ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪

একজন মায়ের কথা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৯:১৯, ৬ আগস্ট ২০২১

প্রতিকী ছবি

প্রতিকী ছবি

আমি একজন বিধবা মহিলা এবং আমার বয়স এখন ৬০ বছর। আমি স্কুল শিক্ষিকা ছিলাম। আমার স্বামী যখন মারা যায় তখন আমার বয়স ছিল ৪০ বছর, আর আমার একমাত্র সন্তানের বয়স তখন ১৬ বছর। ছেলেকে আমি বড় করেছি, নিজে কষ্ট করেছি এবং কখনো ছেলেকে কোন কিছুর অভাব বুঝতে দেই নাই। ছেলেকে দেশের সব চাইতে ভালো স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়িয়েছি। তারপর ছেলে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেল অষ্ট্রেলিয়া এবং স্হায়ীভাবে আছে। আমাকে সবাই সফল মা হিসাবে জানে।

গত সপ্তাহে আমার এক পুরাতন বান্ধবীর সাথে দেখা। ওর ছেলে আমার ছেলে এক'ই স্কুলে পড়েছে। আমরা দু'জন খুব ভালো বন্ধু হলেও আমাদের সন্তানদের মধ্যে ভাল বন্ধুত্ব গড়ে উঠেনি। আমি সব সময় চাইতাম আমার ছেলে ক্লাসের সেরা ছাত্রদের সাথে মিশুক যাতে মনের মধ্যে প্রতিযোগিতাবোধ জাগে। 

ওর ছেলে সব ক্লাসে টেনেটুনে পাশ করে যেতো। তবে সব সময়ই স্কুলের খেলাধুলা অন্যান্য কার্যক্রম গুলোতে অংশগ্রহণ করতো। স্কুলের ওয়াল ম্যাগাজিনে ওর লেখা থাকতো, ছবি আঁকতো, এগুলো নিয়েই আমার বান্ধবী খুশি থাকতো। ও ভাবতো, আমার  ছেলে'তো আর ফেল করে না! আমার ছেলেটা পড়ালেখায় তেমন ভালো না কিন্তু ওর অন্য কাজ গুলো কত সুন্দর! আমার কাছে মনে হতো, ছেলের মাথায় তো গোবর আছে। তার চাইতে বেশি গোবর মায়ের মাথায়। বাচ্চারা স্কুল পার হওয়ার পর আর আমাদের দেখা হয় নাই। 

হঠাৎ করে গত সপ্তাহে শপিং মলে দেখা। ওর ছেলে আমাকে চিনতে পেরে এগিয়ে এসে সালাম দিল। আমি আসলেই চিনতে পারছিলাম না। ছেলে রীতি মতো ভদ্রলোক। তার পর আমাকে তার মায়ের কাছে নিয়ে যায়।

ছেলে মা'কে নিয়ে শপিং এ এসেছে। মায়ের জন্য ছেলে পছন্দ করে রংচঙে থ্রী-পিছ কিনছে। আমি অবাক হলাম। ছেলে আর মা আমাকে দিয়ে পছন্দ করিয়ে একই রংয়ের দুই সেট থ্রীপিস কিনলো। 

আমরা গল্প করলাম। আরো কিছু টুকিটাকি কেনাকাটা করে ওরা। ওদের কেনাকাটা দেখে মনে হচ্ছিল ওরা কোথাও বেড়াতে যাবে।

আমি খেয়াল করছিলাম ছেলে তার মার সাথে কেমন সহজ স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে। মনে হলো মাকে নয় মেয়ে কে নিয়ে বের হয়েছে শপিং করতে। তার পর আমাদের নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে যায়। টুকটাক খাবার অর্ডার করে শেষে বলে- 'আম্মা কফি খাবে নাকি কোন আইসক্রিম।' 

খেতে খেতে শুনলাম ওরা বেড়াতে যাচ্ছে কক্সবাজারে সেখান থেকে সেন্ট মার্টিন। সাথে মা'কে নিয়ে যাবে। যদিও সেটা অফিসিয়াল ট্যুর। বুঝতে পারলাম ছেলে ভালো দায়িত্বে আছে। আমাদের সাথে বসা অবস্থায় অনেকবার মেইল চেক করলো। আর টুকটাক অফিসিয়াল কল রিসিভ করলো। তার মানে শত ব্যস্ততার মধ্যেও মা'কে শপিং করতে নিয়ে এসেছে।

ইতিমধ্যে জানা হয়ে গেলো বউ-এর কথা। বউ একটা মাল্টি ন্যাশনাল কম্পানিতে আছে। তাদের এক সন্তান সে এখন তার নানি বাড়িতে আছে। শপিং শেষ হলে মেয়ে কে তুলে নিবে।

আমি একটা বিছানার চাদর আর আমার জন্য টুকটাক বাজার করতে এসেছিলাম। আমি কিছুই কিনি নাই সেদিন। আমার কিছু কিনতে ইচ্ছে হচ্ছে হলো না আর। আমি শুধু দেখছিলাম। ছেলে কি ভাবে মা'কে এত যত্ন করছে। স্যান্ডেলের দোকানে নিজে তার মায়ের পায়ে স্যান্ডেল পরিয়ে দিলো। মা এত দাম দিয়ে স্যান্ডেল কিনবে না। ছেলে বোঝালো মূল্য না দেখে আরাম এর বিষয়টি খেয়াল করতে।  

ছেলের কত খেয়াল মায়ের জন্য। সব শেষে সানগ্লাস কিনলো মায়ের জন্য। মা সানগ্লাস কিনবে না। ছেলে বলল, 'মা সানগ্লাস কিনতে হবে কারণ তুমি যখন সমুদ্রের ধারে হাঁটবে তখন তোমার চোখে রোদ লাগবে।'

ওদের মা- ছেলেকে দেখে আমার এমন লাগছে কেন? আমি একবার ছেলেকে দেখি, আর একবার মা'কে দেখি। আর আমার ভেতরে কেমন হীনমন্যতা ঢুকে যাচ্ছে। বার বার মনে হচ্ছে আমি হেরে গেছি জীবনের কাছে। আমি একজন ব্যর্থ মা। যে তার ছেলেকে সব চাইতে সফল আর বড় বানাতে গিয়ে এত বড় বানিয়ে ফেলেছি যে, সেই ছেলের নাগাল আমি আর কখনো পাবো না!

এর মধ্যে কয়েকবার মা আর ছেলে আমার ছেলের কথা জানতে চেয়েছে। ফোন নম্বর চেয়েছে, আমি দেই নাই। বলেছি বাসায় আছে, নোট বইয়ে লেখা। আসলে অনুমতি না নিয়ে ওর নম্বর কাউকে দিলে ও রাগ করবে।

আমাকে বলে- 'মা আমি অনেক বিজি থাকি, যখন তখন কল দিবে না। এতে করে আমার ডিসটার্ব হয়। তুমি এখনো অষ্ট্রেলিয়া আর বাংলাদেশের সময়ে এডজাস্ট করতে পারো না কেন?'

আমাকে আমাদের বাসায় নামিয়ে দেওয়ার সময় আমার হাতে একটা শপিং ব্যাগ দিয়ে ছেলে বললো, 'আন্টি, এটা আপনার জন্য। আপনারা দুই বান্ধবী এক সময় এক রকম জামা পরে বেড়াতে বের হবেন।' আমার চোখে পানি চলে এলো। 

আরো বলল, 'আন্টি আমার মোবাইল নং তো সেভ করে দিয়েছি আপনার যখন খুশি কল দিবেন, আমি এসে আপনাকে বাসায় নিয়ে যাবো।' 

আরও বলল, 'আন্টি আপনি তো একা থাকেন আপনিও চলেন না আমাদের সাথে কক্সবাজার। আম্মা'র একজন সঙ্গী হবে। আম্মার আরো বেশি ভালো লাগবে।'

আমি মনে মনে কতক্ষন থেকে বলছি- 'আমাকে নিবি তোদের সাথে কক্সবাজার?' আমি সমুদ্র দেখবো না। আমি শুধু দেখবো একটি ছেলে তার মা'কে কত আদর যত্ন করে তা।'

মনে হয় আমার কথায় ওরা অবাক হলো। আমি এত সহজে ওদের সাথে যেতে রাজি হবো এটা ওরা ভাবতেও পারে নাই। 

আমার হাত জড়িয়ে ধরে থাকলো, তারপর ওরা চলে গেলো। আমি আমার আলো-হীন ঘরে ঢুকে, আজ আরো বেশি অন্ধকার দেখতে পেলাম। গত রাতে আমার ছেলের সাথে টেলিফোনে হওয়া কথা গুলো ভাবতে লাগলাম। 

ছেলে একা-একা বিয়ে করলো অষ্ট্রেলিয়া, নিজে মেয়ে পছন্দ করলো। যেহেতু বউ এর পরিবার অষ্ট্রেলিয়া বহু বছর থেকে আছে, তাই বাংলাদেশে এসে বিয়ের করার প্রশ্নই আসে না। আমি টেলিফোনে ওদের দোয়া করলাম। 

তারপর দেশে আসবে বলে আসলো না। তখন বউ-এর পড়ালেখা শেষ হয় নাই এর মধ্যে আসা যাবে না, তারপর নাতি হলো এখন ছেলে ছোট তাই বাংলাদেশের আবহাওয়া বাচ্চা'র সহ্য হবে না তা-ই আসা যাবে না।  

এবছর আমাকে অষ্ট্রেলিয়া যাওয়ার জন্য সব কাগজ ঠিক করার কথা। গতকাল কল দিয়ে জানালো এবার ছুটিতে ওদের সবাই কে নিয়ে শ্বশুর শাশুড়ীসহ আমেরিকা যাবে। আমাকে বলল 'মা আমরা সবাই চেষ্টা করবো আগামী বছর দেশে আসার তুমি মন খারাপ করো না।'

না আমি মন খারাপ করি নাই। আমি আজ বুঝতে পেরেছি, শুধু ভালো ছাত্র আর সব সময় ফাস্ট হওয়া ছেলেরাই সেরা সন্তান হয় না। একজন সন্তান কে মানুষ করার ক্ষেত্রে আমি শুধু আমার ছেলেকে সেরাটা দিয়েছি। আর তাকে শিখিয়েছি ফার্স্ট হতে হবে পরীক্ষার খাতায় আর চাকরির বাজারে।

সেরা মানুষ হতে হবে এটা আমি কখনো শেখাই নাই। আমি ওকে কখনো শেখাই নাই তোমার বন্ধুদের সহযোগিতা করবে। আমি শিখিয়েছি শুধু প্রতিযোগিতা। ওর কিসে ভালো হবে ওকে শিখিয়েছি। কিন্তু সবাইকে নিয়ে ভাবাটা শিখাতে পারি নাই। 

আমি সব সময় ছেলেকে ভালো জিনিস কিনে দিয়েছি। ওর চাহিদা পূরণ করেছি। কিন্তু আমি কখনো আমার কোন চাহিদা আছে বা থাকতে পারে তা ওকে দেখাই নাই। 

আজ আমার পুরানো বান্ধবীর সাথে দেখা হওয়ায় ভালো হলো। এখন থেকে আমি আমার ভালো লাগা মন্দ লাগা নিয়ে ভাববো। ছেলের কাছ থেকে কোনো অনুমতি নিবো না। ছেলেকে নিয়ে আমার ভাবনা শেষ। ছেলেকে তার ভালো থাকার জন্য সব করে দিয়েছি। ছেলের আর আমার কাছ থেকে পাওয়ার কিছু নাই। 

ছেলে আমাকে তার কাছে অষ্ট্রেলিয়া বেড়াতে নিয়ে যাবে বলে গত দুই বছর থেকে আমার চলার টাকা থেকে একটু একটু করে যথেষ্ট টাকা জমিয়েছি। ওদের জন্য কত কিছু কিনবো তাই।  এবার থেকে আমি আমার জীবনের ছোট ছোট চাওয়া গুলো পূরণ করবো।  

খুব শখ ছিলো হিমালয় দেখবো আর মিশরের পিরামিড দেখবো! একা একা কি এগুলো দেখা যাবে? তার চাইতে এবার কক্সবাজার আর সেন্ট মার্টিন ঘুরে আসি তারপর একটু নিজেকে নিয়ে ভাববো। 

লেখাটি সামাজিক মাধ্যম থেকে পাওয়া

এসি
 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি