ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪

মানিক সাহা হত্যাকাণ্ড ও সাংবাদিক হত্যার সরল সমীকরণ

পলাশ আহসান

প্রকাশিত : ০৮:৩৪, ১৫ জানুয়ারি ২০২২ | আপডেট: ০৮:৫৬, ১৫ জানুয়ারি ২০২২

‘মানিক সাহার মৃত্যু, একটি আলোকিত যুগের অবসান’- মানিক দা’র নৃশংস হত্যার খবর পাওয়ার পর মাথার মধ্যে এই উপলব্ধী ঢুকে যায়। প্রথমদিকে খানিকটা সন্দেহ ছিল। মনে হতো ব্যক্তিগত সম্পর্কের শ্রদ্ধাবোধে হয়তো আমি আবেগতাড়িত। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে ততই বিষয়টা পরিষ্কার হচ্ছে। আমার এখন উপলব্ধী বদ্ধমূল। এখন খুব পরিষ্কার বুঝতে পরি মানিক সাহা সভ্য সাংবাদিকদের প্রতিনিধি। যাদের সংখ্যা নেহায়েত হাতে গোনা। যারা প্রত্যেকে একে অন্যের প্রতিচ্ছবি।

এখন কবিগুরুর কাছে ফিরি। তিনি বলেছেন, ভালো যত কম হয় তত ভালো। নইলে ভিড়ের ঠ্যালায় তিনি হয়ে যান মাঝারি। আমার মনে হয় এখন সেই তত্ত্ব খানিকটা বদলেছে। কারণ মন্দরা বুঝে গেছে, কূট কৌশল করে ভালোদের দমিয়ে রাখা যায়। মাঝারিদের দলে ভিড়িয়ে, কেউ মাথা উঁচু করলে দল বেঁধে ছেটে দেয়া যায় সেই মাথা। তারাই ২০০৪ সালের ১৫ জানুয়ারি মানিক সাহার উঁচু মাথাটা ছেটে দিয়েছিল। ছোট মির্জাপুর এলাকায় পড়ে ছিল মানিক দা’র মাথাহীন মরদেহ। আমার তো মনে হয় মানিক সাহাকে হত্যার মধ্য দিয়ে ওরা একটি বার্তা দিতে চেয়েছিল। সেটা হচ্ছে, উঁচু মাথার কোনো সাংবাদিক বাঁচবে না। বাঁচতে হলে মাথা নিচু করে বাঁচতে হবে।           

কিন্তু মাথা হারালেও মানিক দা মাঝারি হননি। হতে চাননি বলা ভালো। কোথায় তার মাথা উঁচু ছিল না? দেখা সত্য থেকে জানি, বাংলাদেশের সাংবাদিকতার যে বড় ধারাটি রাজনীতি চর্চা থেকে সাংবাদিকতায় আসতেন, মানিক দা ছিলেন তাদের শেষ প্রতিনিধি। যারা পেশায় থেকেও রাজনীতি চর্চা করতেন। হাটে-মাঠে-ঘাটে মানুষের কল্যাণের কথা বলতেন, অধিকার সচেতনতার কথা বলতেন। আবার সন্ধ্যায় বার্তাকক্ষে আরেকভাবে মানুষের কথা বলতেন। ঘুমানোর সময় বাদে, মানুষই ছিল যাদের ধ্যান-জ্ঞান।

জীবনের শেষ দশ-পনেরো বছর সাংবাদিকতাই ছিল মানিক সাহার মূল পরিচয়। সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণে বলতেন, চোখ-কান খোলা রেখে ঠিকঠাক সাংবাদিকতা করতে পারলে মানুষের কল্যাণ হয়। খুব প্রচ্ছন্নভাবে বলতে চাইতেন, সাংবাদিকদের রাজনীতি সচেতন হওয়া জরুরি।কারণ কল্যাণমুখী না হলে সেই সাংবাদিকতা সাংবাদিকতা নয়।

খুলনা প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি ও একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক মানিক সাহা

মানিক দা যে শুধু কথা বলতেন তা নয়, কাজও করতেন। খুলনাঞ্চলে মানুষের অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে অথচ মানিক সাহার রিপোর্ট নেই এমন নজির নেই। সে চিংড়ি চাষ হোক অথবা কৃষকের কাছে বিষাক্ত সার বিক্রিই হোক। ভূমিহীন আন্দোলন হোক বা ধান চাষের জমি দখল করে চিংড়ি চাষ করা হোক। জঙ্গি তৎপরতা কিম্বা সর্বহারার নামে সন্ত্রাসবাদ, যাই হোক। শুধু যে নিজে রিপোর্ট করতেন তা নয়, অন্যরা চাইলেই যেন রিপোর্টটি করতে পারেন তার সব ব্যবস্থাই করতেন। এতে ক্ষতি হতো একটি বিশাল পুঁজিবাদি শ্রেণির। তাহলে তিনি বাঁচবেন কেন শুধু শুধু?

উইকিপিডিয়া বলছে, বাংলাদেশ স্বাধীনের পর ১৯৯৬ সালে নীলফামারীতে প্রথম একজন পেশাদার সাংবাদিকের হত্যা ঘটনা আলোচিত হয়। তিনি ছিলেন নীল সাগর নামে একটি পত্রিকার রিপোর্টার। মারা যান একটি নির্বাচনী বিক্ষোভের খবর সংগ্রহের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে। আজও সেই মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন হয়নি। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা বিশ্বব্যাপী সংগঠন কমিটি টু জার্নালিস্ট প্রটেক্ট, সিপিজে’র তথ্য অনুযায়ী নিরাপত্তাকর্মীদের গুলিতে মারা যান কামরুজ্জামান নামের ওই রিপোর্টার ।

সিপিজের হিসাবে, ১৯৯২ সাল থেকে এ পর্যন্ত পেশার কারণে খুন হয়েছেন ২৩ জন সাংবাদিকে। আর উইকিপিডিয়ার হিসাবে, ১৯৯৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত খুন হওয়া সাংবাদিকের সংখ্যা ৩৫। কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, মানিক সাহা হত্যা মামলাসহ আর দু’একটি মামলায় বিচার হয়েছে। যদিও তাদের পরিবার রায় নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছে। মানিক সাহার রায়ের পর সারাদেশের সাংবাদিকরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ করেছেন। আবার তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।   

সাংবাদিক হত্যার অন্য মামলাগুলোর কোনোটির বিচার শুরু হয়নি। কোনোটার চার্জশিট দেয়া হয়নি। আবার কোনোটি নথিপত্রের অভাবে হারিয়ে গেছে। এরমধ্যে সবচেয়ে চাঞ্চাল্যকর তথ্য হচ্ছে, বহুল আলোচিত সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত রিপোর্ট দেয়ার তারিখ ৮৫ বার বদলেছে। বেশিরভাগ মামলায় নথিপত্রের অভাবে অভিযুক্তরা দায়মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে। সাংবাদিক হত্যার নথিগুলোই কীভাবে যেন হারিয়ে যাচ্ছে। সব রহস্যের জট লেগে যাচ্ছে বিচারের ক্ষেত্রে। কীভাবে যেন সাক্ষীরাও একে একে হারিয়ে যাচ্ছেন।   

শুরুতে বলেছি, মানিক সাহা হত্যার মধ্যেই রয়েছে বাংলাদেশে বেশিরভাগ সাংবাদিক হত্যার সমীকরণ। কারণ এই হত্যাকাণ্ড বিশ্লেষণ করলে প্রায় সব সাংবাদিক হত্যার অন্তঃমিল পাওয়া যায়। যেমন, মৃত্যুর মিনিট ১০ আগে কারা যেন মানিক সাহার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। তাদের সঙ্গে উত্তপ্ত কথা কাটাকাটি হয়েছিল। আজও জানা যায়নি কে বা কারা সেই অপরিচিত লোক, কারা মানিক সাহার সঙ্গে প্রেস ক্লাবের মত জনবহুল জায়গায় আসতে পেরেছিল। আজও পুরো বিষয়টি অন্ধকারে।

আসলে অন্ধকারেই থাকে সাংবাদিক হত্যার গল্প। কারা মানিক সাহাকে পছন্দ করত না, মানিক সাহার রিপোর্টে কাদের ক্ষতি হয়েছিল? এরা কারা? কী এদের পেছনের ইতিহাস? এসব বিষয় কখনো আমলে আসে না। অথচ এসব তথ্য গোপন নয়। পেছনের দু’বছরের পত্রিকা নিয়ে বসলেই তো সেই তথ্য পাওয়া যায়। সেসব তথ্য বিশ্লেষণ করে কোনো তদন্ত হয়েছে বলে সাদা চোখে ধরা পড়েনি।

অথচ আজকের দিনে হাজারো অপরাধের গল্প আমাদের পাঠক অথবা দর্শকদের বলতে হয়। প্রথম ধরা পড়া ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের বরাত দিয়ে সেসব গল্পের ডালপালা মেলে। অথচ মানিক সাহার হত্যায় জড়িত মোট ১৪ জন অপরাধী চিহ্নিত হল। যাদের তিনজন মারা গেলো ক্রসফায়ারে। নয়জন যাবজ্জীবন পেল। এদের পাঁচজন আটক হল। কিন্তু তাদের কাছ থেকে কোনো তথ্য বের হল না। কে বা কারা তাদের মানিক সাহাকে হত্যা করতে বলল, জানা গেল না। তাহলে কী ভাবতে হবে, একদল ভাড়াটে খুনি কোনোরকম পরিকল্পনা ছাড়াই মানিক সাহাকে হত্যা করল?

আমার কেন জানি মনে হয়, বাংলাদেশের সভ্য সাংবাদিকরা বাঁচুক এটাই বেশিরভাগ মানুষ চাননা। তা না হলে ১৯৯৬ এ নীলফামারীর কামরুজ্জামান থেকে শুরু করে ২০২১ সালে সুনামগঞ্জের মুজাক্কির পর্যন্ত, সব ক্ষেত্রে একই চিত্র কি করে হয়? সাংবাদিক হত্যার সময় কেউ দেখতে পাননা। সিসিটিভিটাও বেছে বেছে ঠিক ওই সময় বন্ধ থাকে। ২০১৮তে সিপিজে’র দেয়া এক প্রতিবেদন বলছে, সাংবাদিক হত্যায় বিচার না হওয়া দেশের তালিকায় বাংলাদেশ দশম।

বেসরকারি সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলছে, সব শেষ বছরে ১৫৪ জন সাংবাদিক হামলা মামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। একজন মারা গেছেন গুলিবিদ্ধ হয়ে। সারাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা মামলা হয়েছে ২২৫টি। এর ৬৮টিই সাংবাদিকদের নামে। এদের মধ্যে গ্রেপ্তার হয়ে জেল খেটেছেন ১৫ জন। আমি বলছি না এরা সবাই নির্দোষ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়ত দোষ ছিল। কিন্তু বেশিরভাগই ঠাকুরগাঁওর তিন সাংবাদিকের মত। যারা পিছ মোড়া হয়ে গ্রেপ্তারের আগে রিপোর্ট করেছিলনে ৩০০ টাকা বরাদ্দে রোগী পায় ৭০ টাকার খাবার।       

ইদানিং বাংলাদেশের সাংবাদিক কোনো অর্থেই নিরাপদ নন। খুব নিরাপদ হওয়ার কথাও না। কারণ কাজের ধরণে সব সময় তাঁকে একাধিক শক্তিশালী চক্রের বিরাগভাজন হয়ে থাকতে হয়। এটা জেনেই একজন তরুণ সাংবাদিকতায় আসেন। তারা জানে, মানিক দা’র মত একজন সাংবাদিক মারা গেলে একটি গ্রুপ তো বলবে, যাক আপদ গেছে। কিন্তু একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী তো মুষড়ে পরে। তাদের কথা কথা চিন্তা করে হলেও তো সাংবাদিক হত্যার প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করা দরকার। শাস্তি দেয়া দরকার দোষীদের।

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনকে উদ্ধৃত করে লেখাটা শেষ করতে চাই। এক লেখায় তিনি বলেছেন, যে দেশে সাংবাদিক র্নিভয়ে লিখতে পারেন সে দেশ দরিদ্র হয় না। কথাটা আমার কাছে মন্ত্রের মত মনে হয়। বাকি ভাবনা ছেড়ে দিতে চাই আজকের পাঠকের কাছে। আপনারাই ভাবুন, সাংবাদিক বাঁচবে কী না? সাংবাদিক হত্যার বিচার হবে কী না?
লেখক: যুগ্মপ্রধান বার্তা সম্পাদক, একাত্তর টেলিভিশন
এসএ/
 


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


টেলিফোন: +৮৮ ০২ ৫৫০১৪৩১৬-২৫

ফ্যক্স :

ইমেল: etvonline@ekushey-tv.com

Webmail

জাহাঙ্গীর টাওয়ার, (৭ম তলা), ১০, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

এস. আলম গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান

© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি