী ব্যাপার আপনি আঁকা শুরু করছেন না কেন? তখন ভিঞ্চি বললেন, যখন একজন শিল্পী কাজ করে না, মানে সে কাজ করে না, তা নয়। তখন তার মস্তিষ্ক কাজ করে। আমারও তা-ই। মানে যখন ছবি আঁকি না, তখন ভাবি। সাধারণত রাতে ছবি আঁকি না, তবে সামনে এক্সিবিশনের ডেট থাকলে রাতেও আঁকি। এক্সিবিশনের ডেট সামনে থাকলে ছবি আঁকা হয় বেশি। একটা প্রেসার কাজ করে।
ছোটবেলায় আর্টিস্ট হতে চেয়েছিলেন?
মুর্তজা বশীর : না। ছোটবেলা থেকে আমি কিন্তু কখনো আর্টিস্ট হওয়ার স্বপ্ন দেখিনি। কল্পনায়ও ছিল না। এটা ঘটনাচক্রে ঘটে গেছে। তবে আঁকা ছবি দেখতে আমার খুব ভালো লাগত। দশের আগের কথা মনে নাই। তবে দশ বছর বয়সের পরের কথা মনে আছে। আমার বাবার লাইব্রেরিতে প্রচুর পত্রিকা আসত। কলকাতা থেকে। নানা জায়গা থেকে। সেসব পত্রিকায় আঁকা ছবি ছাপা হতো। ভারতের বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা ছবি ছাপা হতো। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় ইউরোপের শিল্পীদের ছবি ছিল। ওগুলো দেখতে খুব ভালো লাগত। ১২ বছর বয়সে স্কুলের বইয়ে আঁকা রেখাচিত্রে বাবার খাতা দেখার লাল-নীল কলম দিয়ে রং করতাম।
কিশোর বয়সের কোন বিষয়টা সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে?
মুর্তজা বশীর : রবিবারে আমাদের বাড়িতে ইংলিশ ফুড হতো। সেদিন আমরা বাবার সঙ্গে টেবিল চেয়ারে বসে খেতাম। চামচ-কাঁটাচামচ, ছুরি দিয়ে। মা গ্লাসের মধ্যে ন্যাপকিন সাজিয়ে রাখতেন খুব সুন্দর করে, যেন ফুল ফুটে আছে। একটা গল্প বলি শোনো, আমি তো অনেক খাটো। তখন আমি ঠিক কিশোর না, আরো বড় হয়েছি, একদিন একটা মেয়ে খুব বাজেভাবে আমাকে দেখিয়ে বলেছিল, এহ্ কী বিশ্রী খাটো! সেদিন মনে খুব জেদ চেপেছিল, বিশেষ কেউ হব। যেন মেয়েরা পেছনে ঘোরে আর আমি চেয়ে না দেখি।
আপনার লেখালেখি বিষয় যদি কিছু বলতেন ?
মুর্তজা বশীর: আমার একমাত্র উপন্যাস আত্মজৈবনিক, গল্পগুলা সমাজের ব্যবচ্ছেদ। আর কবিতা ব্যক্তিগত।
জীবনের সবচেয়ে বড় সুখ কোনটা?
মুর্তজা বশীর : আমি একুশের সঙ্গে ছিলাম। ভাষা আন্দোলনে যোগ দেওয়া আমার জীবনের সেরা অর্জন।
আপনাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
মুর্তজা বশীর : ধন্যবাদ।
টিআর/
আরও পড়ুন