ঢাকা, শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪

ডিসেম্বরের রণাঙ্গন

ভুট্টোর একই কথা, ‘হায়! হায়! সব শেষ!  

শেখ সাদী

প্রকাশিত : ০৯:০৫, ১৩ ডিসেম্বর ২০২১ | আপডেট: ০৯:০৭, ১৩ ডিসেম্বর ২০২১

১৩ ডিসেম্বরের সকাল। সাড়ে আটটায় জাতিসংঘে নিযুক্ত চীনের স্থায়ী প্রতিনিধি হুয়াং হুয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন কিসিঞ্জার। সঙ্গে ছিলেন জাতিসংঘে আমেরিকার প্রতিনিধি জর্জ বুশ। পরবর্তী সময়ে বুশ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। 

বৈঠকে কিসিঞ্জার বলেন, ‘মিস্টার হুয়াং আপনাকে বুঝতে হবে; আমাদের পক্ষে এই মুহূর্তে পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করা সম্ভব নয়। আইন আমাদের হাত-পা বেঁধে রেখেছে। বন্ধু দেশকে বলতে পারছি না, পাকিস্তানকে অস্ত্র দাও। তবে আমরা কিছু বিকল্প ব্যবস্থা নিয়েছি।’

সকাল সাড়ে নয়টা। নিরাপত্তা পরিষদে পোল্যান্ড একটি খসড়া প্রস্তাব তুলে ধরে। বলা হয়, রাজনৈতিক সমাধানের জন্য বাহাত্তর ঘণ্টার যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা হোক। এই সময়ে পাকিস্তানি সেনা প্রত্যাহার শুরু হবে এবং সেখানকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে। 
পোল্যান্ডের প্রস্তাব শুনে নিউইয়র্কে ভুট্টোকে ফোন করলেন ইয়াহিয়া, পোলিশ প্রস্তাবটি ভালো মনে হচ্ছে। আমাদের তা গ্রহণ করা উচিত। 

ভুট্টো বললেন, কী বলছেন, শুনতে পাচ্ছি না। 

ইয়াহিয়া একই কথা বারবার বলতে থাকলেন। আর ভুট্টো বলতেই থাকলেন, শুনতে পাচ্ছি না। টেলি কথোপকথনের মাঝে নিউইয়র্কের টেলিফোন অপারেটর বললেন, স্যার, আমি তো সব কথাই শুনতে পাচ্ছি। 

ভুট্টো বললেন, তুমি চুপ করো। 

থামল নৌবহর পাকিস্তানিদের সাহায্য করার জন্য ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে আসতে থাকে সপ্তম মার্কিন নৌবহর। 

ঠিক এই সময় রাশিয়ার নৌবহর ভারত মহাসাগরে রওনা দেয়। 

খবরটি জানতে পেরে থমকে দাঁড়ায় সপ্তম নৌবহর। নৌবহর ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয় নিক্সন সরকার। রক্ষা পায় বাংলাদেশ।

এদিকে জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহি মহাসচিব উ থান্টের সঙ্গে দেখা করে পাকিস্তানি গভর্নর মালিকের আত্মসমর্পণের বার্তা, ‘অননুমোদিত’ বলে প্রত্যাহার করার জন্য অনুরোধ করলেন। আগা শাহি দেখা করার আগে উ থান্ট আত্মসমর্পণ বার্তা নিরাপত্তা পরিষদ সদস্যদের দিয়েছেন। 

একটাই আলোচনা কতক্ষণের মধ্যে ইয়াহিয়ার পতন হচ্ছে?

উদভ্রান্ত জুলফিকার আলী ভুট্টো এখন নিউইয়র্কে। 

নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে যুদ্ধ বন্ধের সম্মানজনক প্রস্তাব চান তিনি। রাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে এক বার্তায় জানালেন, এই আবেদনপত্র প্রত্যাহার করুন। নিউইয়র্কের ফিফথ অ্যাভিনিউ হোটেলে ভুট্টো অস্থির পায়চারি করছেন। বিড়বিড় করে বারবার একই কথা বলছেন, ‘হায়! হায়! সব শেষ! 


পূর্ব ও উত্তর দিক থেকে মিত্রবাহিনী ঢাকার ২৩ কিলোমিটারের মধ্যে চলে এসেছে। 

৫৭ নম্বর ডিভিশনের দুটো ব্রিগেড নিয়ে পূর্ব দিক থেকে চলে এসেছে। উত্তর দিক থেকে চলে এসেছে মিত্রবাহিনীর জেনারেল গান্ধর্ব নাগরার ব্রিগেড। মধুমতি পার হয়ে পদ্মার তীরে পৌঁছে যায় চার নম্বর ডিভিশন। 

শত্রুমুক্ত হলো বগুড়ার কাহালু। মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার অধ্যক্ষ হোসেন আলী সহযোদ্ধাদের সাথে নিয়ে ভোর ৪টায় পশ্চিম কাহালুর কাওড়াশ এলাকা থেকে দুপুর ১২টার পর কাহালু থানা চত্বরে পৌঁছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করলেন তিনি।

মুক্তিযোদ্ধারা কাহালুর শীতলাই থেকে চারমাথা পর্যন্ত এলাকায় বিগ্রেডিয়ার তোজাম্মল হোসেন ও মেজর জাকির সহ শতাধিক পাকিস্তানি সেনাকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করান। আত্মসমর্পণ করানোর পর তাদেরকে বগুড়ার গোকুল ক্যাম্পে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়।
পাকিস্তানিরা গণহত্যা চালায় লক্ষ্মীপুর, ডোমরগ্রাম, জয়তুল, গিরাইল, নশিরপাড়া, পালপাড়া গ্রামে। শত্রুমুক্ত হয় মানিকগঞ্জ। সৈয়দপুরে আত্মসমর্পন করে ৪৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অধিনায়কসহ ১০৭জন পাকিস্তানি সেনা। 

চতুর্থ বেঙ্গল রুখে দাঁড়ায় চট্টগ্রামের দিকে এগিয়ে আসা পাকিস্তানি সেনাদের। এখানেই অবস্থান নিচ্ছিল ২৪তম ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের তিনটি কোম্পানি ও বেশকিছু ইপিসিএএফ’সহ বহু পাকিস্তানি সেনা। প্রচন্ড আক্রমণে টিকতে না পেরে পালিয়ে যায় পাকিস্তানিরা। 

রাত নয়টায় টাঙ্গাইল ওয়াপদা রেস্ট হাউসে বৈঠকে বসলেন ব্রিগেডিয়ার ক্লের ও বিগ্রেডিয়ার সান সিং। যুদ্ধ কৌশল ঠিক করতে। বৈঠকের শুরুতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশংসা করলেন নাগরা। বললেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা যদি আমাদের বিনা বাধায় এতোটা পথ পাড়ি দিতে সাহায্য না করতেন তাহলে আমরা যুদ্ধ-ক্লান্ত হয়ে যেতাম। পথে শেষ হতো শক্তি। ‘

এদিকে ডেমরা এসে পৌঁছে গেছে কর্নেল শফিউল্লাহর ‘এস ফোর্স’।

মিত্রবাহিনীর অগ্রবর্তি দল শীতালক্ষ্যা ও বালু নদী অতিক্রম করে  ঢাকার নয় কিলোমিটারের মধ্যে চলে আসে। 

আক্রমণ করতে পাকিস্তানি সেনারা অবস্থান নিয়েছে ঢাকার খিলগাঁ-বাসাবো এলাকায়। 

সাংবাাদিক সেলিনা পারবীনকে সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়, রাজাকার-আলবদর কর্মীরা। ১৮ ডিসেম্বর ক্ষত-বিক্ষত মরদেহ পাওয়া যায় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে।

শেখ সাদীঃ লেখক ও গবেষক

এসবি/ 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি