ঢাকা, মঙ্গলবার   ১৯ মার্চ ২০২৪

উপস্থাপনায় শারীরিক সৌন্দর্য গুরুত্বপূর্ণ নয়: সামিয়া রহমান

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৯:২৬, ২৭ মে ২০১৮ | আপডেট: ১৯:১৭, ২৮ মে ২০১৮

সামিয়া রহমান

সামিয়া রহমান

সামিয়া রহমান। গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব। সংবাদ শুধু শোনার বিষয় নয়, সংবাদ শ্রোতা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনবে বা সংবাদের সঙ্গে আরও বেশি একাত্ম হবে- এমন ধারা এদেশে সম্ভবত তিনি-ই প্রথম প্রবর্তন করেন। সংবাদকে আরও বেশি শ্রোতা ও দর্শনপোযোগী করতে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন মানুষটি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক সামিয়া রহমানের টেলিভিশন ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল সায়মন ড্রিংয়ের হাত ধরে, একুশে টেলিভিশনে। একে একে কাজ করেছেন এনটিভি, দেশ টিভি, একাত্তর টিভিতে। বর্তমানে নিউজ ভিত্তিক চ্যানেল নিউজ টুয়েন্টিফোর-এর হেড অফ কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স পদে কর্মরত।

সামিয়া রহমান বিশ্বাস করেন, ক্যামেরার সামনে কাজ করার জন্য মানুষের বাহ্যিক সৌন্দর্য-ই মুখ্য নয়, বরং স্মার্টনেস তথা একজন মানুষের ভেতরকার সৌন্দর্য্যটাই বেশি জরুরি। সংবাদ পাঠ করতে বা টকশো সঞ্চালনা করতে হলে সমকালীন বিশ্ব সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখতে হবে। এক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ খুব জরুরি নয়, তবে আত্মবিশ্বাস, স্মার্টনেস, শুদ্ধ উচ্চারণ ও চলমান বিষয়ে জানাশোনা থাকলে যে কেউ টিভিতে সংবাদ উপস্থাপনা ও টকশো সঞ্চালনায় ভালো করতে পারবেন বলে মনে করেন তিনি।

সামিয়া রহমানের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক আলী আদনান

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আমাদের দেশে যারা সংবাদ উপস্থাপনা করছে তাদের সম্ভাবনা কেমন?

সামিয়া রহমান: তারা খুবই সম্ভাবনাময়ী। আমরা আগের সেই জটিল ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি। এখন যারা সংবাদ উপস্থাপক তারা শুধু লিখিত সংবাদ পাঠ করছে তা নয়, বরং তারা নিজেরা সরাসরি ভূমিকা রাখতে পারছে নিউজ ম্যানেজমেন্টে। তারা সাক্ষাৎকার নিতে পারছে। মনে রাখবেন, একজন মানুষ তখনই ইন্টারভিউ নিতে পারেন যখন বিষয়টা সম্পর্কে ভালো বুঝেন ও জানেন। আগে যারা সংবাদ উপস্থাপনা করতেন তারা ছিলেন শুধুমাত্র নিউজ রিডার। এখন আমরা সেখান থেকে অনেকটা সরে আসতে পেরেছি। একজন সংবাদ উপস্থাপকের ভূমিকা এখন অনেকটা সাংবাদিকের মতো। তবে হ্যাঁ, আমরা সব মিলিয়ে বলতে গেলে কাংখিত লক্ষ্যে এখনো পৌঁছুতে পারিনি।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: একজন তরুন যখন সংবাদ উপস্থাপনায় আসতে চায় তার কেমন প্রস্তুতি দরকার?

সামিয়া রহমান: সংবাদ উপস্থাপনার ক্ষেত্রে চাকরির বাজারটা এখন অনেক বড়। এখন যারা এ পেশায়িআসতে চায় তারা এটাকে চাকরি হিসেবে নিতে পারে। বিভিন্ন চ্যানেলগুলো এখন লোভনীয় অফার দিচ্ছে। যদি কারো যোগ্যতা থাকে তাহলে এ পেশায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব। এখানে একটা প্রশ্ন এসে যায় সেটি হচ্ছে- এতোগুলো চ্যানেল, এতো এতো সংবাদ উপস্থাপক। কিন্তু ক’জনকে মানুষ চেনে বা জানে বা কয়জনের চেহারা মানুষ মনে রাখে। তাই যারা টিকে থাকতে চায় তাদেরকে কাজ দিয়েই টিকে থাকতে হবে। এই টিকে থাকার প্রস্তুতিটাই আমি নিতে বলব। যিনি খবর পড়বেন তার কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স সম্পর্কে ধারণা রাখা উচিত। দেশের সার্বিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে, সমকালীন বিশ্ব সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখতে হবে। যদি এই ধারনা না থাকে তাহলে শুধু রিডিং পড়া হবে। উপস্থাপনা হবে না।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: উপস্থাপনায় বাহ্যিক সৌন্দর্য্ ও স্মার্টনেস কতটা জরুরি?

সামিয়া রহমান: স্মার্টনেস ও শারীরিক সৌন্দর্য এক কথা নয়। যেকোনো ধরণের উপস্থাপনার জন্য আমরা স্মার্টনেসকে খুব বেশি গুরুত্ব দিই। নিজের আকর্ষণীয় ব্যাক্তিত্বটাকে ফুটিয়ে তোলা খুব দরকার। তবে শারীরিক সৌন্দর্য কোনো বড় বিষয় নয়। সৌন্দর্য একেক জনের কাছে একেক রকম। আমি যখন যে চ্যানেলে কাজ করেছি, নিউজ প্রেজেন্টার রিক্রুট করেছি কখনোই শারীরিক সৌন্দর্যকে প্রাধান্য দিইনি। আমরা দেখেছি আবেদনকারী ছেলে বা মেয়েটা স্মার্ট কিনা, কথা বলতে পারে কিনা, অনর্গল বলতে পারে কিনা, বিশ্ব সম্পর্কে জানে কিনা। যে কেউ সেজেগুঁজে সুন্দর হতে পারে। টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে কিছু না কিছু মেকআপ নিয়ে সবাই আসে। তাই এখানে ভেতরকার সৌন্দর‌্য প্রকাশ করাটাই জরুরি। আমি মনে করি, ক্যামেরার সামনে বসার আগে যে বিষয়ে কথা বলবো জেনে বুঝেই করবো।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: যেহেতু আমাদের দেশে সংবাদ উপস্থাপনার উপর আলাদা করে একাডেমিক শিক্ষার সুযোগ নেই, তাই আগ্রহী তরুণরা এ বিষয়ে কোথায় শিখবে?

সামিয়া রহমান: সংবাদ উপস্থাপনার জন্য প্রশিক্ষণের কোনো দরকার আছে বলে আমি মনে করি না। আমি একসময় প্রশিক্ষণ করাতাম, সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। আমার যদি উচ্চারণে সমস্যা থাকে তাহলে আমরা বুঝতে পারিনা। প্রশিক্ষণে অনেকের মাঝে সেটা বুঝতে সহজ হয়। অন্যথায় কেউ যদি বিবিসি, সিএনএন, ইন্ডিয়ার এনডিটিভি বা আমাদের টেলিভিশনগুলো নিয়মিত ফলো করে, তাহলে খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা না। ওখানে ছেলে মেয়েরা চমৎকার উপস্থাপনা করছে। মিডিয়াতে আসতে গেলে সবচেয়ে বেশি জরুরি আত্মবিশ্বাস। পাশাপাশি স্মার্টনেস, সঠিক উচ্চারণ ও বিশ্বসম্পর্কে জানাটাই জরুরি। বাংলায় যে দক্ষতা থাকা উচিত ইংরেজিতেও সেই দক্ষতা থাকা উচিত। যদিও বা অনেকটাই অনুবাদ হয়ে আসে, এরপরও প্রচুর নাম ও শব্দ আছে যেগুলো ইংরেজিতে পড়তে হয়। আমরা এখন বিশ্ব নাগরিক। খবরের বড় অংশ থাকে ইন্টারন্যাশনাল খবর। তাই ‍উপস্থাপনার জন্য ইংরেজি জানা আবশ্যক।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: সংবাদ উপস্থাপনকদের মানসিকতা বা দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হওয়া উচিত?

সামিয়া রহমান: আমাদের এখানে ছেলেমেয়েদের মধ্যে একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। সেটা হলো সবাই দু`একবছর কাজ করলে নিজেকে স্টার ভাবে। রাস্তায় তাকে কেউ চিনতে না পারলে হতাশ হয়। আবার চিনতে পারলে খুব উৎফুল্ল হয়। আমি বলব, এত দ্রুত হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আবার এতো দ্রুত আনন্দিত হওয়ার কিছু নেই। আজকাল স্টার হওয়ার এই যে প্রবণতা, স্টার হওয়া এতো সোজা না। কাজ দিয়ে মানুষ চিনবে। আর টেলিভিশন উপস্থাপনা স্টার হওয়ার জায়গা না। এটা হচ্ছে, আমি সাধারণ মানুষের কাছে যাব। হ্যাঁ, মানুষ চেনে কিনা, জানে কিনা, ভালোবাসে কিনা সেই প্রসঙ্গ আসতে পারে। সেটা কাজ দিয়েই হবে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: নতুনরা যদি ক্যামেরার সামনে বিব্রত হয় সেটা কাটিয়ে উঠার উপায় কী?

সামিয়া রহমান: প্রচুর প্র্যাক্টিসের মাধ্যমে জড়তা কাটিয়ে উঠা সম্ভব। জড়তা আসলে নিজেকে নিজে প্রবোধ দেব, ‘আরে ধূর, এটা কোনো ব্যাপার-ই না।’

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: বর্তমানে যারা বিভিন্ন গণমাধ্যমে কাজ করছে তাদের কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

সামিয়া রহমান: সবাই ভালো কাজ করছে। তারা এটাকে প্রফেশনাল জায়গায় দাঁড় করিয়েছে এবং ভালো কাজ করছে বলেই এখন অসংখ্য তরুণ এ পেশায় আসতে চাচ্ছে। সবাই নিউজ প্রেজেন্টার হতে চাচ্ছে। আমার কাছে মনে হয়, সবাই নিউজ প্রেজেন্টার হওয়ার দরকার নেই। জীবনে সবাইকে সবকিছু হতে হবে কেন? যার যতোটুকু দক্ষতা সে সেটা দিয়েই কাজ করা উচিত। সবার মধ্যে চেহারা দেখানোর প্রবনতা থাকায় কেউ আর পেছনে কাজ করতে চায় না। কিন্তু রিপোর্টি, এডিটিং, ডকুমেন্টারি কেউ করতে চায় না। কিন্তু এগুলোও খুব সম্ভাবনাময়ী পেশা।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: যারা টিভিতে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতে চায়, তারা নিজেকে কিভাবে প্রস্তুত করবে?

সামিয়া রহমান: সংবাদ উপস্থাপনা ও অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় তেমন একটি পার্থক্য নাই। যে ধরণের অনুষ্ঠান করতে চাচ্ছি সেই ধরনের অনুষ্ঠানের সঙ্গে মিল রেখে নিজেকে বদলে ফেললেই হলো। সেলিব্রেটি শো করার সময় যেমন আমেজে কথা বলব পলিটিক্যাল শো করার সময় সেই মুডে বলা যাবে না। প্রোগ্রাম কনটেন্ট মাথায় রাখতে হবে।

একুশে টেলিভিশন অললাইন: বর্তমানে যারা এফ এম রেডিওতে কাজ করছে তাদের উচ্চারন ও অ্যাপ্রোচ সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন?

সামিয়া রহমান: তাদের যদি এতো বিরক্ত লাগে তাহলে শ্রোতারা শুনছেন কেন? বিনোদনের তো অভাব নেই। ইংলিশ মিডিয়ামেয় বাচ্চাগুলোর ইংরেজি একটা এক্সেন্ট আছে। বাংলাতে কথা বলতে গেলে বাংলাটাকেও তারা ওই এক্সেন্টে নিয়ে যায়। এটা ভুল ধারণা। ইংরেজির এক্সেন্ট আর বাংলার এক্সেন্ট এক না। আমেরিকান এক্সেন্ট, বৃটিশ এক্সেন্ট ও অস্ট্রেলিয়ান এক্সেন্ট আলাদা। ওরা ওদের মতো করে কথা বলে। আমি আমার মতো করে কথা বলব। আর এফ এম রেডিও- র আরজে রা যা করছে, আমি যদি মনে করি এরা ভুল করছে, তাহলে আমি যেন না শুনি।

একুশে টেলিভিশন লিমিটেড: আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সাধারণত কী ধরনের অনুষ্ঠান বেশি বেশি নির্মিত হওয়া দরকার বলে মনে করেন?

সামিয়া রহমান: আমাদের টেলিভিশনগুলোর সবচেযে বড় ক্রাইসিসটা হলো আমাদের আইডিয়ার অভাব। আমাদের সবগুলো চ্যানেল একই নিউজ দেখায়, একই রকম প্রোগ্রাম দেখায়, একই রকম নাটক দেখায়। কোনো রকম নতুনত্ব নাই। আমরা মনে করি একটা চ্যানেলে একটা ওয়েদার নিউজ থাকতে হবে, একটা স্পোর্টস নিউজ থাকতে হবে, একটা এন্টারটেইনমেন্ট নিউজ থাকতে হবে, একটা লাইফস্টাইল শো থাকবে, একটা ট্রাভেল শো থাকবে, একটা হালকা সেলিব্রেটি শো থাকবে, একটা সোশ্যাল ইস্যু থাকবে। কিন্তু এই শোটা মানুষ কেন দেখবে তা আমরা ভাবি না। আমরা টেলিভিশন প্রোগ্রাম কীভাবে করব সেটা ভাবি কিন্তু কেন করব সেটা ভাবি না। যদি ভাবতাম তাহল আমাদের দর্শকরা জি বাংলা, স্টার জলশায় মগ্ন হতো না।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: শত ব্যস্ততার মাঝেও আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা।

সামিয়া রহমান: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ। একুশে পরিবারের প্রতি শুভ কামনা।

/ এআর /


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি