গণতন্ত্রের সংকট ও বিভ্রান্তির রাজনীতি: বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট
প্রকাশিত : ১৫:৩৬, ২৫ মে ২০২৫ | আপডেট: ১৫:৪৪, ২৫ মে ২০২৫

বাংলাদেশ আজ এমন একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, যেখানে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ, রাজনৈতিক শিষ্টাচার এবং রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য এক গভীর প্রশ্নের মুখোমুখি। ফ্যাসিবাদ পরবর্তী সাম্প্রতিক সময়ের রাজনৈতিক ঘটনাবলি কেবল রাজনৈতিক উত্তেজনার বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং এটি এক ধারাবাহিক রাজনৈতিক সংকটের বহুমাত্রিক প্রতিফলন।
ফ্যাসিবাদ বিরোধী জুলাই গণঅভ্যুত্থান অভ্যুত্থান আকস্মিক ছিল না। এর পেছনে রয়েছে বিএনপি এবং তার মিত্রদের দীর্ঘদিনের সংগ্রাম, আন্দোলন এবং রাজনৈতিক ত্যাগ। কিন্তু এই আন্দোলনের পটভূমি গঠনে বিএনপি নেতাকর্মীসহ যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, তাদের অবদানকে অস্বীকার বা তুচ্ছ করার প্রবণতা আজ স্পষ্ট। বর্তমান ক্ষমতাসীন পক্ষ ও তাদের ঘনিষ্ঠ মহলের মধ্যে এই অস্বীকৃতির প্রবণতা রাজনৈতিক শিষ্টাচার বিরোধী তো বটেই, বরং তা ইতিহাস বিকৃতির এক বিপজ্জনক নিদর্শন।
আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে বিএনপির জনপ্রিয়তা - যা বহুবছরের রাজনৈতিক সংগ্রামের ফসল। দলটির সামাজিক ভিত্তি, রাজনৈতিক অভিপ্রায় এবং সংগঠনিক শক্তি বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু এ জনপ্রিয়তাকে ভয় পেয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষগণ যেন এক সুপরিকল্পিত বিভ্রান্তির কৌশল অবলম্বন করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, প্রচারমাধ্যম, এবং প্রশাসনিক কাঠামোর নির্দিষ্ট অংশ ব্যবহার করে তারা নেতিবাচক প্রচারণা ও অপপ্রচার চালাচ্ছে, যার উদ্দেশ্য বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে দুর্বল করে রাখা।
জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে, সেটিও এ সংকটের একটি কেন্দ্রীয় উপাদান। গণতান্ত্রিক চর্চার স্বাভাবিক ধারাবাহিকতা রক্ষার বদলে নির্বাচনী প্রক্রিয়া বিলম্বিত করার প্রবণতা জাতির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করছে। কোনো কোনো মহল হয়তো উপলব্ধি করছে যে, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে তারা গণরায়ে প্রত্যাখ্যাত হবে। এই আশঙ্কাই নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার প্রবণতাকে ত্বরান্বিত করছে। ফলে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে জনগণের ভোটাধিকার এবং গণতন্ত্রের মৌলিক চেতনা।
জুলাই অভ্যুত্থানে সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিল দৃঢ়, পেশাদার, এবং পরিপক্ব। বিশেষ করে সেনাপ্রধানের সিদ্ধান্ত ও দূরদর্শিতায় একটি সম্ভাব্য বৃহৎ প্রাণহানি এড়ানো সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, সেনাপ্রধানের কিছু বক্তব্য বা অবস্থান বিএনপির অনুকূলে যাচ্ছে - এই ধারণাকে ভিত্তি করে একটি পক্ষ তাঁকে ব্যক্তি ও পেশাগতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করতে উদ্যোগী হয়েছে। এই ধরণের প্রচেষ্টা কেবল একজন সেনা কর্মকর্তার সম্মানহানিই নয়, বরং তা সামরিক প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্বের ওপরও আঘাত হানছে।
অন্যদিকে, রাজনীতির অঙ্গনে আবারও সক্রিয় হয়েছে এক ধরনের ‘ছদ্মবেশী গোষ্ঠী’, যারা অতীতে আন্দোলনের সময় নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে নানা রূপে আবির্ভূত হয়েছিল। তখনকার প্রেক্ষাপটে তা প্রশংসনীয় হলেও, বর্তমানে তারা সেই পুরনো কৌশল পুনরায় প্রয়োগ করে বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় ফেলতে চেষ্টা করছে। তাদের কার্যকলাপ বিভ্রান্তি তৈরি করা, জনমত প্রভাবিত করা এবং মূলধারার রাজনৈতিক শক্তিকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যেই পরিচালিত।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য এখন সবচেয়ে জরুরি হলো—একটি সত্যনিষ্ঠ, অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ও সহনশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ। ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা, মতভেদে সৌজন্য, এবং পারস্পরিক আস্থার ভিত্তিতে সংলাপের পথ খুঁজে বের করা ছাড়া এই সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়।
দেশের গণতন্ত্র রক্ষার প্রথম শর্ত হলো: একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় নির্বাচন, যেখানে জনগণের প্রকৃত মতামত প্রতিফলিত হবে এবং সব পক্ষ সমান সুযোগ পাবে।
এই মুহূর্তে জাতির প্রয়োজন- পদত্যাগের নাটক নয়, দৃঢ় সংলাপ; কুৎসার বন্যা নয়, যুক্তির আলোচনাচর্চা; বিভ্রান্তির কুয়াশা নয়, স্বচ্ছ রাজনৈতিক দূরদর্শিতা। গণতন্ত্রকে বাঁচাতে হলে বিভ্রান্তি নয়, সত্যকে সামনে আনতে হবে। এই সত্যভিত্তিক রাজনীতি-চর্চাই হোক আগামী বাংলাদেশের মূল ভিত্তি।
লেখক: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক।
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।