ঢাকা, সোমবার   ২৯ এপ্রিল ২০২৪

জেনে নিন দমের কৌশল

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৭:২০, ৯ জুলাই ২০২৩ | আপডেট: ১৫:১৯, ১১ জুলাই ২০২৩

সুস্বাস্থ্য একজন মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ। আর এ সুস্বাস্থ্যের অন্যতম প্রধান ভিত্তি দম। আমরা বলতে পারি, দম হচ্ছে জীবনের মূল ছন্দ। খাবার ছাড়া আপনি বেশ কিছুদিন বাঁচতে পারবেন, পানি ছাড়াও দিন কয়েক বাঁচা সম্ভব। কিন্তু দম ছাড়া অর্থাৎ অক্সিজেন ছাড়া আপনি বড়জোর পাঁচ মিনিট বাঁচতে পারেন, এর বেশি নয়।

জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমরা দম নেই, দম ছাড়ি। নিজের অজান্তে, সচেতন প্রয়াস ছাড়াই আমরা এই প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে যাই। গড়ে মিনিটে ১৬ বার ঘণ্টায় ৯৬০ বার দিনে ২৩ হাজার ৪০ বার আমরা দম নেই। আশি বছর বাঁচলে এই সংখ্যা দাঁড়াবে ৬৭ কোটি ২৭ লাধ ৬৮ হাজার। 

দমের মূল অনুষঙ্গ অক্সিজেন। এই অক্সিজেন আমাদের দেহের জৈব-তড়িৎ ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে, আর খাবারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয় দেহের জৈব-রাসায়নিক ভারসাম্য অর্থাৎ শরীরের সার্বিক অবস্থা স্বাভাবিক রাখার জন্যে খাবারের পাশাপশি দমও সমান গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত আমরা দুভাবে দম নিয়ে থাকি : ওপর পেটে দম (Abdominal breathing) : স্বাভাবিক অবস্থায় আমাদের দম নেয়ার সহজাত পদ্ধতিটি হলো এই এবডোমিনাল ব্রিদিং। কিন্তু এভাবে দম নিলে ফুসফুস পূর্ণমাত্রায় প্রসারিত হতে পারে না। ফুসফুস বঞ্চিত হয় পর্যাপ্ত অক্সিজেন থেকে। যার ফলে অধিকাংশ মানুষই আমরা পূর্ণ কর্মশক্তি ও প্রাণ-চঞ্চলতা নিয়ে কাজ করতে পারি না। বুক ফুলিয়ে দম (Thoracic breathing) : এভাবে দম নিলে ফুসফুস পূর্ণমাত্রায় প্রসারিত হতে পারে। প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেন ফুসফুসে প্রবেশ করে। ফুসফুস কাজ করতে পারে তার পুরো কর্মক্ষমতা নিয়ে। ফলে ক্লান্তি দূর হয় নিমেষেই এবং শরীর-মন সারাদিন প্রফুল্ল থাকে। এটাই দম নেয়ার সবচেয়ে সঠিক পদ্ধতি।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, শ্বসনতন্ত্রের অনেক অসুখের কারণ হলো সঠিকভাবে দম নিতে না পারা। দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমরা অধিকাংশ মানুষই এ ব্যাপারে উদাসীন। সঠিকভাবে দম নেয়া তখনই হবে-যখন আপনি নাক দিয়ে দম নেবেন, আপনার বুক ফুলবে এবং ফুসফুস প্রসারিত হবে পূর্ণমাত্রায়। এভাবে দম নিলে সারাদিন আপনি থাকবেন কর্মোদ্যমী ও প্রাণবন্ত। তাই যখনই পারেন, সচেতনভাবে বুক ফুলিয়ে দম নিন। দমের মধ্য দিয়ে শরীরে শুধু অক্সিজেনই প্রবেশ করে না, এক ধরনের প্রাণশক্তিও প্রবেশ করে। সাধকরা এটিকে বলতেন প্রাণা । তাই দম চর্চার এই পদ্ধতিকে প্রাচীন যোগব্যায়ামের ভাষায় সাধকরা অভিহিত করেছেন প্রাণায়াম নামে। প্রাণশক্তি বৃদ্ধি পায় ও দেহকে জরা-ব্যাধি থেকে মুক্ত রাখে বলেই এর নাম প্রাণায়াম। প্রাণায়াম আপনার দেহ ও মনের মধ্যে ব্রিজ বা সেঁতু হিসেবে কাজ করে।

স্ট্রেসের কারণে যখন সিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম উদ্দীপ্ত হয়, দেহ-মনে চলতে থাকে ফাইট অর ফ্লাইট রেসপন্স, তৈরি হয় অস্থিরতা অশান্তি এবং করোনারি ধমনীতে অযাচিত সংকোচন ইত্যাদি। আর এ অবস্থায় নিয়মিত প্রাণায়াম বা দম চর্চা আপনার দেহ-মনকে টেনশনমুক্ত করে। ভেতরে সৃষ্টি হয় এক অনাবিল প্রশান্তি। সিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেমের উদ্দীপনা কমে আসে। ফলে করোনারি ধমনীতে যে ক্ষতিকর সংকোচন সৃষ্টি হয়েছিলো সেটি দূর হয়।

আপনি আপনার চারপাশের বায়ুমণ্ডলে অবস্থিত অক্সিজেনের কথা ভাবুন। অক্সিজেন পরমাণু বাতাসে ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাতাসের এই অক্সিজেন পরমাণু হচ্ছে বস্তু। আর এই অক্সিজেন পরমাণুই দম নেয়ার সময় সেকেন্ডের হাজার ভাগের কম সময়ের মধ্যে ফুসফুসের প্রায় স্বচ্ছ পর্দা অতিক্রম করে রক্তের হিমোগ্লোবিনের সাথে যুক্ত হওয়ার সাথে সাথেই 'জীবন্ত' হয়ে ওঠে। হিমোগ্লোবিনের রঙ মুহূর্তে কালচে নীল থেকে উজ্জ্বল লাল রং-এ পরিবর্তিত হয়। বায়ুমণ্ডলের একটি বিক্ষিপ্ত অক্সিজেন পরমাণু রূপান্তরিত হয় 'আপনাতে', এই পরমাণু অতিক্রম করে প্রাণ ও নিষ্প্রাণ বস্তুর অদৃশ্য সীমানা।

একবার দম নেয়ার সাথে সাথে কী পরিমাণ অক্সিজেন পরমাণু শরীরে প্রবেশ করে? প্রতিবার দম নেয়ার সাথে সাথে শরীরের পাঁচ ট্রিলিয়ন লোহিত কণিকা বাতাসের মুখোমুখি হয়। প্রতিটি রক্ত কণিকায় রয়েছে ২৮০ মিলিয়ন হিমোগ্লোবিন অণু। প্রতিটি হিমোগ্লোবিন অণু ৮টি করে অক্সিজেন পরমাণুকে ধরতে ও পরিবহন করতে পারে। প্রতিবার দমের সাথে ১১x১০২১(১১,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০, ০০০,০০০)টি অক্সিজেন পরমাণু শরীরে প্রবেশ করছে। এই অক্সিজেন পরমাণুকে শরীরের 'ইট' মনে করলে আমরা বলতে পারি যে, আমরা প্রতি দমের সাথে উপরিউক্ত সংখ্যক নতুন 'ইট' শরীরের বিভিন্ন স্থানে লাগাচ্ছি। পুরাতন 'ইটের' বদলে একেবারে খাপে খাপে বসে যাচ্ছে নতুন 'ইট'। পুরাতন নতুনের জন্যে জায়গা করে দিচ্ছে সহজে-ঠিক নদীর প্রবাহের মতো।

শরীরের ভেতরে কত বিচিত্র তৎপরতায় জড়িয়ে পড়ছে মুহূর্ত আগের প্রাণহীন বস্তু অক্সিজেন। সাধারণত ৬০ সেকেন্ডে আর ব্যায়ামকালে ১৫ সেকেন্ডে অক্সিজেন পরমাণু পুরো শরীর ঘুরে আসে একবার। এ সময়ের মধ্যে শরীরে প্রবেশকারী নতুন অক্সিজেনের অর্ধেক রক্ত থেকে বেরিয়ে কিডনি সেল, নিউরোন, পেশি সেল বা ত্বক সেলের অংশ পরিণত হচ্ছে। অক্সিজেন এটম সেল ভেদে কয়েক মিনিট থেকে একবছর পর্যন্ত আপনার দেহে অবস্থান করতে এবং আপনি যা করতে সক্ষম তাতে সে পুরোপুরি অংশগ্রহণ করতে পারে। অক্সিজেন এটম একটি নিউরোট্রান্সমিটার-এর সাথে যুক্ত হয়ে আপনার একটি সুখকর চিন্তার অংশে পরিণত হতে পারে। আবার এড্রিনালিন অণুর অংশ হয়ে আপনার মধ্যে আতঙ্ক বিস্তার করতে পারে। গ্লুকোজের সাথে মিশে ব্রেন সেলের খাবারে পরিণত হতে পারে। আবার শ্বেত কণিকার অংশ হয়ে আক্রমণকারী ব্যাক্টেরিয়াকে প্রতিহত করতে গিয়ে আপনার জন্যে আত্মবিসর্জন দিতে পারে।

যোগ সাধনায় বহু ধরনের প্রাণায়াম রয়েছে। এর মধ্যে হৃৎপিণ্ডের সুস্থতার জন্যে উপকারী দুটি প্রাণায়াম হচ্ছে সহজ উজ্জীবন ও নাসায়ন। দিনের যেকোনো সময় যেকোনো পরিবেশে আপনি খুব সহজেই এ দুটি প্রাণায়াম অনুশীলন করতে পারেন। মুহূর্তেই হয়ে উঠতে পারেন টেনশনমুক্ত ও প্রাণশক্তিতে ভরপুর।

সহজ উজ্জীবন পদ্ধতি : মেরুদণ্ড পুরোপুরি সোজা রেখে দাঁড়ান অথবা বসুন। দুই হাত কোমরের দুই পাশে রাখুন। তাতে ফুসফুস পূর্ণমাত্রায় প্রসারিত হওয়ার সুযোগ পাবে। এবার সময় নিয়ে ধীরে ধীরে বুক ফুলিয়ে দম নিন। দম নেবেন নাক দিয়ে, মুখ বন্ধ থাকবে। দম নেয়ার সাথে সাথে বুক ফুলবে, ওপরের পেট নয়। ফুসফুস সর্বোচ্চ প্রসারিত হওয়ার পর কয়েক সেকেন্ড দম ধরে রাখুন, ফুস্ করে ছেড়ে দেবেন না। এবার ধীরে ধীরে মুখ দিয়ে দম ছাড়ুন। দম নেয়ার চেয়ে দম ছাড়তে একটু বেশি সময় নিন। একবার দম নেয়া হলো। এভাবে ১৯ বার দম নিলে এক দফা সহজ উজ্জীবন হবে। সারাদিনে পাঁচ/ ছয় দফা চর্চা করুন।

নাসায়ন বা একনাসা প্রাণায়াম পদ্ধতি : মেরুদণ্ড সোজা রেখে প্রথমে এক পা ওপরে তুলে আর এক পা ভাঁজ করে নিচে রেখে (ছবির মতো করে) বসুন। এবার ডান হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে নাকের ডানপাশের ছিদ্র চেপে ধরুন (ছবির মতো করে)। এমনভাবে ধরুন যেন বাতাস বেরিয়ে যেতে না পারে। এবার বামপাশের ছিদ্র দিয়ে দম নিয়ে অনামিকা দিয়ে বামপাশের ছিদ্রটিও বন্ধ করে দিন। তারপর বাম ছিদ্র বন্ধ রেখেই ডান ছিদ্র থেকে বুড়ো আঙুল তুলে ডান ছিদ্র দিয়ে দম ছাড়ুন। বাম ছিদ্র বন্ধ রাখা অবস্থায়ই নাকের ডান ছিদ্র দিয়ে পুনরায় দম নিন। দম নেয়া হলে বুড়ো আঙুল দিয়ে ডান ছিদ্র বন্ধ করে পুনরায় বাম ছিদ্র দিয়ে দম ছাড়ুন। এভাবে একবার ডান নাক বন্ধ রেখে বাম নাক দিয়ে ছাড়া আবার বাম নাক বন্ধ রেখে ডান নাক দিয়ে ছাড়া-এই মিলে এক প্রস্থ হবে। এভাবে আপনি ছয় থেকে ১০ প্রস্থ করতে পারেন। নাসায়ন আপনি পদ্মাসনে বসেও করতে পারেন।

এসবি/ 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি