ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪

‘জনাব ভুট্টো কাটিয়া পড়ায় ছয়-দফার নৈতিক বিজয় সূচিত হইয়াছে’

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১২:৪৭, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | আপডেট: ০৯:৩৬, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০

পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ১৫ এপ্রিল যশোর টাউন হল ময়দানে এক বিরাট জনসভায় শ্রোতাদের একটানা আনন্দ ও হর্ষধ্বনির মধ্যে ঘোষণা করেন যে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো আমাকে মোকাবিলা করার প্রশ্নে শেষ পর্যন্ত কাটিয়া পড়ায় ছয়-দফার ব্যাপারে আমাদের প্রথম পর্যায়ের বিজয় সূচিত হইয়াছে।

তাঁহার এই পশ্চাদপসরণ শুধু তাহার একারই পরাজয় নহে, ইহা সামগ্রিকভাবে বর্তমান সরকারেরই পরাজয়। কারণ, স্বয়ং প্রেসিডেন্টসহ যখন কেন্দ্রীয় সরকারের হর্তাকর্তাদের প্রায় সকলেই এখানে উপস্থিত, তখনও তাঁহারা ছয়-দফা প্রশ্নে সামনাসামনি দাঁড়াইতে সক্ষম হন নাই।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেন, ছয়-দফা সম্পর্কে জনমতের সামনে দাঁড়াইতে তাঁহাদের সাহস না হওয়ায় ইহাই বুঝিতে পারা যায় যে, কেন্দ্রীয় চক্র জনসাধারণ সম্পর্কে ভীতসন্ত্রস্ত। জনাব ভুট্টোর পিঠটানের মধ্য দিয়ে কেন্দ্রীয় চক্র আরও স্বীকার করিয়া লইয়াছেন যে, ছয়-দফার প্রতি জনসধারণের সমর্থন রহিয়াছে।

বঙ্গবন্ধু বলেন, আমি এ-ধরনের আঠার শতকী মোকাবিলা প্রস্তাবে বিশ্বাসী নহি। আমরা জনমত যাঁচাইয়ের জন্য গণভোটে বিশ্বাসী। কিন্তু ভাবাবেগের আতিশয্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব ভুট্টো যখন আমাদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়িয়া দিলেন, তখন আমাদের উহা গ্রহণ না করিয়া উপায় ছিল না। আমরা জনপ্রতিনিধি। তাই, জনগণের আদালতেই আমাদের বিচার হইবে। জনাব ভুট্টোর প্রতি এজন্যই করুণার উদ্রেক হয় যে, তিনি আমাদেরকে চ্যালেঞ্জ দিয়া ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করিতে চাহিয়াছিলেন। কিন্তু তিনি ভুলিয়া গিয়াছিলেন যে, আমরা সেই লোক যাঁহারা জনগণের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী।

আমরা সর্বদাই জনগণের রায় গ্রহণে প্রস্তুত। ভুট্টো সাহেবের পিঠটানের ফলে আমাদের ছয়-দফার নৈতিক বিজয়ই সূচিত হইয়াছে। ইহা শুধু আমার বা আওয়ামী লীগের জন্যই আনন্দের বিষয় নহে, ইহা বস্তুত জনগণের জন্যই আনন্দের বিষয়। সুতরাং, আসুন, আজ আমরা আনন্দ প্রকাশ করি এবং আমাদের ছয়-দফা দাবি বাস্তবায়িত করার জন্য দশ কোটি লোকের পক্ষ হইতে আপসহীন সংগ্রামের শপথ গ্রহণ করি।

তিনি বলেন, জনাব ভুট্টোর অগৌরবজনক পশ্চাদপসারণের জন্য আমার দুঃখ হয়। তবে, এই প্রসঙ্গে বর্তমান সরকারের প্রতি ছয়-দফা প্রশ্নে জনমত যাচাইর জন্য অবিলম্বে গণভোট অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করার দাবির পুনরাবৃত্তি করিতেছি।

তিনি বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের রক্ষা ব্যবস্থা পূর্ব পাকিস্তানের উপরই নির্ভর করে। পূর্ব পাকিস্তানই জনশক্তি ও অর্থশক্তি দ্বারা পাকিস্তানের অবশিষ্ট অংশকে রক্ষা করিতে পারে।

প্রেসিডেন্ট আইয়ুব গৃহযুদ্ধের যে হুকমি দিয়াছেন, তাহাতে তিনি দুঃখ প্রকাশ করিয়া জিজ্ঞাসা করেন- কাহাদের জন্য এই গৃহযুদ্ধ হইবে? তিনি বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে লক্ষ্যে পৌঁছানোর নীতিতে বিশ্বাস করি। দেশে অসন্তোষ সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই গৃহযুদ্ধের হুমকি দেওয়া হইতেছে।

তিনি মওলানা ভাসানীর উক্তিরও সমালোচনা করেন এবং বর্তমান সরকারকে সহযোগিতাদান করায় তাহার বিরুদ্ধে গণস্বার্থ বিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগ করেন। তিনি মওলানা ভাসানী ও সরকারি নেতৃবৃন্দকে বল্গাহীন মন্তব্য না করার জন্য আহ্বান জানান।

দাবি আদায়ে জীবন বিসর্জন
একই দিন মাগরার এক বিরাট জনসভায় বক্তৃতাকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দাবি আদায়ের জন্য সকলকে জীবন বিসর্জনে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বাঁচিয়া থাকার যদি কোন অর্থ থাকে তবেই বাঁচিয়া থাকুন, নইলে গৌরবোজ্জ্বল মৃত্যুবরণই শ্রেয়।

বক্তৃতাকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশেষভাবে সাম্প্রতিক পাক-ভারত যুদ্ধের আলোকে ছয়-দফা দাবির গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেন।

তিনি বলেন, উক্ত যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান অবশিষ্ট বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগহীন হইয়া পড়ে। অথচ তথাকথিত সর্বময় শক্তিধর কেন্দ্রীয় সরকারও আমাদের কোন প্রকার সাহায্যে আগাইয়া আসিতে পারেন নাই। যুদ্ধরত রাষ্ট্র ভারতের দ্বারা আমরা তখন পরিবেষ্টিত হইয়া পড়ি। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় নাই। একটি বিদেশি রাষ্ট্রের মধ্য রাত্রির হুঁশিয়ারির দরুন ভারত তখন পাকিস্তান আক্রমণ করে নাই চিন্তা করা গৌরবের বিষয় নহে। 

সরকার তখন নিজেদের শক্তি দ্বারা দেশকে রক্ষা করিতে পারেন নাই, ইহা অবমাননাকর ছাড়া কিছু হইতে পারে না। নিজের দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করিতে পারিব না এবং এজন্য অন্যের উপর ভরসা করিতে হইবে ইহা অপেক্ষা শোকাবহ কি হইতে পারে? যাঁহারা পূর্ব পাকিস্তানে একটি অস্ত্র কারখানা স্থাপনেও রাজি নহেন, যুদ্ধের সময় তাহারা এই প্রদেশকে রক্ষার জন্য কি করিয়াছিলেন? দেশের জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগ এখানে বাস করে। অথচ যুদ্ধের সময় আমাদের ভাগ্য শিকায় ঝুলিতেছিল।

তিনি বলেন, গত ১৮ বছরে পূর্ব পাকিস্তান ক্রমশঃ দরিদ্র হইয়াছে। এখান হইতে অর্থ ও সম্পদ পাচার হইয়াছে। সাধারণ মানুষ দারিদ্র্যের চরমে যাইয়া পৌঁছিতেছে। এই অবস্থার মোকাবিলা করার জন্যই আজ ছয়-দফা বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়াছে। আর এই দাবি বাস্তবায়নের জন্য আমাদেরকে চরম ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত হইতে হইবে।

মাগুরার এই জনসভায় প্রায় বিশ হাজার লোক যোগদান করেন এবং খররৌদ্রের তাপ অগ্রাহ্য করিয়া আওয়ামী লীগ নেতার বক্তৃতা শ্রবণ করেন। মাগুরার ইতিহাসে দুপুরের প্রখর রৌদ্রে এত বড় জনসভা আর কখনও হয় নাই। বক্তৃতা শ্রবণের সময় শ্রোতারা দরদর হইয়া ঘামিতেছিলেন।

তথ্যসূত্র : এই দেশ এই মাটি গ্রন্থ।

এএইচ/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি