ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪

কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট স্থাপনে বিএসএমএমইউ’র মাইলফলক

প্রকাশিত : ২০:০৬, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮ | আপডেট: ১৪:৩৬, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বিএসএমএমইউর কক্লিয়ার সেন্টারে চিকিৎসা নিতে আসা শ্রবণ প্রতিবন্ধী ও তাঁদের স্বজনরা। ছবি একুশে টিভি অনলাইন।

বিএসএমএমইউর কক্লিয়ার সেন্টারে চিকিৎসা নিতে আসা শ্রবণ প্রতিবন্ধী ও তাঁদের স্বজনরা। ছবি একুশে টিভি অনলাইন।

শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের মাঝে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট স্থাপনে মাইলফলক ছুঁয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসকরা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত ‘ডেভলপমেন্ট অব কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট গ্রোগ্রাম’ কর্মসূচির আওতায় এ পর্যন্ত ২৫০ জনের বেশি শ্রবণ প্রতিবন্ধীর কানে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে। এর ফলে এসব রোগীরা শ্রবণ ও বাকশক্তি পেয়েছে। স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারছে। আশার আলো দেখতে পারছে তাঁরা।

জানা গেছে, কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট একটি জটিল অস্ত্রোপচারের মধ্য দিয়ে রোগীর কানে স্থাপন করতে হয়। এখনও পৃথিবীর বহু দেশে এই অত্যাধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি চালু হয় নি। বাংলাদেশেও এক সময় এই চিকিৎসার কথা চিন্তাই করা যেতো না। সেই অসাধ্যই সাধন করেছেন বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের নাক কান ও গলা বিভাগের চিকিৎসকরা।

শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে ২০১০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ডেভলপমেন্ট অব কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট গ্রোগ্রাম ইন বিএসএমএমইউ’কর্মসূচি চালু হয়। এখানে ২০১১ সালে প্রথম রোগীর কানে সফলতার সঙ্গে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট স্থাপন করা হয়। এর পর থেকে ধীরে ধীরে এই চিকিৎসার কথা ছড়িয়ে পড়ে দেশব্যাপী। গত ৬ সেপ্টেম্বর ২৫০ তম রোগীর কানে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট স্থাপনের মাইলফলক স্পর্শ করে বঙ্গবন্ধু হাসপাতাল।

এখানে গত ১১ সেপ্টেম্বর ২৫৩ তম রোগীর কানে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে। অপেক্ষমান আছে আরও শতাধিক রোগী। তাদেরকেও কক্লিয়ার ইমপ্লান্টের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছেন ‘ডেভলপমেন্ট অব কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট গ্রোগ্রাম ইন বিএসএমএমইউ’এর কর্মসূচি পরিচালক ও এদেশে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট চিকিৎসায় পথিকৃত অধ্যাপক ডা. আবুল হাসনাত জোয়ারদার। তিনি জানান, ২৫০ তম কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট স্থাপন করা রোগীর নাম নাইসা (৫)। অস্ত্রোপচারের পর সে ভালো আছে।      

বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে এই কর্মসূচিটি পরিচালিত হচ্ছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণায়লই কক্লিয়ার খরচ বহন করে থাকে। প্রতিটি রোগীর কানে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট স্থাপনে শুধু ডিভাইসের জন্যই ব্যয় হয় ১০ লক্ষাধিক টাকা।

একুশে টিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা বলছেন এদেশে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট চিকিৎসার পথিকৃত অধ্যাপক ডা. আবুল হাসনাত জোয়ারদার।

কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জন বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের নাক কান গলা বিভাগের অধ্যাপক ডা. আবুল হাসনাত জানান, দক্ষ জনশক্তির অভাব ও অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে একটা সময় এদেশে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট স্থাপনের কথা ভাবাই যেতো না। এছাড়া এই চিকিৎসা বেশ ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেকেই এতে রাজি হতেন না। সেই অবস্থা এখন বদলেছে। শুধু বঙ্গবন্ধু মেডিকেলেই ২৫৩ জন রোগীর কানে সফলভাবে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট স্থাপনের মাইলফলক ছোঁয়া সম্ভব হয়েছে। এখানে দক্ষ স্পিচ থেরাপিস্ট, ওডিওলজিস্ট এবং সার্জনের সমন্বয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে জটিল এই চিকিৎসা সহজেই করা সম্ভব হচ্ছে। সবমিলিয়ে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের এই কক্লিয়ার কার‌্যক্রম দিন দিন একটি বৃহৎ কক্লিয়ার সেন্টারে পরিণত হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে বর্তমানে আবুল হাসনাত জোয়ারদার- এর নেতৃত্বে এই কর্মসূচিতে সাত জনের একটি টিম নিয়মিত কাজ করছেন। অন্যরা হলেন অধ্যাপক ডা. জহুরুল হক সাচ্চু, অধ্যাপক ডা. নাসিমা আক্তার, অধ্যাপক ডা. দেলোয়ার হোসেন, সহযোগী অধ্যাপক কানুলাল সাহা, সহযোগী অধ্যাপক অসীম কুমার বিশ্বাস ও সহকারী অধ্যাপক হারুনুর রশীদ তালুকদার ইয়ামিন।

শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের ভরসাস্থল বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের কক্লিয়ার সেন্টার

বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের সফল কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট চিকিৎসায় স্বপ্ন দেখছে প্রতিবন্ধী শিশু-কিশোরেরা। দিন দিন এটি বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের ভরসাস্থলে পরিণত হচ্ছে। যেমনটি জানা গেছে কক্লিয়ার সেন্টারে আসা রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে।

গত মঙ্গলবার (১১ সেপ্টেম্বর) বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের কক্লিয়ার ক্লিনিকে সরেজমিনে দেখা গেছে রোগী ও তাঁদের স্বজনদের ভিড়। চিকিৎসকরা জানান, প্রতি রোব ও মঙ্গলবার দুপুর ১২ টা থেকে এই ক্লিনিকটি পরিচালিত হয়। প্রতি সপ্তাহে ওই দুই দিনে কম করে হলেও ১৫ থেকে ২০ জন রোগী আসেন। এছাড়া প্রতিদিনই নাক, কান ও গলা বিভাগে শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের দেখে থাকেন চিকিৎসকরা।

হবিগঞ্জ থেকে আসা ৮ বছরের শিশু মাহদীর বাবা খসরু মিয়া এ প্রতিবেদকে জানান, আগে এখানে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে এমন একজন রোগীর স্বজনের কাছ থেকে জেনে তিনি ছেলেকে নিয়ে এসেছেন। তিনি জানান, ৪ বছর ধরে মাহদী শোনে না। এখানকার চিকিৎসকরা জানিয়েছেন মাহদীর কানে কক্লিয়ার স্থাপন করতে হবে।

বিএসএমএমইউর কক্লিয়ার সেন্টারে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা।

গাজীপুর থেকে তিন বছরের রোকসানাকে নিয়ে এসেছেন তার দাদী গোলাপজান। তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট নিয়ে টিভিতে একটি প্রচার ভিডিও দেখে তিনি এখানে এসেছেন। এখানকার ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে এবং কক্লিয়ার স্থাপন করা রোগীদের জীবনের পরিবর্তন দেখে তার মনে আশার সঞ্চার হয়েছে।

বগুরা থেকে তিন বছরের উম্মে হানিকে নিয়ে এসেছেন তাঁর বাবা জাহাঙ্গীর। তিনি জানান, উম্মে হানি জন্মবধির। তাই তিনি চিকিৎসার জন্য এখানে নিয়ে এসেছেন। শুনেছেন এখানে চিকিৎসা নেওয়ার পর বহু শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধী স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেয়েছে। তাঁর আশা উম্মে হানিও স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে।

এ বিষয়ে কর্মসূচির পরিচালক ডা. আবুল হাসনাত জোয়ারদার বলেন, কানে কম শোনা কিংবা জন্মবধির বিষয়টি ধরা পরার পরপরই অভিভাবকদের উচিত রোগীকে চিকিৎসকের নিকট নিয়ে আসা। কারণ যত দ্রুত কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট করা সম্ভব তত দ্রুত শিশু ভাষা শিখতে পারে। সাধারণত ৫ বছর পর্যন্ত শিশুর কানে কক্লিয়ার স্থাপন করা হয়ে থাকে। তিনি জানান, বহু অভিভাবক সন্তানের বয়স ১৫-১৬ বছর হয়ে গেলে যোগাযোগ করেন। তখন কক্লিয়ার দিয়ে তেমন লাভ হয় না।

কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট কি

কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট বা বায়োনিক ইয়ার হলো শ্রবণ সহায়ক অত্যাধুনিক এমন একটি ইলেকট্রনিক ডিভাইস যা মারাত্মক বা সম্পূর্ণ বধির ব্যক্তিকে শব্দ শুনতে সহায়তা করে। ইমপ্লান্ট চালুর পর বধির ব্যক্তির কাছে তখন পৃথিবীটা শব্দময় হয়ে ওঠে। কক্লিয়ার ইমপ্লান্টের দুটি অংশ- একটি অংশ কানের বাইরে থাকে, যে অংশে থাকে মাইক্রোফোন, স্পিচ প্রসেসর ও ট্রান্সমিটার এবং আরেকটি অংশ কানের ভেতরে থাকে, যে অংশে থাকে রিসিভারস্টিমুলেটর এবং ইলেকট্রোড। অপারেশনের মাধ্যমে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট অন্তঃকর্ণের কক্লিয়াতে স্থাপন করা হয়।

মাইক্রোফোনের মাধ্যমে গৃহিত শব্দ এনালগ ইলেকট্রিক সিগনালে পরিবর্তিত হয়। স্পিচ প্রসেসর সেই সিগনালকে প্রসেসিং করে কোডেড ডিজিটাল সিগনালে রূপান্তর করে। ট্রান্সমিটার কয়েলের মাধ্যমে কোডেড সিগনাল রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির মাধ্যমে ইন্টারনাল রিসিভার স্টিমুলেটরে প্রেরিত হয়। রিসিভার স্টিমুলেটর সেই কোডেড সিগনালকে ইলেকট্রিক ইমপালসে পরিবর্তিত করে ইলেকট্রোডে প্রেরন করে। ইলেকট্রোড ইলেকট্রিক ইমপালসকে অডিটরী নার্ভের মাধ্যমে মস্তিস্কে প্রেরন করে এবং মস্তিস্ক সেই ইমপালসকে শব্দ হিসেবে চিহ্নিত করে। ফলে শ্রবন প্রতিবন্ধী ব্যাক্তি শব্দ শুনতে পায়।

/ এআর /


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি