ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

গাজীপুরে ৭ কারণে বিএনপির ‘ভরাডুবি’

প্রকাশিত : ১৮:২২, ২৮ জুন ২০১৮ | আপডেট: ১২:৪৫, ৭ জুলাই ২০১৮

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন শেষ হলো। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর কাছে দুই লাখেরও বেশি ভোটে পরাজিত হয়েছেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার। স্থানীয় রাজনৈতিক পর‌্যবেক্ষকদের কেউ এটিকে `ভরাডুবি’ হিসেবে কেউবা ‘ভূমিধ্বস পরাজয়’ হিসেবে দেখছেন। যদিও বিএনপি দোষছে প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনকে।

জাতীয়তাবাদী দলের পক্ষ থেকে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অভিযোগ তোলা হয়েছে। বলা হচ্ছে শতাধিক কেন্দ্র থেকে ধানের শীষের এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে। ভোটের আগে নেতাকর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি করা হয়েছে। ডিবির পক্ষ থেকে তালিকা করে ভীতি সৃষ্টি করা হয়েছে। ‘খুলনা স্টাইলে কারচুপি’ করা হয়েছে। ভোটের আগের রাতে জাল ভোট দিয়ে বাক্স ভর্তি করা হয়েছে। ইত্যাদি ইত্যাদি।

বিএনপির এই অভিযোগগুলোর সবই যে ঠিক সেটি যেমন অবাস্তব তেমনি সবই যে অমূলক সেটিও ঠিক নয়। রাজনৈতিক পর‌্যবেক্ষক থেকে শুরু করে স্থানীয় রাজনৈতিক সচেতন মহল নির্বাচনে বিএনপির ভূমিধ্বস পরাজয়ের পেছনে দলটির নেতৃত্বের ব্যর্থতাকেই বেশি দায়ী করছেন।

মূলত সাতটি কারণে গাজীপুরে বিএনপি প্রার্থীর পরাজয় হয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- শতাধিক কেন্দ্রে এজেন্ট দিতে না পারা, সাংগঠনিক দূর্বলতা এবং এ কারণে নেতাদের অহেতুক ভীতি, রাজনৈতিক কৌশল ও দৃঢ়তার অভাব, প্রার্থী বাছাইয়ে ভুল, কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রচার-গণসংযোগের নামে ফটোসেশন করে সময়ক্ষেপণ, নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়া এবং সর্বোপরি সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের কৌশলের কাছে ধরাশায়ী হয়েছে বিএনপি।

গাজীপুর সিটি নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, স্থগিত নয়টি কেন্দ্র বাদে বাকি ৪১৬ টি কেন্দ্রের ফল ঘোষণা করা হয়েছে। এতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম পেয়েছেন ৪ লাখ ১০ ভোট। আর বিএনপির হাসান উদ্দিন সরকার পেয়েছেন ১ লাখ ৯৭ হাজার ৬১১ ভোট। তৃতীয় হওয়া ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী পেয়েছেন ২৬ সহস্রাধিক ভোট।

খুলনা সিটি করপোরেশণ নির্বাচনে বিএনপির সেসব দুর্বলতা ছিল, সেগুলো গাজীপুরেও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি বলে মনে করেন দলটির নেতারা। দলটির নেতারা বলছেন, এই দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠতে না পারলে আসন্ন তিন সিটিতে পরাজয়ের আশঙ্কা রয়েছে।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে একটি বিষয় স্পষ্ট করে ফুটে উঠেছে যে, শতাধিক কেন্দ্রে ধানের শীষের প্রার্থীর এজেন্ট-ই ছিল না। ওইসব কেন্দ্রের এজেন্টদের তালিকা দেওয়া হলেও কেউ হাজির-ই হন নি। এজন্য বিএনপি প্রশাসনকে দুষলেও নিজেদের ব্যর্থতাকেই আড়াল করার চেষ্টা করছে বলে মনে করেন অনেকে। বিএনপির এজেন্টরা ভয়ভীতির দোহাই দিয়ে ভোটকেন্দ্রে হাজির না হলেও বেশিরভাগ ভোটকেন্দ্রেই স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু ভোট হয়েছে।

বিএনপির নেতারা বলছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কেন্দ্রীয় নেতাদের তেমন কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ থাকে না। এসব নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ভর করে প্রার্থীর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ও স্থানীয় নেতাকর্মীদের কর্মদক্ষতার ওপর। গাজীপুরে প্রার্থী হিসেবে হাসান সরকারের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ভালো ছিল। কিন্তু কাল হয়েছে তার শারিরিক দূর্বলতা। প্রচারের সময় তিনি বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন নি। তাকে ধরে গাড়ি থেকে নামাতে হয়েছে, আবার তুলে দিতে হয়েছে। যেটি ভোটারদের চোখে পড়েছে। যেই যুক্তিকে প্রথম সিটি নির্বাচনে লক্ষাধিক ভোটে নির্বাচিত মেয়র এম এ মান্নানকে মনোনয়ন দেওয়া হয় নি তথা অসুস্থতা সেটি হাসান সরকারের মধ্যেও ছিল।

গাজীপুর বিএনপি নেতাকর্মীরা সবাই একবাক্যে মানেন যে, জনপ্রিয়তায় হাসান সরকারের চেয়ে মান্নান এগিয়ে। সেক্ষেত্রে মান্নানকে মনোনয়ন দিলে নির্বাচনে ফল পক্ষে আসত বলে মনে করেন অনেকে।

গতবার মান্নান নির্বাচিত হওয়ার পেছনে দলীয় ঐক্য এবং হাসান সরকারের নি:শর্ত সমর্থনও বড় ভূমিকা রেখেছে। এবার নির্বাচনী বিধির দোহাই দিয়ে এম এ মান্নান হাসান সরকারের পক্ষে কাজ করেন নি। তাই বিএনপি নেতাকর্মীরা মনে করছেন মান্নানকে মনোনয়ন দিয়ে হাসান সরকারকে তার পক্ষে মাঠে নামাতে পারলে ফল বিএনপির পক্ষে যেতো।

স্থানীয় দলীয় নেতাকর্মীরা নির্বাচনে তেমন একটা সক্রিয় ছিলেন না। এজন্য প্রশাসনিক কড়াকড়ি যেমন দায়ী তার চেয়ে বেশি দায়ী বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বতলা। সিটি কর্পোরেশন ৫ বছর আগে গঠিত হলেও বিএনপির মহানগর কমিটি আজও গঠিত হয়নি কোন্দলের কারণে।

এদিকে নির্বাচনী প্রচারেও বিএনপির দূরদর্শিতার অভাব ছিল। আওয়ামী লীগ যতোটা মরিয়া ছিল বিএনপি সে তুলনায় ছিল কিছুটা গা ছাড়া। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় নেতারা গাজীপুরে গেলেও সেখানে গণসংযোগের চেয়ে ফটোসেশন-ই গুরুত্ব পেয়েছে তাদের কাছে।

গাজীপুর নির্বাচন ১৫ মে হওয়ার কথা ছিল। আদালতের নির্দেশে নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ায় এবং খুলনা সিটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর লক্ষাধিক ভোটের জয় বিএনপি নেতকর্মীদের মনোবল ভেঙে দেয়। এটিকেও হাসান সরকারের ভরাডুবির কারণ মনে করছেন রাজনৈতিক পর‌্যবেক্ষকরা।

যদিও গাজীপুর সিটি নির্বাচনের সমন্বয়ক এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠিন সম্পাদক ও গাজীপুর জেলার সভাপতি ফজলুল হক মিলনের দাবি, গাজীপুর সিটিতে বিএনপি হারেনি, হেরেছে দেশের জনগণ। প্রশাসনের সহায়তায় সরকার দলীয় লোকেরা ভোটচুরি-জালভোট দিয়ে তাদের প্রার্থী জিতিয়েছে, যা বিশ্ববাসীও দেখেছে। এই নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন আবারও প্রমাণ করেছে যে সুষ্ঠু নির্বাচন করার যোগ্যতা তাদের নেই। মিলনের দাবি বিএনপির প্রচারণায় তেমন কোনও ঘাটতি ছিল না। প্রচারণার সময়ও বিভিন্ন জায়গায় বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার অভিযোগ তার।

/ এআর /


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি