ঢাকা, রবিবার   ২৮ এপ্রিল ২০২৪

‘আপনি, তুমি এবং তুই’

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ১৪:৪১, ৩ জুলাই ২০২০

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনীতি-কড়চা, Freedom for Choice প্রভৃতি।

তিরস্কৃত হয়েছি বহুবার, ভর্ৎসনাও জুটেছে কপালে। তিরস্কার এবং ভর্ৎসনা করেছেন আমার অতি আপনজন, আমার প্রিয়জনেরা, যেমন- আমার কন্যারা। বিষয়টি তেমন কিছু নয় - এই ‘আপনি’ ‘তুমির’ সম্বন্ধ নিয়ে। গত বছর ঢাকায় আমার কন্যাগৃহে তার পঞ্চদশ-বর্ষীয় যে মেয়েটি গৃহকার্যে সাহায্য করে, তাকে ‘আপনি’ বলায় তো আমার কন্যা যারপরনাই রেগে গিয়েছিল। ‘হয়েছে কি তোমার? ওর বয়স মাত্র পনেরো।’

বুঝেছিলাম তার তিরস্কারের কারণ। বাংলা ভাষায় ‘আপনি’, ‘তুমি’ ও ‘তুই’ এর একটা ক্রমোচ্চ শ্রেণীবিভাগ আছে। তার একটা দিক বয়ো:সম্পৃক্ত। বয়সে যারা জৈষ্ঠ্য, তাঁদেরকে ‘আপনি’ বলতে হবে; ‘তুমি’ বলা যায় তাঁদেরকেই, যাঁরা সমসাময়িক, বন্ধুস্থানীয়, বয়ো:কণিষ্ঠ; আর যারা বয়সে খুব ছোট, তাদেরকে ‘তুই’ বলা যেতে পারে।

কিন্তু এ সম্বোধন-বিন্যাসের আরেকটি প্রেক্ষিত আছে। সেটি অবশ্য সম্পৃক্ত শ্রেণী-বিভাজনের সঙ্গে। তাই দরিদ্র ও নিম্নস্থানীয় শ্রমজীবি মানুষদের অবলীলাক্রমে আমরা ‘তুই’ বা ‘তুমি’ বলি - যদিও বয়সে তাঁরা আমাদের চেয়ে অনেক বড় হন। সে জন্য বৃদ্ধ রিক্সাচালককেও তরুণ যাত্রী ‘তুমি’ বলে, আবার গৃহস্বামীর কিশোরী কন্যা বয়স্ক গৃহপরিচারিকা কতৃক ‘আপনি’ বলে সম্বোধিত হয়। অন্যদিকে, ক্ষমতাবান আর বিত্তবানদের ‘তুমি’ বলতে আমাদের বাধে, কারণ তাঁরা সমাজ কাঠামোয় উচ্চশ্রেণীর। তাই ক্ষমতাধর বিত্তবান তরুণকেও বর্ষীয়ান ব্যক্তিরা ‘আপনি’ বলেই সম্বোধন করেন।

আমার ‘আপনি’ ‘তুমি’, ও ‘তুই’ সম্বোধনের তিনটে প্রেক্ষিত আছে। প্রথমত: আমি সম্বোধনের বিভাজন-বিন্যাস নির্ণয় করি সম্পর্কের নৈকট্য ও গভীরতা দিয়ে। তাই সাধারণত: আমি ‘আপনি’ দিয়ে শুরু করি ছোট/ বড় সবাই কে। তারপর জানাশোনা ও নৈকট্য গভীর হলে আমার সম্বোধন ‘আপনি’ থেকে ‘তুমিতে’ নেমে আসে। আর আমার মুখে ‘তুই’ ডাকটি মুষ্টিমেয় ক’জন অতি প্রিয়জনের জন্যে।

দ্বিতীয়ত: আমি দৃঢ়ভাবে মনে করি যে, একজন পূর্ণবয়ষ্ক মানুষকে ‘আপনি’ বলব না ‘তুমি’ বলব - সেটা তাঁর অনুমোদন সাপেক্ষ। সুতরাং আমি সেই সর্বোচ্চ ‘আপনি’ দিয়েই শুরু করি। তারপর যদি সে সম্বোধিত ব্যক্তিটি আমাকে বলেন, ‘আপনি আমাকে ‘তুমি’ বলে ডাকলেই আমি খুশী হবো’, শুধু তখনই আমি তাঁকে ‘তুমি’ ডাকি। আমার মনে হয়, এ অনুমতি ব্যতিরেকে কাউকে সরাসরি ‘তুমি’ বলাটা ঠিক নয়।

তৃতীয়ত: কোন নিম্নস্থানীয় শ্রমজীবি মানুষকে আমি ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করি। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এটুকু সম্মান তাঁদের প্রাপ্য - সেখানে আমি আপোষহীন।

ইদানীং সময়ে আমার এই ‘আপনি-তুমির’ সমস্যা অন্য একটি মাত্রিকতা পেয়েছে। এতেদিন এ ব্যাপারে শুধু অতি প্রিয়জন দ্বারা তিরস্কৃত ও ভর্ৎসিত হয়েছি। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অনুযোগ - আমার এক সময়ের শিক্ষার্থী ও তরুণ শুভ্যানুধায়ীদের দ্বারা। প্রাক্তন শিক্ষককে অনেকেই স্মরণ করিয়ে দেন, ‘স্যার, আমি আপনার ছাত্র ছিলাম। আমাকে তুমিই বলবেন’।

কোন কোন তরুণ শুভানুধ্যায়ী লেখেন, ‘তুমি বললেই প্রীত হই, আপনি আমাদের নমস্য’। কেউ কেউ আবার অনেকটা অবাক এবং বিরক্তি মেশানো স্বরে বলেন, “আপনি আমাকে ‘আপনি’, ‘আপনি’ করছেন কেন?”

এ দু’গোষ্ঠীর সবাইকে প্রতিশ্রুতি দেই যে, তাঁদের আমি এবার থেকে ‘তুমিই’ বলব। কিন্তু তারপর আর মনে থাকে না, কাকে কাকে এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। যে আমার ভুলো মন আর যা আমার দুর্বল স্মৃতিশক্তি! সুতরাং আবার শুরু হয়ে যায় আমার ‘আপনি-তুমির’ ভজঘট! এবং সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে অনুযোগ।

আমার ইংরেজ বন্ধু পল রবিন্স প্রায়ই তাঁর জীবনের নানান সমস্যার কথা বলে - বলেই যায় বলা চলে। বোধহয় আমার মতো এতো অখণ্ড মনোযোগী শ্রোতা সে আর জীবনে পায় নি। পলের গল্প শুনতে শুনতে আমার এক ধরনের ঈর্ষাও হয় - মনে হয় বেঁচে গেছে সে। পড়ত যদি ‘আপনি-তুমি-তুইয়ের’ জটাজুটে, বুঝতো তাহলে ‘কত ধানে, কত চাল’!

এনএস/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


টেলিফোন: +৮৮ ০২ ৫৫০১৪৩১৬-২৫

ফ্যক্স :

ইমেল: etvonline@ekushey-tv.com

Webmail

জাহাঙ্গীর টাওয়ার, (৭ম তলা), ১০, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

এস. আলম গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান

© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি