ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪

শিল্পপতিদের বিদায় আর সাহেদ-সাবরিনাদের চাতুরি!

মানিক মুনতাসির

প্রকাশিত : ২০:১৫, ১৪ জুলাই ২০২০ | আপডেট: ২০:১৮, ১৪ জুলাই ২০২০

আশির দশকের একটা বাংলা সিনেমার ডায়ালগ ‘অস্ত্র আর বুদ্ধি দুটোকেই ঠান্ডা মাথায় ব্যবহার করতে হয়’। কোন শীর্ষ সন্ত্রাসী কিংবা ধূর্ত প্রতারক নি:সন্দেহ মেধাবী। অন্যথায় প্রতারণা করতে পারবে না। আবার একজন সুদক্ষ স্যুটার যদি লক্ষ্য ঠিক করতে না পারে তাহলে তার পুরো পরিকল্পনাই ব্যর্থ হয়ে যাবে। হোক না সে গুপ্তঘাতক কিংবা কোন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য। অনেক সিনেমায় দেখা যায়- ঘাতকরা স্নাইপার বসিয়ে দিনের পর দিন অপেক্ষা করেন শত্রুর বুকের বা মাথার নিশানাটা ঠিক করতে। ঘাতকের ছোড়া গুলির অসদ্ব্যবহারে মরে যেতে পারেন কোন নিরাপরাধ মানুষ। আবার একই ধাতুতে তৈরি কোন বুলেটের আঘাতে হতে পারে কোন শীর্ষ সন্ত্রাসীর শাস্তি। মেধার ব্যবহার কিন্তু উভয়কেই করতে হবে। কেউ হয়তো মেধাটাকে খারাপ কাজে ব্যবহার করছেন। আবার কেউ তা উত্তম কাজে ব্যয় করছেন।

যেমনটা ঘটেছে সাহেদ আর সাবরিনার ক্ষেত্রে। মেধা খাটিয়ে বছরের পর বছর মানুষের সাথে প্রতারণা করেছে তারা। অবশেষে ধরা পড়েছে হয়তো কোন বোকামীর কারণে। কিংবা অধিক মাত্রায় পাপ হয়ে যাওয়ায় তারা ধরা খেয়েছে। অন্যদিকে- লতিফুর রহমান, আব্দুল মোনেম আর নুরুল ইসলাম বাবুল কতটা মেধাবী ছিলেন, সেটাও বোঝা যায় তাদের কৃতকর্মের দিকে তাকালে। একজন লতিফুর রহমান ছোট একটা জুট মিল দিয়ে ব্যবসা শুরু করে বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছেন লক্ষাধিক মানুষের। 

একইভাবে প্রাতিষ্ঠানিক কোন উচ্চ শিক্ষা না থাকা সত্ত্বেও শুধু মেধা, শ্রম আর একাগ্রতায় ৪১টি প্রতিষ্ঠান গড়ে নিজেকে শিল্পপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নুরুল ইসলাম বাবুল। অথচ তিনি শুরুটা করেছিলেন যমুনা ফ্যান নামক ছোট একটা ফ্যাক্টরি দিয়ে। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় শপিংমল যমুনা ফিউচার পার্ক তৈরি করে গেছেন তিনি। সেই নুরুল ইসলাম বাবলুও মহামারী রুপ নেয়া করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চির বিদায় নিয়েছেন। তার শূন্যতা হয়তো আপনি-আমি বুঝবো না। তবে এ দেশের শিল্পখাত সেটা টের পাবে। আরো বেশি টের পাবেন তাদের পরিবারের সদস্যরা।

আরেকটা উদাহরণ এখানে মনে করিয়ে দিতে চাই- ‘মানুষ ওপরে ওঠে কচ্ছপ গতিতে আর নিচে নামে চিতার গতিতে’। এটাও কোন এক বাংলা সিনেমার ডায়ালগ। শেরেবাংলা একে ফজলুল হক কোন এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে গিয়ে বলেছিলেন, “মানুষের পতনের জন্য কারো সহায়তার প্রয়োজন হয় না”। আরো সহজ করে বলা যায়, সিড়ি দিয়ে উঠতে কারো সহায়তা লাগে, কিন্তু কোন অসুস্থ মানুষও সিড়ি দিয়ে অনায়াসে নামতে পারে কোন সহায়তা ছাড়াই। অন্যদিকে, জীবনে সফলতা পেতে হলে ধৈয্য, শ্রম, একাগ্রতা আর অধ্যাবসায় নিয়ে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়। 

একজন মানুষের শুক্রাণু মায়ের গর্ভাশয়ে যাওয়ার পর তা জাইগোট হতেই সময় নেয় প্রায় চার সপ্তাহ। এরপর ১০ মাস ১০ দিন পর একটি পরিপূর্ণ মানব শিশু পৃথিবীর মুখ দেখতে পায়। অথচ সামান্য একটা কাঁচির আঁচড়েই তাকে আবার সেকেন্ডের মধ্যেই শেষ করে দেয়া যায়। সুতরাং আপনার চূড়ান্ত সফলতা পেতে যুগ যুগ লেগে যায়। কিন্তু সারাজীবনের সফলতাকে নিঃশেষ করতে প্রয়োজন শুধু একটি মাত্র সেকেন্ড-এর। 

একজন সাবরিনা চৌধুরী। নি:সন্দেহে তিনি মেধাধী। অন্যথায় বিসিএস ক্যাডার হওয়া সম্ভব ছিল না। জীবনে কত শত অর্জন! কিন্তু নিজের চরিত্রগত সমস্যা আর কৃতকর্মের ফলে তার সবই আজ ম্লান। মেধাকে ভাল কাজে না লাগিয়ে মানুষের জীবন নিয়ে খেলেছেন শুধু টাকার নেশায়।

একই ঘটনা সাহেদের ক্ষেত্রেও। রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মো: সাহেদ কতটাই না চাতুরতা আর ধূর্ততা নিয়ে পথ চলেছেন, ভাবা যায়! প্রতারণার মামলায় জেল খেটে বেরিয়ে মাত্র ১০ বছরের ব্যবধানে বঙ্গভবন, গণভবন আর সেনা ভবন- কোথায় পড়েনি তার পা। কে তাকে চেনেন না। কার সাথে তার ছবি নেই! তার এই চাতুরতা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বাইরেও। অথচ তিনি নাকি মাত্র এসএসসি পাস। 

কিন্তু পাপ যে বাপকেও ছাড়ে না। এটাই সত্যি। ফলে ধরা তাকে খেতে হয়েছে এবং ১০ বছরের চাতুরতার অর্জন নিমিষেই শেষ হয়েছে। ফাঁস হয়ে গেছে সব সাজানো গল্প। আর উম্মোচন হয়ে গেছে তার মুখোশ। সুতরাং, মনে রাখতে হবে- এক সেকেন্ডের নাই ভরসা, বন্ধ হইবো রং-তামাসা, চক্ষু বুজিলে হায়রে, দম ফুরাইলে...!

এবার অন্য এক প্রতারকের কথা বলি। লাজফার্মা। অভিজাত চেইন ফার্মেসিই বটে। সাথে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরও। আমার মনে হয়, খুব কম সংখ্যক লোকই আছেন যারা লাজফার্মার গ্রাহক, তারা ওষুধ কিনে বিল পরিশোধের পর প্রদেয় রিসিটটায় একবারও চোখ বুলান না। এমনকি কোন আইটেমটা কত দাম সেটাও জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন বোধ করেন না। কারণ আস্থা, বিশ্বাস। আর সেই আস্থা এবং বিশ্বাসের মর্যাদা কি দিতে পেরেছে লাজফার্মা কর্তৃপক্ষ। ওষুধের ব্যবসায় এমনিতেই অন্য ব্যবসার তুলনায় লাভ বেশি। কেননা এখানে প্যাকেটের গায়ে মূল্য লেখা থাকলেও সেটা ভোক্তা দেখেন না। দেখেন শুধু কাঙ্খিত কোম্পনির ওষুধটা। আর দাম দর করার তো প্রশ্নই আসে না! যে কোন পণ্য কিনতে গেলে ফিক্সড প্রাইসের দোকান হলেও মানুষ ডিসকাউন্ট খোঁজেন। কিন্তু ওষুধের বেলায় সেটাও খোঁজেন না। যদিও লাজফার্মা সব সময় সামান্য কমিশন দেয়। 

ফলে যে কোম্পানি বছরের পর বছর সাধারণ ভোক্তার সাথে প্রতারণা করছে। মাত্র কয়দিন পর পরই ভেজাল আর মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ রাখার দায়ে জরিমানা গুণছে। ভেজাল ওষুধ খাইয়ে মানুষের জীবনকে বিপন্ন করছে। অসুস্থ মানুষ সুস্থ হওয়ার জন্য ওষুধ খান, আর সেই ওষুধই যদি ভেজাল হয় তাহলে তো আর কিছুই থাকলো না। এরচেয়ে বড় অপরাধ আর কি হতে পারে? এটা তো সাবরিনা আর সাহেদদের চেয়েও ভয়াবহ প্রতারণা। 

সুতরাং এই চাটুকার, প্রতারক, জালিয়াত, ভণ্ড, বকধার্মিক আর নীরবঘাতকদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার হওয়া উচিত নয় কেন? লাজফার্মাকে আজীবন নিষিদ্ধ করা হলে দেশের মানুষের কি খুব বেশি ক্ষতি হবে। যে ক্ষতিটা তারা এখন করছেন। নিষিদ্ধ করলে ক্ষতিটা কি এরচেয়েও বেশি হবে। নিয়ন্ত্রকদের কাছে এ প্রশ্নটা রাখাই যায়!

এনএস/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


টেলিফোন: +৮৮ ০২ ৫৫০১৪৩১৬-২৫

ফ্যক্স :

ইমেল: etvonline@ekushey-tv.com

Webmail

জাহাঙ্গীর টাওয়ার, (৭ম তলা), ১০, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

এস. আলম গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান

© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি