অটোফেজি প্রক্রিয়াটি আসলে কি?
প্রকাশিত : ১২:০০, ২৬ এপ্রিল ২০২০ | আপডেট: ১২:০১, ২৬ এপ্রিল ২০২০
মুসলিমরা রোজা রাখলে তাকে বলা হয় ‘সিয়াম’। খ্রিস্টানরা রোজা রাখলে তাকে বলা হয় ‘ফাস্টিং’। হিন্দু বা বৌদ্ধরা রোজা রাখলে তাকে বলা হয় ‘উপবাস’। বিপ্লবীরা রোজা রাখলে তাকে বলা হয় ‘অনশন’। আর, মেডিক্যাল সাইন্সে রোজা রাখাকে বলা হয় ‘অটোফেজি’। রমজান আসলেই এই অটোফেজি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়।
আসলে অটোফেজি প্রক্রিয়াটি কি- তা আরও একটু ভালো করে বোঝা দরকার। অটোফেজি শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘অটো’ ও ‘ফাজেইন’ থেকে। বাংলায় এর অর্থ হচ্ছে—আত্ম ভক্ষণ বা নিজেকে খেয়ে ফেলা। বিষয়টি শুনতে ভয়ানক হলেও এটা শরীরের জন্য খুবই উপকারী। কেননা এটা শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গসমূহকে পরিষ্কার করার একটা প্রক্রিয়া, যা সম্পন্ন হয় কোষীয় পর্যায়ে। শরীরের বিভিন্ন কাজ করার জন্য প্রতিনিয়ত প্রোটিন তৈরি হয় এবং প্রোটিনের কাজটি সঠিকভাবে সম্পন্ন করার জন্য প্রোটিনের গঠনটি অ্যামিনো অ্যাসিড দ্বারা ত্রিমাত্রিক হতে হয়। যদি ত্রিমাত্রিক না হয় তবে প্রোটিনটি শরীরের জন্য ক্ষতিকারক হতে ও নানা রোগের সৃষ্টি করবে।
অটোফেজি একটি জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়া। যে প্রক্রিয়ায় দেহের ক্ষয়িষ্ণু এবং অপ্রয়োজনীয় কোষাণুগুলো ধ্বংস ও পরিচ্ছন্ন হয়। আসলে এ হলো কোষের এক আবর্জনা পরিচ্ছন্নকরণ প্রক্রিয়া। কোষের কার্যক্ষমতাকে ঠিক রাখতে যে প্রক্রিয়ার কোনো বিকল্প নেই। আর দেহ যখন বিশেষ সংকটাবস্থায় থাকে, তখন এই অটোফেজিই দেহকে বাঁচিয়ে রাখে।
সক্রিয় অটোফেজি ব্যবস্থা আপনার মস্তিষ্ককে ক্ষুরধার হতেও সাহায্য করে। এমনকি জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটির কিছু গবেষণা থেকে দেখা যায়- আলঝেইমার বা পার্কিনসন্স জাতীয় বয়সজনিত রোগগুলো যে কারণে হয়, তার প্রতিরোধও করে অটোফেজি।
জীবাণু ধ্বংস
অটোফেজি প্যাথোজেন, ব্যাক্টেরিয়া ইত্যাদি জীবাণুকে ধ্বংস করে দেহকে সুস্থ রাখে।
দীর্ঘ জীবন
সবকিছুর মিলিত ফল হলো আপনার দীর্ঘজীবন। মানে আপনার যদি প্রদাহ কমে যায়, ক্যান্সার, হৃদরোগ না হয় তাহলে আপনার সুস্থ দীর্ঘজীবন হবে সেটাই স্বাভাবিক।
অটোফেজি ও ক্যান্সার
ক্যান্সার নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করেছেন এমন একজন বিজ্ঞানী টমাস সেফ্রেইড। প্রাকৃতিকভাবে ক্যান্সার প্রতিরোধ নিয়েই তার গবেষণা। তিনি দেখেন, বছরে কেউ যদি অন্তত একবারও সাত দিন একটানা উপবাসে থাকতে পারে (পানি ছাড়া অন্যকিছু না খেয়ে), দেহ পরিচ্ছন্ন হবার জন্যে তার আর কিছুই লাগে না। ভবিষ্যতে ক্যান্সার ঘটাতে পারে এমন সেলগুলো এ প্রক্রিয়ায় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। এমনকি এটা সাত দিন না হয়ে চারদিনও হতে পারে। সেক্ষেত্রে বছরে কয়েকবার উপবাস করতে হবে।
রোজা ও অটোফেজি
সাধারণভাবে উপবাসের ১৮তম ঘণ্টা থেকে অটোফেজি সক্রিয় হয়। কোনো কোনো গবেষণায় অবশ্য দেখা গেছে যে, ১৩তম ঘণ্টা থেকেও অটোফেজি সক্রিয় হয়েছে। কাজেই আমরা বলতে পারি যে, উপবাসের ১৩তম থেকে ১৮ ম ঘণ্টায় গিয়ে আমাদের দেহে অটোফেজি প্রক্রিয়া সক্রিয় হয়। সক্রিয় হয় তখন কোষের আবর্জনা ও ক্ষয়ে যাওয়া কোষ রিসাইক্লিং এবং নতুন কোষাণু তৈরি ও শক্তি উৎপাদন।
উল্লেখ্য, চিকিৎসা বিজ্ঞানে ২০১৬ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন জাপানের অটোফেজি গবেষক ইয়োশিনোরি ওহশোমি। জীবদেহ কেমন করে ত্রুটিপূর্ণ কোষ ধ্বংস করে নিজের সুরক্ষা করে এবং কোষ কীভাবে নিজের আবর্জনা প্রক্রিয়াজাত করে সুস্থ থাকে, সেই রহস্য বের করার কারণে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন এ বিজ্ঞানী।
বিজ্ঞানের ভাষায় এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় অটোফেজি। আর যে জিনটি এই অটোফেজি প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে সেটি শনাক্ত করেছিলেন টোকিও ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির এ অধ্যাপক।
১৯৬০ সালে বিজ্ঞানীরা প্রথম দেখতে পান, কোষ কীভাবে নিজের ভেতরে একটি বস্তার মতো ঝিল্লি তৈরি করে নিজের আবর্জনা বা ক্ষতিগ্রস্ত উপাদানকে তার ভেতরে আটকে ফেলে। বেলজিয়ামের বিজ্ঞানী ক্রিস্টিয়ান ডে ১৯৭৪ সালে এ লাইসোজম আবিষ্কারের কারণে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তবে সেখানে ঠিক কী ঘটে সেটা তখন বিজ্ঞানীদের জানা ছিল না। বিজ্ঞানী ইয়োশিনোরি ওহশোমি পৃথিবীতে সর্ব প্রথম অটোফেজি নিয়ে কাজ শুরু করেন। তিনি লক্ষ্য করেন লাইসোজম শুধু দেহের আবর্জনা বা ক্ষতিগ্রস্ত উপাদান জমা করে রাখে না। এটা রিসাইক্লিং চেম্বার বা নবায়নযোগ্য শক্তিব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে নতুন উপাদান/কোষ তৈরি করে।
ইউশিনোরি দেখিয়েছেন, কোষেরা নিজেরাই নিজেদের বর্জিতাংশ বা আবর্জনাকে আটকায়। এরপর সেখান থেকে উপকারী উপাদানগুলোকে ছেঁকে আলাদা করে ফেলে। তারপর ওই দরকারি উপাদানগুলো দিয়ে উৎপাদন করে শক্তি কিংবা গড়ে তোলে নতুন নতুন অনেক কোষ। এ মহৎ কাজ তাঁকে ২০১৬ সালে নোবেল পুরস্কার এনে দেয়।
এসএ/