ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪

লাইফলাইন শিখিয়ে দিয়ে গেলেন বাবা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৩:৩৯, ৭ জুন ২০২১ | আপডেট: ১৩:৪০, ৭ জুন ২০২১

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

বাবার সাথে প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে ব্যাংকে বসে আছি। বিরক্ত হচ্ছি খুব। যতটা না নিজের ওপর, তার চেয়ে বেশি বাবার ওপর। অনেকটা রাগ করেই বললাম, বাবা- কতবার বলেছি- অনলাইন ব্যাংকিংটা শিখো।

বাবা জবাব দিলো- এটা শিখলে কি হবে? -ঘরে বসেই তুমি এই সামান্য কাজটা করতে পারতে। শুধু ব্যাংকিং না। শপিংটাও তুমি অনলাইনে করতে পারো। ঘরে বসে ডেলিভারি পেতে পারো। খুবই সহজ। কিন্তু এই সহজ জিনিসটাই করবেনা!

করলে আমাকে ঘরের বাইরে বের হতে হতোনা- তাই না? জ্বি বাবা তাই। এখানে এসে ঘণ্টা খানেক অনর্থক বসে থাকতে হতোনা! এরপর বাবা যা বললেন- তাতে আমি নির্বাক হয়ে গেলাম!

বাবা বললেন- এতো সময় বাঁচিয়ে তোমরা কি করো। ফোনেইতো সারাক্ষণ টিপাটিপি করো। কবে শেষদিন তুমি তোমার ফুফুর সাথে কথা বলেছো? দশ হাত দূরে প্রতিবেশী বৃদ্ধ জামিল চাচার খবর নিয়েছো! অথচ, আমরা আপন জনের সাথে দেখা করতে দশ মাইল পথ হেঁটেছি। সময় বাঁচানোর চিন্তা করিনি। মানুষ যদি মানুষের পাশেই না যায়- তবে এতো সময় বাঁচিয়ে কি হবে বলো?

বাবার কথা পাশ থেকে মানুষেরা শুনছেন। আমি চুপচাপ বসে আছি। বাবা বললেন- ব্যাংকে প্রবেশের পর থেকে চারজন বন্ধুর সাথে কুশল বিনিময় করেছি। তুমি জানো- আমি ঘরে একা। তাই ঘর থেকে বের হয়ে আসাটাই আমার আনন্দ। এইসব মানুষের সাহচর্যটাই আমার সঙ্গ। আমারতো এখন সময়ের কমতি নেই। মানুষের সাহচর্যেরই কমতি আছে। ডিভাইস হোম ডেলিভারি এনে দিবে ঠিকই। কিন্তু মানুষের সাহচর্য তো আমাকে এনে  দিবেনা।

মনে পড়ে গেল, দুই বছর আগে আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। যে দোকান থেকে আমি দৈনন্দিন কেনাকাটা করি- তিনিই আমাকে দেখতে গিয়েছিলেন। আমার পাশে বসে থেকে মাথায় হাত রেখেছিলেন। চোখ অশ্রুসিক্ত হয়েছিলো।

বাবা আরও বলেন, তোমার ডিভাইস বড়জোড় একটা যান্ত্রিক ই-মেইল পাঠাবে। কিন্তু আমার পাশে বসে থেকে চোখের অশ্রু তো আর মুছে দিবেনা। চোখের অশ্রু মুছে দেয়ার মতো কোনো ডিভাইস কি তৈরি হয়েছে?

সকালে হাঁটতে গিয়ে তোমার মা পড়ে গিয়েছিলেন। কে তাকে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলো? অনলাইন মানুষের একাউন্ট চিনে। সে তো মানুষ চিনেনা। মানুষের ঠিকানা চিনে। রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষের ঘরতো চিনে না।
এই যে মানুষ আমার শয্যা পাশে ছিলো- তোমার মাকে ঘরে পৌঁছে দিলো। কারণ- দৈনন্দিন নানা প্রয়োজনে একজন আরেকজনকে চিনেছি। 

সবকিছু অনলাইন হয়ে গেলে- মানুষ "হিউম্যান টাচটা" কোথায় পাবে বলো? আর পায় না বলেই- পাশের ঘরে মানুষ মরে গিয়ে লাশ হয়ে থাকে- দূর্গন্ধ না আসা পর্যন্ত কেউ কারও খবরও আর রাখেনা। বড় বড় এ্যাপার্টমেন্টগুলো আমাদের এ্যাপার্টই করে দিয়েছে। পুরো গ্রামে একটা টেলিভিশনে কোনও অনুষ্ঠান একসাথে দেখে সবার আনন্দ আমরা একসাথে জড়ো করতাম। এখন আমরা রুমে রুমে নানা ডিভাইস জড়ো করেছি। আনন্দ আর জড়ো করতে পারিনা।

এই যে ব্যাংকের ক্যাশিয়ার দেখছো। তুমি ওনাকে ক্যাশিয়ার হিসাবেই দেখছো। সেলসম্যানকে সেলসম্যান হিসাবেই দেখছো। কিন্তু আমি সুখ-দুঃখের অনুভূতির একজন মানুষকেই দেখছি। তার চোখ দেখছি। মুখের ভাষা দেখছি। হৃদয়ের কান্না দেখছি। ঘরে ফেরার আকুতি দেখছি। এই যে মানুষ মানুষকে দেখা- এটা বন্ধন তৈরি করে। অনলাইন শুধু সার্ভিস দিতে পারে। এই বন্ধন দিতে পারেনা। পণ্য দিতে পারে, পূণ্য দিতে পারেনা। এই যে মানুষের সাথে হাসিমুখে কথা বলা- কুশলাদি জিজ্ঞেস করা। এখানে শুধু পণ্যের সম্পর্ক নাই। পূণ্যের সম্পর্কও আছে বাবা।

বাবা, তাহলে টেকনোলজি কি খারাপ? না, টেকনোলজি খারাপ না। অনেক কিছু সহজ করেছে নিঃসন্দেহে, সত্য। অনলাইনে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে লাখ লাখ ছেলেমেয়েরা পড়ছে, শিখছে। এটাতো টেকনোলজিরই উপহার। তবে, টেকনোলজির নেশাটাই খারাপ। স্ক্রিন অ্যাডিকশন ড্রাগ অ্যাডিকশনের চেয়ে কোনও অংশে কম না!

দেখতে হবে- ডিভাইস যেন আমাদের মানবিক সত্তার মৃত্যু না ঘটায়। আমরা যেন টেকনোলজির দাসে পরিণত না হই। মানুষ ডিভাইস ব্যবহার করবে। মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরি করবে। কিন্ত ভয়ঙ্কর সত্য হলো- এখন আমরা মানুষকে ব্যবহার করি আর ডিভাইসের সাথে সম্পর্ক তৈরি করি।

মানুষ ঘুম থেকে উঠে আপন সন্তানের মুখ দেখার আগে স্ক্রিন দেখে! সায়েন্টিফিক রিসার্চ ইন্সটিউট এটাকে ভয়ঙ্কর মানসিক অসুখ বলে ঘোষণা করেছে! কিছুদিন আগে আশা ভোসলে একটা ছবি পোস্ট করে ক্যাপশনে লিখেছেন- "আমার চারপাশে মানুষ বসে আছে। কিন্তু কথা বলার মানুষ নেই। কারণ সবার হাতে ডিভাইস।"

বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন- জানিনা ভুল বলছি কিনা, তবে আমার মনে হয়- "তোমরা পণ্যের লোগো যতো চিনো, স্বজনের চেহারা ততো চিনো না!" তাই, যতো পারো "মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরি করো। ডিভাইসের সাথে না। টেকনোলজি জীবন না।" "Spend time with people, not with device."

বাবাকে, "চাচা" বলে কে একজন ডাক দিলো। বাবা কাউন্টারের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন। এই প্রথম আমি বুঝতে পারলাম। বাবা ক্যাশিয়ারের দিকে যাচ্ছেন না। একজন মানুষ মানুষের কাছেই যাচ্ছেন। বাবাকে আমি অনলাইন শিখাতে চেয়েছিলাম। বাবা আমাকে লাইফলাইন শিখিয়ে দিয়ে গেলেন। (ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

এনএস/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি