ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

চিনি: পারমাণবিক বোমার চেয়েও প্রাণঘাতী!

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২১:৫২, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | আপডেট: ১৬:০২, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

বোমার আঘাতে মানুষের মৃত্যু ঘটে ঠিক তবে সে মৃত্যু দৃশ্যমান। সবাই দেখতে পায়। কিন্তু চিনির প্রভাবে মানুষের এর চেয়ে বেশি মৃত্যু হচ্ছে। মানুষ সেটি বুঝতে পারছে না। প্রতিনিয়ত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে যার অন্যতম কারণ হলো চিনি। 

কয়েকদিন আগে সংবাদপত্রে আসে পয়সা খরচ করে চিনি কেনার জন্যে মানুষ লাইন দিয়েছে।

যখন ছবিটি সামনে আসে তখন আশ্চর্যই হতে হয় যে, আসলে আসক্তি মানুষকে কতটা অসহায় করে তোলে। প্রশ্ন জাগে, চিনির জন্যে লাইন দিতে হবে কেন? চিনি কি অত্যাবশ্যকীয় খাবার যা না খেতে পারলে স্বাস্থ্যহানি ঘটবে?

খোঁজ-খবর নিয়ে জানা যায়, চিনি পুরোটাই আমদানি করা হয়। দেশে উৎপাদন ২৫-৩০ হাজার টন আর আমদানি করা হয় ২১ লাখ টন। চিনির বাজার ৯৯ শতাংশই আমদানির ওপর নির্ভরশীল।

আমদানিকারকরা প্রতি টন চিনির দাম ৪৭০-৪৮০ ডলার ঘোষণা দিচ্ছেন। অতএব প্রতি টন ৪৭০-৪৮০ ডলার হলে ২১ লাখ টন চিনির দাম কত হয়, এটা হিসাব করলেই যে কেউ বের করতে পারেন। অর্থাৎ চিনি বাবদ আমরা যা ব্যয় করছি, তার পুরোটাই যাচ্ছে বিদেশে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর পকেটে।

বিষ কেনার জন্যে হুড়াহুড়ি করা বোকামিরই প্রকাশ!

আবার কেউ কেউ আফসোস করেছেন এক বছরের ব্যবধানে চিনির দাম দ্বিগুণ হলেও ক্রেতাদের স্বস্তি দিতে পণ্যটির ওপর থেকে করভার কমানো হয় নি!

আসলে এখানে একটি প্রশ্ন আসে যে, চিনি এসেনশিয়াল কিনা? অত্যাবশ্যকীয় পণ্য কিনা? চিনি না খেলে স্বাস্থ্যের কোনো ক্ষতি হবে কিনা, যে এটার জন্যে আফসোস করতে হবে, এটার জন্যে সুপারিশ করতে হবে? বাস্তব সত্য হচ্ছে চিকিৎসাবিজ্ঞানী এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে বলে আসছেন- সাদা চিনি হলো ‘বিষ’, যার ইংরেজি নাম হচ্ছে হোয়াইট পয়জন।

যে সুগারকে হোয়াইট পয়জন বলা হচ্ছে, যে সুগার শরীর ও মনের ওপর স্বাস্থ্যের ওপর অত্যন্ত ক্ষতিকর, যা শত শত বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। সেই বিষ কেনার জন্যে হুড়াহুড়ি করা বা চিনি কিনতে না পেরে হা-হুতাশ করাকে বোকামি ছাড়া আর কি বলা যায়?

মেদস্থূলতায় জর্জরিত হৃদরোগ, ক্যান্সার, ডায়াবেটিসে জর্জরিত ইউরোপ এবং আমেরিকার ধনী দেশগুলো চিনিযুক্ত খাবার ও পানীয়ের ওপর অতিরিক্ত কর বসাচ্ছে, যাকে বলা হয় সুগার ট্যাক্স। এই কর বসানোর উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানুষ যাতে চিনিযুক্ত খাবার কেনা কমিয়ে দেয়। সেখানে চিনির ওপর আমাদের দেশে কর হার কমানোর প্রস্তাব কতটা সুবিবেচনাপ্রসূত আর কতটা অবিবেচনাপ্রসূত এটা আমরা নিজেরাই বুঝতে পারি।

ডিপ্রেশনের সাথে চিনির স্পষ্ট যোগ!

চিনি নিয়ে এর আগেও আলোচনা হয়েছে। চার লক্ষ ৩০ হাজার মানুষের ওপর পরিচালিত একটি গবেষণা রিপোর্টের উল্লেখ করে বলা হয়েছিল, উচ্চ চিনিযুক্ত খাবার খাদ্যনালী ফুসফুসের আবরণ ও ক্ষুদ্রান্ত্র এবং মহিলাদের জরায়ুর অভ্যন্তরভাগ ক্যান্সারের সাথে সরাসরি সংযুক্ত।

উচ্চ চিনিযুক্ত খাবার ফ্যাটিলিভার সৃষ্টি করে, যা ক্রমান্বয়ে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিস সৃষ্টি করে। ব্লাড সুগার ও রক্তচাপ বাড়ায়, ধমনিতে চর্বি জমার ঝুঁকি বাড়ায়। ২৩০০ জন টিনএজারের ওপর পরিচালিত গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে মুখে ব্রনের কারণ হচ্ছে চিনিযুক্ত খাবার।

চিনিযুক্ত খাবার নিউরোট্রান্সমিটার নিঃসরণ ও প্রবাহের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে গবেষকরা বিষণ্নতার ( ডিপ্রেশন) সাথে এর স্পষ্ট যোগ খুঁজে পেয়েছেন। ৬৯,০০০ নারী এবং ৮০০০ নারী-পুরুষের ওপর পরিচালিত দুটি গবেষণায় একই ফল পাওয়া যায়।

চিনি কিডনির রক্তনালীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, কিডনি রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। চিনি দাঁতের মিনারেলের ক্ষতি করে, মাড়িরও ক্ষতি করে দাঁত এবং মাড়ির স্বাস্থ্যহানি ঘটায়। চিনি রক্তের ইউরিক এসিডের লেভেল বাড়িয়ে দেয়, ফলে বাড়ে বাতের ঝুঁকি। চিনি ও চিনিজাত মিষ্টি বেশি খেলে স্মৃতিভ্রষ্টতার ঝুঁকি বাড়ে, বুদ্ধিদীপ্ততা কমে যায়।

আমেরিকানদের স্থূলজাতি হওয়ারও কারণও চিনি!

অতিরিক্ত চিনি খাওয়ায় আমেরিকানদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অত্যন্ত কম। গড়পড়তা একজন আমেরিকান দৈনিক ২০ চা চামচ চিনি খায়। অর্থাৎ চিনিজাতীয় খাবারের মধ্য দিয়ে চিনি গ্রহণের পরিমাণ হচ্ছে ২০ চা চামচ; যে কারণে আমেরিকানরা সবচেয়ে বেশি স্থূলজাতি। তাদের মেদস্থূলতা সবচেয়ে বেশি! হৃদরোগ, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস বেশি এবং একইভাবে নিদ্রাহীনতা।

আমেরিকানদের এত অনিদ্রায় আক্রান্ত হওয়ার মূল কারণ এই চিনি। চিনি ঘুম কমিয়ে দেয়। রাতে দেহ অভ্যন্তরের অস্থিরতা বাড়িয়ে দেয়, যার ফলে আমেরিকানরা প্রায়শই অনিদ্রায় আক্রান্ত হয়। কারণ তারা রাতে ডিনার করে এবং ডিনারের শেষ হয় ডেজার্ট দিয়ে। আর ডেজার্টের পুরোটাই তৈরি হয় অতিরিক্ত চিনি দিয়ে।

ক্যান্সার আক্রান্তদের মিষ্টি খাবার পছন্দের কারণও চিনি!

আমরা আরো বলেছিলাম, এই যে ছোট ছেলেমেয়েদের সিস্ট হচ্ছে, টিউমার হচ্ছে, এর একটা বড় কারণ চকলেট, মিষ্টি। কারণ এখনকার জেনারেশনের বাচ্চারা চকলেট খুব বেশি পরিমাণে খাচ্ছে। এটা যেরকম তাদের মেদস্থূলতা বাড়াচ্ছে, তেমনি তাদের সিস্ট বা টিউমারের কারণ হচ্ছে।

লক্ষ্য করলে দেখবেন, ক্যান্সার আক্রান্ত যারা তারা সাধারণত মিষ্টিজাতীয় খাবার খুব পছন্দ করে। কেন? কারণ ক্যান্সারাস সেলগুলো তাদের শক্তি সংগ্রহ করে এই চিনি থেকে। আর সুগার এবং ফ্যাট দুটোরই মিশ্রণ হয়েছে চকলেট।

তাই যাদের কোথাও কোনোরকম সিস্ট আছে, টিউমার আছে, তাদের চিনির ব্যাপারে অনেক অনেক বেশি সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।

আসলে চিনি নিয়ে যদি আমরা একটু গভীরভাবে ভাবি, তাহলে দেখব মানুষের জন্যে, সভ্যতার জন্যে পারমাণবিক বোমার চেয়েও চিনির ক্ষতি এবং ধ্বংসের হার বেশি। বোমায় মৃত্যুটা দৃশ্যমান কিন্তু চিনির প্রভাবের মৃত্যু নিয়ে সচেতনতা প্রয়োজন!

আপনার কাছে অবাক লাগতে পারে, কিন্তু বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখব বিষয়টি কত সত্য। চিনি যেসমস্ত রোগের কারক তার মধ্যে একটি হচ্ছে হৃদরোগ। ওয়ার্ল্ড হার্ট ফাউন্ডেশনের গবেষণা তথ্য হচ্ছে, প্রতিবছর বিশ্বে এক কোটি ৭৯ লাখ মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। স্ট্রোকে মারা যায় ৬৫ লক্ষ মানুষ এবং ডায়াবেটিসে মারা যায় ১৫ লক্ষ মানুষ।

আমাদের দেশে কোভিডে যারা মারা গিয়েছিলেন তার অর্ধেকই ছিলেন ডায়াবেটিস আক্রান্ত। আমরা ক্যান্সার এবং অন্যান্য রোগে মৃত্যুর কারণ বাদ দিয়ে শুধু যদি দেখি যে, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে যারা মারা যান তাদের সংখ্যা এক কোটি ৭৯ লাখ।

এবার আমরা দেখি, পারমাণবিক বোমায় কত মানুষ মারা গিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র হিরোশিমা ও নাগাসাকি দুটি পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে। হিরোশিমায় সাড়ে তিন লক্ষ অধিবাসীর মধ্যে এক লক্ষ ৪০ হাজার এবং নাগাসাকিতে ৭৪ হাজার মানুষ সাথে সাথে মারা যায়। তারপরে বোমার তেজস্ক্রিয়তাজনিত কারণে হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে মোট তিন লাখ ৭২ হাজার মানুষ মারা যায়।

পারমাণবিক বোমায় মৃত্যুটা দৃশ্যমান ছিল! সারা পৃথিবীর মানুষ ধিক্কার দিয়েছে, কিন্তু সাদা বিষ চিনি কোটি মৃত্যুর কারণ হওয়ার পরেও ধিক্কার দেয়া তো পরের কথা, আমরা অনেকেই এখনো সচেতন হয়ে উঠতে পারিনি। তাই আমরা বিষ কেনার জন্যে লাইনে দাঁড়াচ্ছি এবং আফসোস করছি, আরো দাম কমিয়ে আমাদেরকে বিষ কেনার সুযোগ কেন করে দেয়া হচ্ছে না।

আপ্যায়নে চিনিযুক্ত খাবার থাকলে কী করবেন?

জেনে-শুনে বিষ পান করা আর আত্মহননের পথ বেছে নেয়া দুটোর মধ্যে কোনো তফাৎ নেই।

ফেব্রুয়ারি বাঙালির জীবনে সবসময় কল্যাণের অনুরণন কল্যাণের বাণী কল্যাণের ডাক নিয়ে আসে। এবারের ফেব্রুয়ারিতে আমরা সাদা বিষ থেকে নিজেদের রক্ষা করার প্রতিজ্ঞা করতে পারি যে, ‘না! যা আমার স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর, এই ক্ষতিকর চিনি-আসক্তি থেকে আমি নিজেকে বের করে নিয়ে আসব এবং চিনি নিজে খাওয়া থেকে বিরত থাকব’।

কেউ চিনিজাত জিনিস আপ্যায়ন করলেও তাকে বিনয়ের সাথে বলব যে, ‘আমি চিনি খাই না! চিনির প্রতি আমার কোনো আসক্তি নাই। চিনির আসক্তি থেকে আমি পুরোপুরি মুক্ত’। নিজের স্বাস্থ্য সুরক্ষায়, নিজেকে টোটালি ফিট করার জন্যে এটি একটি চমৎকার পদক্ষেপ হবে।

৭০ বছর আগে ফেব্রুয়ারি আমাদের ইতিহাসের বাঁক বদলের কারক হয়েছিল। ৭০ বছর পরে আবার ফেব্রুয়ারি সাদা বিষ হোয়াইট পয়জন অর্থাৎ চিনি বর্জন করার মধ্য দিয়ে কর্মক্ষম দীর্ঘ সুস্থ সফল দীর্ঘজীবনের জন্যে প্রয়োজনীয় টোটাল ফিটনেসের অনুঘটক হিসেবে কাজ করুক। সাধারণ মানুষের সুস্থ জীবনের পথে একটা বড় বাঁক বদল ঘটুক। নতুন একটা সুস্থতার ধারা সৃষ্টি হোক। পরম করুণাময়ের কাছে এটাই আমাদের প্রার্থনা।

এসি
 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি