ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

মার্ক্সবাদী অর্থনীতিবিদ আবু মাহমুদের ঋণ শোধ হবে না

কামরুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশিত : ১৭:৪৫, ৯ জুলাই ২০২০ | আপডেট: ১৭:৪৭, ৯ জুলাই ২০২০

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবু মাহমুদ

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবু মাহমুদ

তার কাছে আমাদের অনেক ঋণ। এ ঋণ কখনো শোধ হবার নয়। অথচ পহেলা জানুয়ারি তার শততম জন্মদিন নীরবে চলে গেল। আজ যাচ্ছে ৩২তম মৃত্যুবার্ষিকী। কিংবদন্তি এই অর্থনীতিবিদ বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে পঞ্চাশের দশক থেকে ছিলেন সোচ্চার। ছিলেন দুই অর্থনীতি তত্ত্বের প্রবক্তা। আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের এক অগ্রপথিক। তিনি কি বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাবেন?

আমি বলছি মার্ক্সবাদী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবু মাহমুদ স্যারের কথা। বেঁচে থাকলে এ বছর পহেলা জানুয়ারি তার শততম জন্মদিন জাতি পালন করতো। এই মহাত্মা জ্ঞানতাপসের জন্ম শতবার্ষিকী পালনের তোড়জোড় চলতো। বিধিবাম, ৩২ বছর আগে ১৯৮৮ সালের বর্ষণমুখর এক সন্ধ্যায় তিনি অনন্তলোকে যাত্রা করেন। আজ ৯ জুলাই এই মনিষীর ৩২ তম মৃত্যুবার্ষিকী।

এই জ্ঞান তাপসের জন্ম ১৯২০ সালের ১ জানুয়ারি তদানীন্তন নোয়াখালী জেলার রামগঞ্জে পৈতৃক বাড়িতে। অজপাড়া গাঁয়ের পাঠশালায় তার হাতেখড়ি। ঐতিহ্যবাহী ঢাকা কলিজিয়েট স্কুল থেকে ১৯৩৬ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৩৮ সালে আইএ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। শুরু হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তার জীবনভর সম্পর্ক। ১৯৪৪ সালে অর্থনীতিতে অনার্সসহ মাষ্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। যোগ দেন অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষকতায়। ১৯৫৭ সালে রকফেলার ফেলো হিসেবে পিএইচডি করতে যুক্তরাষ্ট্রের জগদ্বিখ্যাত হার্ভাড ইউনিভার্সিটিতে যান।

তিনি ১৯৬২ সালে হার্ভার্ড থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ওপর অভিসন্দর্ভ লিখে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ঐ সময়ে তার জীবনে আসে বড় রকমের মোড়পরিবর্তন। 

তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘মার্ক্সীয় বিশ্ববীক্ষা’র মুখবন্ধে হার্ভাডে জগতের সেরা অর্থনীতিবিদ অধ্যাপকদের সাহচর্য লাভের দুর্লভ সুযোগ পেয়ে কতো লাভবান হবার পাশাপাশি তার মনে জাগা প্রশ্ন ধনী-গরীবের বৈষম্য কেন’র সদুত্তর না মেলার হতাশার কথা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছেন। 

তিনি লিখেছেন, ‘১৯৫৮ সালে তখন আমার জীবন ও মন-মানসিকতায় বিরাজ করছিল এক গভীর নৈরাশ্যজনক ও সংকটাপন্ন অবস্থা।....যারা সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, কেন বিশ্বের সকল কিছুর ওপর তাদের ক্রমবর্ধমান অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি ন্যায্য বলে বিবেচিত হয়? এবং যারা গরীব ঘরে জন্মায়, তাদের জীবনটা কেন গ্রীক ট্রাজেডিতে রূপান্তরিত হয়?’

পূজিবাদী অর্থনীতিবিদদের অসার যুক্তি খন্ডাতে তখন থেকে শুরু করেন জ্ঞান অর্জনের নতুন ধারা, ‘তাদের সমস্ত যুক্তি দারিদ্র্যক্লিষ্ট, অনাহার-অর্ধাহারে জর্জরিত ও রোগ-শোকে ম্রিয়মান একটি দেশের নাগরিক হিসেবে আমার মনে নিম্নতম সান্তনার প্রলেপ দিতে ব্যর্থ হয়। প্রকৃতপক্ষে ঐ সময় আমি বুঝতে সক্ষম হই যে, সমাজে ধনী-দরিদ্র, শোষক-শোষিত, মালিক-শ্রমিক এ সকল সম্পর্ক অন্যান্য সম্পর্কের তুলনায় নির্ধারকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।’

হার্ভার্ড থেকে ফিরে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আইয়ূব খানের সামরিক স্বৈরশাসনে পূর্ব বাংলা তখন নিষ্পেষিত। পাকিস্তান অবজারভার, পূর্বদেশ ও সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে তার পূর্ব বাংলার বঞ্চনা আর পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ নিয়ে গবেষণা প্রবন্ধ নিবন্ধ। আইউব-মোনেম জুটি আর তাদের ক্রীড়নক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের রোষানলে পড়েন এই মার্ক্সবাদী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ। সে আরেক ট্রাজেডি! 

প্রবীণ অর্থনীতিবিদ প্রফেসর এম এন হুদা দীর্ঘ ছুটি নিলে তারপর জৈষ্ঠ সবচে জনপ্রিয় এই শিক্ষককে অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান করতে উপাচার্য অস্বীকৃতি জানায়। 

মাহমুদ স্যারকে ডিঙিয়ে প্রফেসর ড. আনিসুর রহমানকে উপাচার্য চেয়ারম্যান করতে চান। এ বিষয়ে আনিসুর রহমান স্যার তার জীবনকথা ‘পথে যা পেয়েছি’-১ এর ৫৫ পাতায় লিখেছেন, ‘ড. মাহমুদ হুদা স্যারের পরে সবচে সিনিয়র, কিন্তু মার্ক্সবাদী মাহমুদ স্যারকে নতুন ভিসির একবারে পছন্দ নয়। তিনি আমাকে ডেকে হেডের পদটি গ্রহণ করতে বলেন। মাহমুদ স্যার আমার শিক্ষক ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম এর থিসিস গ্রুপের ছাত্র হিসেবে তার গাইডেন্সেই থিসিস করি এবং সেই সুবাদে সার্বিকভাবে এম এর জন্য পড়াশোনাতেও তার কাছে সস্নেহ গাইডেন্স পাই। ভিসিকে আমি বলি যে মাহমুদ স্যার আমার সিনিয়র এবং আমার শিক্ষক, তিনি থাকতে আমি হেডের পদ নিতে পারি না।... আমি কিছুতেই তাকে ডিঙিয়ে এই পদ নিতে পারি না। ভিসির মুখ শক্ত হয়ে গেল..’ হায়রে, বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতি!

মাহমুদ স্যার কে হেড তো করাই হলো না একই সাথে আইউব-মোনেম স্বৈরাচারের দোসর ভিসি অধ্যাপক আনিসুর রহমানকে পদত্যাগে বাধ্য করলো। নীরবে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় এয়ারপোর্টে মাহমুদ স্যার কে দেখে আনিস স্যার অবাক হয়েছিলেন। মাহমুদ স্যারকে ডিঙিয়ে এরপর কেটি হোসেন কে হেড করা হলে তিনি কোর্টের দ্বারস্থ হন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি বিচারপতি সৈয়দ মুর্শেদ শুনানি শেষে ভিসি বনাম ড. মাহমুদ মামলায় মাহমুদ স্যারের পক্ষে এক ঐতিহাসিক রায় দেন।

জাতির দুর্ভাগ্য, তারপরও কিছুদিনের মধ্যেই তাকে ও প্রিয় স্বদেশ ছাড়তে বাধ্য করা হলো। পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক বঞ্চনাসহ কড়া সমালোচনামূলক লেখালেখি ও গবেষণার জন্য তাকে স্বৈরশাসকের কোপানলে পড়তেই হলো। ১৯৬৬ সালে আইউবের লেলিয়ে দেওয়া কুখ্যাত এনএসএফের পান্ডারা মাহমুদ স্যারের ওপর তার প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অতর্কিত হামলা করে মারাত্মকভাবে আহত করে। ছাত্রনেতা মাহবুব উল্লাহ, আহমেদ কামাল, মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ, আফম মাহবুবুল হকসহ অনেক সাধারণ ছাত্র সে সময় ফুলার রোডে তার বাসভবন পালা করে সার্বক্ষণিক পাহারা দিয়েছে। 

কিংবদন্তি এই তুমুল জনপ্রিয় অধ্যাপক ১৯৬৭ সালে দেশত্যাগে বাধ্য হন। যোগ দেন ব্যাংককসহ ইউএন এসকাপে অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে। 

স্বাধীনতার পর প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের উদ্যোগে দীর্ঘ দশ বছরের নির্বাসন জীবন শেষে ১৯৭৭ সালে ফিরে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি আমাদেরকে অনার্স ও মাস্টার্স ক্লাসে পড়াতেন মার্ক্সিজম আর উন্নয়ন অর্থনীতি। কতিপয় পূজিপতির শোষণ, শ্রমিক কৃষকদের ঠকিয়ে পূজিপতিদের পূজি গঠন ও উত্থান নিয়ে তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্লাস নিতেন। 

আমাদের ক্লাসে তিনি মার্ক টোয়েনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলতেন, ধনীরা ডাকাতি করলে বল ব্যবসা। আর শ্রমিক কৃষক ন্যায্য মজুরি আর কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্যের দাবি তুললে বলা হয় বিশৃঙ্খলা। পূজিপতিরা হলো হোমোজিনিয়াস বাঞ্চ অব লায়ার্স। লাইব্রেরি ওয়ার্ক করতেন প্রচুর। তার গবেষণা কাজে আমাদেরকে ও নিতেন পরম মমতায়। তিনি আমাদের শিক্ষক ছিলেন। আমাদের অনেক শিক্ষকেরও শিক্ষক ছিলেন। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছিল তার সর্ব উপস্থিতি। তার লাল রঙের ছোট্ট গাড়ি ঠাসা থাকত হরেকরকম বই আর গবেষণার কাগজে। দুকাঁধে কাপড়ের ব্যাগভর্তি বই নিয়ে লাইব্রেরি থেকে তিনি হেঁটে কলাভবনে আসছেন অথবা ফুলার রোডের বাসায় ফিরছেন। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্ল্যাগশিপ প্রফেসর। তার ক্লাসে নানা ডিপারটমেন্টের ছাত্ররাও লেকচার শুনতে আসতো। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দশকের পর দশক টিএসসিতে তার বক্তৃতা শুনে স্বাধিকারের চেতনা, স্বাধীনতার স্বপ্ন দানা বেঁধেছে। সামরিক শাসন, স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর অসীম সাহস পেয়েছি।

তাই প্রশ্ন জাগে, মহাত্মা এই শিক্ষাগুরু কি বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাবেন? জীবনভর লড়াকু ড. মাহমুদ শোষিত নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সমাজতান্ত্রিক সমাজ অর্থনৈতিক মুক্তির পথ ভেবেছেন। তার ৩২তম মৃত্যু বার্ষিকীতে জানাই অতল শ্রদ্ধা। শোষণ বঞ্চনাহীন সমাজ বিনির্মাণে আজ প্রয়োজন ড. মাহমুদ স্যারের মতো অনেক শিক্ষাগুরুর। আসুন, করোনা মহামারীর আকালশেষে দিকপাল এই অর্থনীতিবিদের জন্মশতবর্ষ পালনের মাধ্যমে তাকে স্মরণ করি।

লেখক: সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেসক্লাব ও জেষ্ঠ অর্থনৈতিক রিপোর্টার

এমবি//


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি