ঢাকা, বুধবার   ১১ ডিসেম্বর ২০২৪

ইমরানের ‘কালচক্র’

অন্তর্ভেদী দৃষ্টিসম্পন্ন এক গদ্যকারকেই খুঁজে পাবেন

প্রকাশিত : ১৪:৪৩, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ১৮:৫৫, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

নতুন লেখকদের বই নিয়ে পাঠকের এক ধরনের শংকা থাকে। শংকা সময় অপচয়ের, ক্ষেত্র বিশেষ অর্থেরও। এমন দ্বৈত শংকা নিয়ে যারা আবদুল্লাহ আল ইমরানের দ্বিতীয় উপন্যাস ‘কালচক্র’ পড়তে বসবেন তারা পাঠ শেষে একরকম অপরাধবোধে ভুগবেন। এমন উপলব্ধি হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয় যে, কোনো তরুণ লেখক নয়, নিজস্ব ভাষা ও অন্তর্ভেদী দৃষ্টিসম্পন্ন পরিণত এক গদ্যকারকেই আপনি খুঁজে পেলেন। আমারও তাই হয়েছে। মনে হয়েছে, কালের চক্রে হারিয়ে যাবে অনেক কিছুই। কিন্তু থাকবে ‘কালচক্র’, থাকবে আবদুল্লাহ আল ইমরান।
‘কালচক্র’ দক্ষিণাঞ্চলের, বিশেষ করে খুলনার পাটকল শ্রমিক এলাকার পটভূমিতে লেখা একটি সামাজিক উপন্যাস; যেখানে হিন্দু-মুসলামান প্রেম, পাটকল ঘিরে বৈচিত্র্যময় রাজনীতি, শেকড়হীন মানুষের ক্ষয়িষ্ণু আদর্শ-নৈতিকতা, শ্রমিক পরিবারগুলোর দু:খ-দুর্দশা, কিশোরবেলার বন্ধুত্ব এবং নদীতীরের জীবন ব্যবস্থা সুনিপুনভাবে উঠে এসেছে।
একটি আত্মহত্যার ঘটনা দিয়ে উপন্যাসের শুরু। ক্রমেই যে ঘটনা উপন্যাসজুড়ে প্রভাব ফেলে। প্রথম দুই পৃষ্ঠা পড়েই মনে হবে এ উপন্যাস ভেতরে টানছে। পাটকলকে কেন্দ্রে রেখে লেখক উপন্যাসে একসঙ্গে অনেকগুলো গল্প বলেছেন। প্রতিটি গল্পই একে অপরের পরিপূরক।
ধর্ম ও পরিস্থিতিরি চাপে অসহায় পলাশ-চন্দ্রলেখার জন্য খারাপ লাগবে আপনার। হিসাব মিলাতে হিমশিম খাবেন আপনি। পলাশ ও চন্দ্রলেখাকে নিয়ে লেখক লিখেছেন, ‘জীবনে সব চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কী মেলে? কিছু হিসাব তো বাকি থেকে যায়! পৌষের কোনো কোনো নির্ঘুম রাতে খুলে গেলে হৃদয়ের দখিন দুয়ার, সেসব অনির্ণিত হিসাবেরা আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। তাদের দাবি থাকে, অভিমান থাকে, প্রত্যাশা থাকে। কিছুতেই তাদের আমরা এড়াতে পারি না। এড়াতে পারি না বলেই বিপুল কৌতূহলে ফের জোড়া দিতে বসি হারানো বাঁশির সুর, ঘাসফুল ছুঁয়ে দেখা গোধুলি লগ্ন। রাতভর চেষ্টায় যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ি, যখন মনে হয় আর মিলছে না, তখন ভাবনাগুলো তুলে রাখি অন্য কোনো রাতের কাছে, প্রতীক্ষায় থাকি অন্য কোনো সময়ের। পলাশ কী জানে পৌষের রাতেরা বড় দীর্ঘ হয়!
মন কেমন করবে মিষ্টি বউদির জন্য।
শুরুতে সহজলভ্য নারী মনে হলেও গল্প যতো উন্মোচিত হবে আপনি আবিস্কার করবেন স্বামীভক্তি আর দৃঢ় ব্যক্তিত্বের এক ভিন্ন নারী মূর্তিকে। মিষ্টি বৌদির জীবনবোধ আপনাকে চমকে দেবে। যেমন উপন্যাসের এক জায়গায় লেখক লিখেছেন, মিষ্টি ভাবে, কী ভীষণ এক আবেগে সারাজীবন আমরা ভুল মানুষের কাছেই প্রত্যাশা করে যাই। প্রতীক্ষায় থাকি, একদিন ভুল মানুষটাই সঠিক হয়ে উঠবে। টেনে নেবে বুকের খুব কাছে। কিন্তু আমাদের সেই অনন্ত প্রতীক্ষার আর অবসান ঘটে না। কেটে যায় একটা জনম।
সোলায়মান মিয়া এবং সাজিয়া বেগম শ্রমিক অঞ্চলের গণমানুষের প্রতিনিধি। নিত্য-টানাপড়েন, হাহাকারের মাঝেও ভালোবাসার অপূর্ব নিদর্শন আছে তাদের গল্পে। আলাভোলা, গানপাগল সোলায়মান মিয়ার ভেতর সব হারানো এক কিশোরের বাস, যে ফিরতে চায় নিজের গ্রামে, ফিরতে চায় হারানো শৈশবে, অথচ না ফিরতে পেরে হাসফাস করে বহমান জীবনে। এই সহজ-সরল চরিত্রেরই দিনশেষে কিভাবে কিভাবে যেন প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। উপন্যাস পড়তে পড়তে আপনিও নিজেকে মিছিলেন অগ্রভাবে আবিস্কার করবেন, দেখবেন স্লোগান দিচ্ছেন সমানে।
আমজাদ প্রেসিডেন্ট আমাদের চারপাশের কুটিল মানুষদেরই প্রতিচ্ছবি। মিলের শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে শুরু করে গ্রাম্য রাজনীতি কিভাবে নিজের দখলে নিতে হয়, কিভাবে একটি দাবি আদায়ের আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি বদলে দিতে হয় এবং বৈরী পরিস্থিতি নিজের দখলে নিতে হয় তার অসাধারণ উপস্থাপন আছে আমজাদ প্রেসিডেন্ট চরিত্রে। শেষে কালচক্র নামকরণের সার্থকতাও মিলবে এই চরিত্রের মাঝে। কার্যকালাপে নিহিত রয়েছে।
জগলু, হারুন, মন্টু এই উপন্যাসকে গতি দিয়েছে। তৈরি করেছে ভিন্ন দ্যোতনা। মধ্যরাতে জাহাজ থেকে জগলুর তেল চুরির ঘটনা, মিষ্টি বৌদির প্রতি হারুণের প্রাগাঢ় টান, এক যুগ নিখোঁজ থেকে ভবানীপুরের দৃশ্যপটে মন্টুর হঠাৎ আগমন পাঠককে সচকিত করবে, দেবে টানটান উত্তেজনা।
আশালতা বেদীর কথা না বললেই নয়। ছোট্ট কিন্ত খুব তাৎপর্যময় একটি চরিত্র। উপন্যাসের শেষভাগে তার বিদায় পর্বটি চোখ আদ্র করবে। আশালতা দেবীকে নিয়ে লেখক উপন্যাসের ফ্লাপে লিখেছেন, ‘...শীতে তার কষ্ট হচ্ছে না ঠিক। কিন্তু অন্য এক কষ্ট শরীর কাঁপিয়ে ভেতরে ভেতরে নীল করে দিচ্ছে। ভয়ানক সেই কষ্টের নাম ‘স্মৃতিকাতরতা’। মানুষের জীবন হারানোর জীবন। জন্মের পর থেকেই হারানোর তালিকাটা তাই দীর্ঘ হতে থাকে। শৈশব হারায়, কৈশোর হারায়, হারিয়ে যায় যৌবনও। হারায় বাবা-মা, স্বামী-স্ত্রী, কারো কারো সন্তান। একসময় চুল, দাঁত, এমনকি চোখের দৃষ্টিশক্তিও হারায় মানুষ। জীবন থেকে এভাবে একের পর এক সবকিছু হারাতে থাকলেও স্মৃতি হারায় না। বুকের গহিনে ঠিকই গুটিশুটি মেরে থেকে যায়। স্মৃতির প্রতি তীব্র কাতরতা থেকে তাই আমৃত্যু মুক্তি মেলে না মানুষের। আশালতা দেবীরও মেলেনি...’
জীবনের এমন অজস্র জটিল হিসাব-নিকাশের গল্প নিয়ে এ উপন্যাস। গল্প অসংখ্য হারিয়ে ফেলা অনুভূতিরও। কাহিনী যত এগোবে, তত উন্মোচিত হবে মৃত এক শিল্প অঞ্চলের বহুমাত্রিক মানুষের বৈচিত্র্যময় জীবনবোধ। ‘কালচক্র’ পাটকলনির্ভর নদীঘেরা জনপদের ওপর রচিত এমন এক মানবিক আখ্যান, যেখানে জীবনের ভাঙা-গড়া, আনন্দ-বেদনার গল্পেরা চক্রাকারে বয়ে চলে অবিরাম।
মনে হবে বাড়িয়ে বলছি, কিন্তু এ কথা না বললে অন্যায় হবে যে, ‘কালচক্র’ আপনাকে ‘হাজার বছর ধরে’, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ কিংবা ‘বরফগলা নদীর’ মতো ক্লাসিক উপন্যাস পাঠের তৃপ্তি দেবে।
আরোপিত জটিল বাক্য এড়িয়ে, চমৎকার শব্দের ব্যবহার, উপমা প্রয়োগের মুন্সিয়ানায় এবং ঘটনার পরম্পরায় লেখক একটি সময়োত্তীর্ণ উপন্যাস রচনা করেছেন বলেই আমার মনে হয়েছে। পাটকলগুলোর উত্থান এবং বিস্তার নিয়ে বাংলা সাহিত্যে অনেক উপন্যাস লেখা হয়েছে। কিন্তু পতন নিয়ে, তার প্রভাব নিয়ে এমন মনে দাগ কাটবার মতো কাজ আর হয়েছে কিনা আমার জানা নেই।
আমার এই ভাবনাকে অবশ্য শক্ত একটি ভিত্তি দিয়েছেন দেশের বরেণ্য কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। এই উপন্যাসটি নিয়ে নিজের মুগ্ধতার কথা তিনি একটি জাতীয় পত্রিকার সাক্ষাৎকারসহ বিভিন্ন যায়গায় বলেছেন। এমনকি নতুন সংষ্করণের ব্যাক কাভারে দেখলাম একটি ছোট্ট মূল্যায়নও লিখেছেন তিনি। আগ্রহী পাঠকদের জন্য সেটি তুলে দেয়া জরুরি মনে করছি।
সেলিনা হোসেন কালচক্র নিয়ে লিখেছেন, ‘বিষয়কে ধরা, ধরে উপস্থাপন করা, তার জন্য ভাষা ও চরিত্র নির্মাণ এবং এ সবকিছুর মধ্য দিয়ে একটি শিল্পিত উপন্যাস পাঠককে উপহার দেয়া একজন লেখকের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। কালচক্র উপন্যাসে এ দায়িত্ব পালনে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন আবদুল্লাহ আল ইমরান। কালচক্র যদি একটি সময়কে ধরে চক্রের আবর্তন হয় তবে এ উপন্যাসে লেখক খুব ভালো ভাবে তা ধরতে পেরেছেন। আর এই ধরার ভেতর দিয়ে আমাদের সাহিত্যে একটি নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন ঘটেছে।’
একজন প্রতিশ্রুতিশীল লেখকের জন্য প্রতিষ্ঠিত লেখকের এমন মন্তব্য নিশ্চিয়ই বিরাট পাওয়া। সেলিনা হোসেন যে যথার্থই মূল্যায়ন করেছেন উপন্যাসটি পাঠ করলে পাঠক মাত্রই তা বুঝতে পারবেন। উপন্যাসটি অবশ্য ইতোমধ্যেই পাঠকনন্দিত হয়েছে।
কিন্তু ইমরানের দূর্ভাগ্য যে, এত ভালো মানের উপন্যাস হবার পরও কালচক্র পর্যাপ্ত পাঠ-প্রতিক্রিয়া বা রিভিউ পায়নি। এর দায় অবশ্য ইমরানের সচেতন পাঠকদের। তথাকথিত জনপ্রিয় লেখক ও বইয়ের প্রচারের ভীড়ে একটি ভালো বইকে আরও বেশি পাঠকের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়াই পাঠক হিসেবে আমাদের কর্তব্য। অস্বীকার করব না, সে দায়িত্ব পালনে আমার নিজেরও বেশ দেরি হয়ে গেছে।
কালচক্রের বহুল প্রচার ও প্রসার আশা করছি।
উপন্যাসের নাম : কালচক্র
লেখক : আবদুল্লাহ আল ইমরান
প্রকাশক : অন্বেষা
প্রচ্ছদ : সানজীদা পারভীন তিন্নি
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ২০০

(সংকলিত)

এসএ/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি