ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪

সুস্থতার জন্যে ভালো ঘুমের বিকল্প নেই

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১০:৩২, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১

‘ঘুমকে তুলনা করা যেতে পারে কাপড় ধোয়ার সাথে। সময় বাঁচাতে গিয়ে যদি ধোয়া কাপড়টি শুকানোর আগেই ওয়াশিং মেশিন থেকে বের করে আনি- তাহলে কী হবে? আধা-ভেজা কাপড়টা যেমন আপনাকে স্যাঁতসেঁতে, ভারী এবং অস্বস্তিকর একটা অনুভূতি দেবে, তেমনি ঘুমটাও যদি ভালোভাবে না হয় সারাদিন ঠিক এরকমই অনুভূতি হবে আপনার। পরিচ্ছন্ন কাপড়ের জন্যে যেমন ওয়াশিং মেশিনের সবগুলো ধাপ সম্পন্ন করা প্রয়োজন, তেমনি সুস্থ ও চনমনে দেহ-মনের জন্যেও ঘুমের পুরো সাইকেলটা সম্পন্ন করা প্রয়োজন।’

একটি সাক্ষাৎকারে এ কথাগুলো বলেন খ্যাতনামা নিউজ ব্লগ হাফিংটন পোস্টের সহ-প্রতিষ্ঠাতা, সফল ব্যবসায়ী ও লেখক আরিয়ানা হাফিংটন।

তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে রাত জাগার অভ্যাস, ক্লান্তি-অবসাদ আর স্ট্রেস- সবমিলিয়ে ২০০৭ সালে আমি একেবারে ভেঙে পড়লাম। তখন আমি অত্যন্ত বিরক্ত, রি-একটিভ, বিক্ষিপ্ত ও অসুখী একজন মানুষ। মনে হতো, আমার আকাশছোঁয়া সাফল্য আর সবকিছু সামলে নেয়ার যে দক্ষতা, এর মূল্যই হয়তো আমাকে দিতে হচ্ছে। প্রচণ্ড গতিময় আধুনিক সভ্যতার এ অভিশাপের নাম বার্নআউট। বুঝতে পারছিলাম- এর কোনো চিকিৎসা নেই, আমাকে জীবনযাপনের ধরন বদলাতে হবে।

ঘুমে টক্সিনমুক্ত হয় আপনার মস্তিষ্ক
সুস্থ জীবনের জন্যে আরিয়ানা শুরু করলেন তার নতুন মিশন। উপলব্ধি করলেন- মস্তিষ্কের সার্বিক দেখভালের জন্যে ঘুমের কোনো বিকল্প নেই। কর্মব্যস্ত দিনের শেষে আমরা যখন ঘুমিয়ে পড়ি, এ সময়টাতেই মস্তিষ্ক সুযোগ পায় নিজেকে টক্সিনমুক্ত করার। মস্তিষ্ককে যদি আমরা দিনের পর দিন এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত করি, তার জন্যে চরম মূল্য দিতে হবে আমাদেরকেই। কারণ মানুষ যন্ত্র নয়।

ঘুম নিয়ে গবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্ত নিয়ে প্রকাশিত হয় তার বই The Sleep Revolution : Transforming your life, one night at a time।

যুক্তরাষ্ট্রের ডেলাওয়্যার ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানী ব্র্যাড ওলগ্যাস্টের মতে, হতাশা ও বিষণ্নতায় ভুগছেন এমন শতকরা ৮০-৯০ ভাগ রোগীর ক্ষেত্রেই দেখা যায় তাদের ঘুমের সমস্যাও রয়েছে। যুক্তরাজ্যের একটি জরিপে উঠে আসে- যাদের ঠিকমতো ঘুম হয় না তাদের মধ্যে অসহায়ত্বের অনুভূতি বিদ্যমান থাকে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষদের তুলনায় সাত গুণ বেশি এবং একাকিত্বের অনুভূতি কাজ করে পাঁচ গুণ বেশি।

জার্মানির মিউনিখে লুদ্ভিগ-ম্যাক্সিমিলিয়ন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর টিল রোয়েনবার্গের মতে, রাত জাগার অভ্যাস মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা, স্মৃতিশক্তি ও চারপাশের মানুষের সাথে যোগাযোগের সামর্থ্যকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে কোনো পরিস্থিতিতে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রক্রিয়াও হয় বাধাগ্রস্ত।
যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের গবেষণায় উঠে এসেছে- মেদস্থূলতা, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, বিষণ্নতা, হতাশাসহ নানা ধরনের মানসিক রোগের অন্যতম কারণ অপর্যাপ্ত ঘুম। সেই সাথে ব্যক্তির মনোযোগ, স্মরণশক্তি, যুক্তি, গাণিতিক সক্ষমতা ও মস্তিষ্কের অন্যান্য সামর্থ্যকেও বাধাগ্রস্ত করে রাত জাগার অভ্যাস।

সবচেয়ে বেশি ভুগছে কিশোর-তরুণরা
হার্ভার্ড হেলথ পাবলিশিংয়ের সিনিয়র ফ্যাকাল্টি এডিটর ক্লেয়ার ম্যাকার্থি বলেন, গত ২০ বছরে সারা বিশ্বে কিশোর-তরুণদের ঘুমের অভ্যাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উদ্বেগজনক হারে। স্ট্যানফোর্ড চিলড্রেনস হেলথ স্লিপ সেন্টারের ডিরেক্টর ন্যান্সি ইউয়ান বলেন, আধুনিককালে প্রায় প্রতিটি দেশেই মানুষের ঘুমের সমস্যা বাড়ছে, তবে সমস্যাটি মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে টিন-এজারদের মধ্যে।

উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্রিকস টিন-এজারদের ক্লান্তি-অবসাদ-ঝিমুনিকে চিহ্নিত করেছে সামাজিক মহামারি হিসেবে। 

যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানের প্রফেসর ড. ম্যারি কার্সকাডন বলেন, ‘নির্ঘুম এই কিশোর-তরুণদের চিন্তাজগত সবসময় এক ধরনের ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। তারা যে স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করতে পারছে না, সে বিষয়েও তারা উদাসীন। প্রথমবার চশমা নেয়ার আগে যেমন একজন মানুষ বুঝতে পারে না তার দৃষ্টিশক্তির অবস্থা কতটা খারাপ, তেমনি নিয়মিত রাত জাগছে যে তরুণরা, তারাও উপলব্ধি করতে পারে না দেহ-মনের কতটা ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন।’

একাধিক গবেষণায় বলা হয়েছে, কিশোর-তরুণদের রাগ-ক্ষোভ, হতাশা, বিষণ্নতা, খিটখিটে মেজাজ, ধ্বংসাত্মক আচরণ, আত্মহত্যা প্রবণতাসহ নানা ধরনের মানসিক সমস্যার উৎস হলো রাত জাগার অভ্যাস বা ঘুমের এলোমেলো রুটিন।

ফ্রান্সে একটি জরিপে দেখা গেছে, গত সাত বছরে মানুষের ঘুম কমেছে আধাঘণ্টা থেকে একঘণ্টা। বর্তমানে ক্যারিয়ার এবং স্ক্রিন টাইমকে মানুষ এতটাই গুরুত্ব দিচ্ছে যে, স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছে নির্ঘুম রাত। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল স্লিপ ফাউন্ডেশনের মতে, একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের জন্যে প্রতিরাতে কমপক্ষে সাত ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন।

সুস্থ জীবনচর্চায় প্রশান্তিময় ঘুম
ছোট ছোট কিছু পদক্ষেপই আপনাকে দিতে পারে শান্তিময় ঘুম ও সুন্দর জীবনছন্দ-
* হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল ও মেয়ো ক্লিনিকের মতে, ভালো ঘুমের জন্যে চাই ঘুমের সঠিক পরিকল্পনা। প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে যাওয়া এ পরিকল্পনার প্রথম ধাপ। আর এ অভ্যাস ছুটির দিনগুলোতেও বজায় রাখা বাঞ্ছনীয়।
* ঘুমের জন্যে সহায়ক পরিবেশ প্রস্তুত করে নিন। আলো নিভিয়ে দিন, শব্দ কমিয়ে দিন। ঢিলেঢালা পোশাক পরুন, দেহে রক্ত চলাচল ভালো হবে।
* রাতে ঘুমানোর অন্তত দুই ঘণ্টা আগে সবরকম ডিজিটাল ডিভাইস বন্ধ করে দিন।
* পরিবারের বা কর্মক্ষেত্রের কোনো জটিলতা নিয়ে ঘুমানোর আগে আলাপ-আলোচনা করা থেকে সচেতনভাবে বিরত থাকুন।
* বিছানা থেকে যথাসম্ভব দূরে রাখুন আপনার মোবাইল ফোনটি। অ্যালার্মের জন্যে ঘড়ি রাখুন।
* রাতে দেরিতে খাবার গ্রহণ এবং অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ- দুটোই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে ঘুমের ওপর। তাই রাতে হালকা খাবারে অভ্যস্ত হোন এবং ঘুমানোর অন্তত দুই ঘণ্টা আগে খেয়ে নিন।
* ঘুমানোর আগে আপনার জীবনের অন্তত তিনটি বিষয়ের কথা স্মরণ করুন, যার জন্যে আপনি সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞ।
* ক্ষমার অভ্যাস গড়ে তুলুন। সারাদিনে কারো সাথে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু যদি ঘটেও থাকে, সেই মানুষগুলোর প্রতি কোনো রাগ-ক্ষোভ-বিরক্তি নিয়ে দিনের ইতি টানবেন না। মনকে বড় করুন, ক্ষমা করে দিন, সব দুঃখ-গ্লানি ঝেড়ে ফেলুন। সকালটা শুরু হোক ফুরফুরে মনে।

রাতে ভালো ঘুমের জন্যে দিনটাও হোক সহায়ক
সূর্যের সান্নিধ্যে আসুন : মানুষের জৈবছন্দের সাথে সূর্যের আলোর রয়েছে সরাসরি এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ। তাই রাতে ভালো ঘুমের জন্যে দিনের অন্তত কিছুটা সময় প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসুন, সূর্যের আলো গায়ে লাগান।

হাঁটুন, ইয়োগা ও মেডিটেশন করুন : নিষ্ক্রিয়তা থেকে বেরিয়ে আসুন। প্রতিদিন নিয়ম করে হাঁটুন, ইয়োগা করুন। দিনে দুই বেলা মেডিটেশন চর্চা করুন।

ক্যাফেইন গ্রহণে সংযত হোন : অতিরিক্ত চা-কফি ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। সারাদিনে কী পরিমাণ চা-কফি পান করছেন খেয়াল রাখুন। সেই সাথে ধূমপান ও সব ধরনের মাদকদ্রব্য থেকে দূরে থাকুন। 

সর্বোপরি স্বাস্থ্যকর ঘুমের রেওয়াজ তৈরি করুন পরিবারে। নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমানো ও ঘুম থেকে ওঠা এবং সুন্দরভাবে দিন শুরু করার বিষয়টি যখন পারিবারিক চর্চায় রূপ নেবে, ইতিবাচক পরিবর্তনগুলো হবে আরও স্থায়ী এবং কার্যকর।

(তথ্যসূত্র : রিডার্স ডাইজেস্ট, ফেব্রুয়ারি ২০২০ ও জুলাই ২০১৩; হার্ভার্ড হেলথ পাবলিশিং, ২৬ জুন ২০১৮; ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, আগস্ট ২০১৮; দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, আগস্ট ২০১৮; দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, ডিসেম্বর ২০১৬)
এএইচ/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি