ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

বিশ্বমঞ্চে প্রতিনিয়ত নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা

তাপস হালদার

প্রকাশিত : ১৭:২৯, ৫ অক্টোবর ২০২১

জাতিসংঘের ৭৬ তম এবারের অধিবেশনটি নানা দিক থেকে বাংলাদেশের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একদিকে চলছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, অন্যদিকে রাষ্ট্রের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। এমন একটি মাহেন্দ্রক্ষণে যিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে জাতিসংঘে বক্তব্য দিবেন, তিনি হলেন জাতির পিতার জেষ্ঠ্য কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা।

১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বাঙালি জাতির মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগনের প্রতিনিধি হয়ে জাতিসংঘে প্রথম এবং একমাত্র ভাষণটি দিয়েছিলেন।সেদিন তিনি বাংলা ভাষায় ভাষণ দিয়ে বাংলা ও বাঙালিকে বিশ্বসভায় পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। আর গত ২৪ শে সেপ্টেম্বর জাতির জনকের কন্যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে বরাবরের মতই বাংলায় ভাষণ দেন। জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এটি ১৭ তম ভাষণ। এই অনন্য রেকর্ডটি বিশ্বের আর রাষ্ট্র প্রধানের নেই।

গত বছর করোনা মহামারির কারণে জাতিসংঘের ভার্চুয়াল অধিবেশন হয়েছিল। একারণেই এবছর বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্র প্রধানদের শারিরীক উপস্থিতিতে অধিবেশন প্রাণবন্ত হয়ে উঠে। সাধারণ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। পিতা বঙ্গবন্ধুর মতোই তিনি বাংলাদেশ ও বিশ্বের বঞ্চিত মানুষের অধিকারের কথা তুলে ধরে ছয়টি প্রস্তাবনা দিয়েছেন। কিন্তু এরমধ্যে তিনটি প্রস্তাবনায় তিনি ধনী ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের দায়িত্বহীনতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাদেরকে দ্রুত পদক্ষেপের আহ্বান জানান। 

প্রথমত তিনি বলেন, কোভিডমুক্ত একটি বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে টিকার সর্বজনীন ও সাশ্রয়ী মূল্যে প্রাপ্যতা নিশ্চিতকরণের কথা। বর্তমান সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন হল কোভিড মুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলা। গত প্রায় দু-বছর সারা বিশ্বের জনজীবন যেমন বিপর্যস্ত হয়েছে তেমনি লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন কেডে নিয়েছে করোনা। এ মুহুর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ভ্যাকসিন। অথচ ধনী দেশ গুলোর আগ্রাসনের কারণে অপেক্ষাকৃত গরীব ও স্বল্পোন্নত দেশ গুলো ভ্যাকসিন বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। এ বিষয়টি তুলে ধরে জোরালো বক্তব্য পেশ করেছেন দেশরত্ন শেখ হাসিনা।টিকা বৈষম্য দূর করতে জোরালো আহ্বান জানিয়ে তিনি, ‘কোভিডমুক্ত একটি বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে টিকার সর্বজনীন ও সাশ্রয়ী মূল্যে প্রাপ্যতা নিশ্চিতকরণ, কোভিড-১৯ টিকাকে ‘বৈশ্বিক সম্পদ’ হিসেবে বিবেচনা করা, টিকা বৈষম্য দূর করার কথা জোর দিয়ে বলেছেন। লক্ষ লক্ষ মানুষকে টিকা থেকে দূরে রেখে কখনই যে টেকসই পুনরুদ্ধার ও পুরোপুরি নিরাপদ সম্ভব নয় সেটিও তিনি বিশ্ব মোড়লদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। 

দ্বিতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ঝুঁকির তালিকার প্রথম দিকে আছে বাংলাদেশ। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি স্থায়ী বৈশ্বিক সংকট। প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলার অন্যতম প্রধান মূখ, জোরালো প্রতিবাদী কন্ঠস্বর। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সাধারণ সভার আগে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস ও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের যৌথভাবে আয়োজিত জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে সরকার প্রধানদের গুরুত্বপূর্ণ রুদ্ধদ্বার বৈঠকে অংশ নিয়ে ছয়টি প্রস্তাবনা তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। সেখানে তিনি, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে প্যারিস চুক্তির বাস্তবায়ন, উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণবাবদ ১০০ বিলিয়ন ডলার তহবিল আদায়, আর্থিক মেকানিজম ও পরিবেশবান্ধব সবুজ হস্তান্তরের গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এবং সাধারণ পরিষদে এ বিষয়ে তিনি আরো বলেছেন, ধনী ও শিল্পোন্নত দেশ সমূহ জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ক্ষতির জন্য দায়ী।এজন্য অবিলম্বে তাদেরকে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস, ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং টেকসই অভিযোজনের জন্য অর্থায়ন ও প্রযুক্তির অবাধ হস্তান্তর করার দাবি করেন।

তৃতীয়ত, মিয়ানমারে যখন জাতিগত নিধনযজ্ঞ শুরু হয় তখন রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশ আশ্রয় দেয়। সেদিন মানবিক কারণেই দেশরত্ন শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ কখনোই রোহিঙ্গাদের এখানে স্থায়ীভাবে আশ্রয় দেওয়ার কথা বলেনি। ২০১৭ সাল থেকেই বাংলাদেশ বিশ্বের বিভিন্ন ফোরামে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের জন্যে জোর দাবি জানিয়ে আসছে। এবারও জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশের অবস্থান সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। রোহিঙ্গারা যে বাংলাদেশের পরিবেশ, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও অর্থনীতির ওপর ঝুঁকি, সেই সঙ্গে এটা এ অঞ্চলের টেকসই নিরাপত্তার জন্যও হুমকি তাও স্পষ্ট করে বলেছেন। এ সংকট সৃষ্টির জন্য মিয়ানমারকে দায়ী করে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন, রোহিঙ্গা সঙ্কটের সৃষ্টি মিয়ানমারে, সমাধানও মিয়ানমারকে করতে হবে। রোহিঙ্গা সংকটের দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, রাখাইন রাজ্যে তাদের মাতৃভূমিতে নিরাপদ, টেকসই ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমেই কেবল এ সঙ্কটের স্থায়ী সমাধান হতে পারে। এ জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই গঠনমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি সংকট নিরসনে আঞ্চলিক সংগঠন আশিয়ানকে আরো আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।

এসডিজি অর্জনে পিছিয়ে পড়া দেশগুলোকে সাহায্য করতে পাঁচ দফা প্রস্তাবনা দিয়েছেন দেশরত্ন শেখ হাসিনা। টেকসই উন্নয়ন বিষয়ে নবম বার্ষিক আন্তর্জাতিক সন্মেলনে ভার্চুয়াল বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পিছিয়ে পড়া দেশগুলোকে ফিরিয়ে আনতে আমাদের একটি সাহসী এবং উচ্চাভিলাসী বৈশ্বিক রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে- যাতে কেউ পেছনে পড়ে না থাকে।’ তিনি সবার জন্য টিকা নিশ্চিতকরণ, ২০৩০ এজেন্ডা বাস্তবায়নে সম্পদের বিশাল ব্যবধান কমিয়ে আনা, চলমান বৈশ্বিক মহামারির মোকাবেলার জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা, জলবায়ু পরিবর্তন পরিস্থিতি মোকাবিলায় সঙ্গে সমন্বয় করে করোনা থেকে পুনরুদ্ধারে পদক্ষেপ নেয়া এবং এসডিজি বাস্তবায়নে মনিটরিং সহায়তা বাড়ানোর কথা জোর দিয়ে বলেছেন।

দেশরত্ন শেখ হাসিনা তাঁর কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ইতিমধ্যে জাতিসংঘ সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরাম থেকে মর্যাদাপূর্ণ অনেক সম্মাননা পেয়েছেন। এবারের সফরেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।২০১৫ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত টেকসই উন্নয়নে বাংলাদেশের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সল্যুশন নেটওয়ার্ক (এসডিএসএন), গ্লোবাল মাস্টার্স অব ডেভেলপমেন্ট প্র্যাকটিস এবং যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ ইনস্টিটিউট ও সেন্টার ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট যৌথভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘এসডিজি প্রোগ্রেস অ্যাওয়ার্ড’ পুরস্কারে সম্মানিত করেন।

অনুষ্ঠানে করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করেন সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সল্যুশন নেটওয়ার্কের (এসডিএসএন) প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক জেফ্রি ডি স্যাক্স প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘জুয়েল ইন দ্য ক্রাউন অব দ্য ডে’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন। এবং বলেন, এ পুরস্কার হচ্ছে এসডিজির লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে জোরালো দায়িত্ব পালনের একটি প্রমাণপত্র ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।

আজকের বদলে যাওয়া আত্মমর্যদাশীল বাংলাদেশের শেখ হাসিনাই কারিগর। এক সময় কোন আন্তর্জাতিক বড় প্লাটফরম তো দূরের কথা নিজের দেশে বসেই বিশ্ব মোড়লদের ভয়ে কোন কোন রাষ্ট্রপ্রধানেরা ন্যায় সংগত দাবিও করতে সাহস পেত না। বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা শুধু মাত্র বাংলাদেশের দাবি নিয়েই কথা বলেন না, বিশ্বের যেকোন অধিকার বঞ্চিত মানুষের তিনিই কন্ঠস্বর। করোনার টিকা, জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ক্ষতি, ফিলিস্তিন কিংবা আফগানিস্তান যেকোন ইস্যুতে তিনিই সাহসী উচ্চারণ করে থাকেন। তিনি নিজেকে দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্বমঞ্চেও প্রতিনিয়ত নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন।

লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা। ইমেইল: haldertapas80@gmail.com

এসি

 


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


টেলিফোন: +৮৮ ০২ ৫৫০১৪৩১৬-২৫

ফ্যক্স :

ইমেল: etvonline@ekushey-tv.com

Webmail

জাহাঙ্গীর টাওয়ার, (৭ম তলা), ১০, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

এস. আলম গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান

© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি