গুম কমিশনের দ্বিতীয় প্রতিবেদন
‘ওড়না কেড়ে নিয়ে হাত বেঁধে ঝুলিয়ে রাখতো, আর বলতো এখন পর্দা ছুটে গেছে’
প্রকাশিত : ২১:২১, ৫ জুলাই ২০২৫ | আপডেট: ২১:২৬, ৫ জুলাই ২০২৫

একের পর এক ভয়াল অভিজ্ঞতা, শরীরে চিহ্ন, আর মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে ফিরে এসেছেন শত শত মানুষ। কেউ কেউ ফিরে আসেননি, হারিয়ে গেছেন চিরতরে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে এমন গুম, অপহরণ ও ভয়ংকর নির্যাতনের বিস্তৃত অভিযোগ এখন আর শুধু পরিবার-পরিজনের কান্নায় আটকে নেই; উঠে এসেছে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের চূড়ান্ত নথিতে।
‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ: এ স্ট্রাকচারাল ডায়াগনসিস অব এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ২৫৩ জন গুম হওয়া ব্যক্তির অভিজ্ঞতা, যারা কেউ ৩৯ দিন, কেউ ৩৯১ দিন ধরে বন্দী ছিলেন গোপন ‘টর্চার সেলে’। কোথাও মানুষ ঝুলিয়ে রাখা হতো, কোথাও দেয়া হতো বৈদ্যুতিক শক, আর নারীদের ওপর চালানো হতো এমন নির্যাতন যা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।
এই প্রতিবেদনে যেমন আছে দেহের ওপর চরম নিষ্ঠুরতা, তেমনি আছে মনের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নিপীড়ন। আছে নিখোঁজ থাকা পরিবারগুলোর অর্থনৈতিক ও সামাজিক ধ্বংসযাত্রার করুণ কাহিনি। ভুক্তভোগীদের বর্ণনায় গোপন বন্দিশালার ভয়াবহ নির্যাতনের কথা নিচে তুলে ধারা হলো।
‘গ্রিলের সঙ্গে হাতকড়া পরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখত, যাতে বসতে না পারি। পা ফুলে যেত, হাত রক্তাক্ত হতো। টেবিলের ওপর হাত রেখে আঙুলে প্লাস দিয়ে চেপে ধরত, আরেকজন সুচ ঢুকাত।’ এভাবেই নির্যাতনের বর্ণনা দিলেন ২০১৭ সালে অপহৃত হাবিব। মাত্র ২৭ বছর বয়সে ১১৩ দিন ‘গুম’ হয়ে ছিলেন তিনি। শুধু হাবিব নন, এমন শত শত ভয়াবহ বর্ণনায় ভরে উঠেছে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন। এই রিপোর্টে উঠে এসেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার হাতে আটক ও গুম হওয়া ব্যক্তিদের ওপর চালানো অমানবিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের চিত্র।
‘গুমের’ নামে ভয়াবহ নির্যাতন
রিপোর্ট বলছে, র্যাব-২ ও সিপিসি-৩ এর হেফাজতে ছিল ঘূর্ণায়মান চেয়ার, পুলি সিস্টেম, সাউন্ডপ্রুফ রুম। বন্দিদের ঝুলিয়ে, মেঝেতে গড়াগড়ি দিয়ে, বৈদ্যুতিক শকে, ওয়াটারবোর্ডিংয়ের মতো পদ্ধতিতে দিনের পর দিন নির্যাতন চালানো হতো।
গুমের শিকার বেশিরভাগ ব্যক্তিকে জনসম্মুখে হাজির করার আগে নির্যাতনের চিহ্ন মুছে ফেলার চেষ্টা চলত। কেউ কেউ স্পষ্ট নির্যাতনের দাগ নিয়েই হাজির হলেও, বিচার বিভাগ অনেক সময় তা উপেক্ষা করত।
নারীদের ‘বিশেষ শাস্তি’
গুম কমিশনের দেওয়া প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালে ২৫ বছর বয়সী এক নারীকে পুলিশ অপহরণ করে। তিনি ২৪ দিন ধরে নিখোঁজ ছিলেন। ওই ভুক্তভোগী গুম কমিশনকে বলেন, ‘অনেকটা ক্রুসিফাইড হওয়ার মতো করে হাত দুই দিকে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখে। ওরা আমাদের ওড়না নিয়ে নেয়, আমার গায়ে ওড়না ছিল না। আর যেহেতু জানালার দিকে মুখ করা ছিল, অহরহ পুরুষ মানুষরা এসে আমাদের দেখছিল। এটা বলার বাহিরে! মানে তারা একটা মজা পাচ্ছিল। বলাবলি করতেছিল যে, ‘এমন পর্দাই করছে, এখন সব পর্দা ছুটে গেছে।’ আমার পিরিয়ড হওয়ার ডেট ছিল অনেক লেটে। কিন্তু যেই টর্চার করে তাতে আমি এত পরিমাণ অসুস্থ হয়ে পড়ি যে, সঙ্গে সঙ্গে আমার পিরিয়ড আরম্ভ হয়ে যায়। তারপর উনাদেরকে বলি যে, ‘আমার তো প্যাড লাগবে’। এটা নিয়েও অনেক হাসাহাসি করে ওরা।’
শারীরিক নির্যাতনের ভয়াবহতা
ছাদের সঙ্গে ঝুলিয়ে বন্দিদের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হতো। সিটিটিসি কর্তৃক ২০২৩ সালে অপহৃত হন ৪৭ বছর বয়সী এক যুবক। ১৬ দিন গুম ছিলেন তিনি। তার বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্যাতনকারীরা বলছে, ‘এভাবে হবে না। এরে লটকা। টানাইতে হবে।’ তো একজন এএসআই (পুলিশে সহকারী উপ-পরিদর্শক) বলে, হবে। সে আমার দুই হাতে রশি লাগায়। এরপর ফ্যানের হুকের সঙ্গে রশি দিয়ে ঝুলিয়ে দেয়। শুধু পায়ের বুড়ো আঙুলটা লাগানো থাকে মেঝেতে, পুরা শরীরটা ঝুলানো।
প্লাস দিয়ে দাঁতে চাপ দেয়া হতো এবং দাঁত তুলে ফেলতো। ছবি: গুম কমিশন
প্লাস দিয়ে দাঁতে চাপ দেয়া হতো এবং দাঁত তুলে ফেলতো। ছবি: গুম কমিশন
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, গুম হওয়া ব্যক্তিরা নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে যেতেন। বমি করে দিতেন। কেউ কেউ আবার চোখ বাঁধা অবস্থায় নিজের শরীরের মাংস পোড়ার গন্ধ পেতেন। নির্যাতনের ভয়াবহতা থেকে রেহাই পেতেন না গুমের শিকার নারীরাও। তাদের ঝুলিয়ে বিকৃত উল্লাস করে অট্ট হাসিতে ফেটে পড়তেন বাহিনীর সদস্যরা।
বাঁশ দিয়ে নির্যাতন (বাঁশডলা)
২০১৭ সালে র্যাব-১০ কর্তৃক ২৭ বছর বয়সী এক যুবককে অপহরণ করা হয়। তিনি ৩৯ দিন গুম ছিলেন। নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে ওই যুবক বলেন, “শোয়ানোর পর আমার এই দুই হাতের উপর দিয়া আর ঘাড়ের নিচ দিয়া একটা বাঁশ দিছে। পরে পায়ের নিচ দিয়া আর রানের নিচ দিয়া একটা দিল। আবার রানের উপর দিয়াও একটা দিছে। দেওয়ার পর ওইভাবে আমাকে কিছুক্ষণ রাখল। পরে বলে যে, ‘বড় স্যার আসতেছে না।’ কিছুক্ষণ পর সে আসে। আসার পর হঠাৎ করেই বলল, ‘এই উঠ’। বলার সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো যে, আমি আর দুনিয়ার মধ্যে নাই। এমন যন্ত্রণা আমার দুই হাতের বাহুতে শুরু হইছে, আর দুই পায়ের মধ্যে শুরু হইছে...। মনে হইতেছে কেউ আমার এই দুই হাত আর পায়ের গোস্তগুলো ছিঁড়া ফেলতেছে...।’
অভিনব পদ্ধতিতে নির্যাতন
২০১৭ সালে ২৩ বছর বয়সী এক যুবককে অপহরণ করে র্যাব। সেই ভুক্তভোগীকে বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার জেআইসি’তে আটক রাখা হয়। যেখানে টর্চারের কারণে তার নাভির দুই পাশে আঘাতের চিহ্ন সৃষ্টি হয়। তিনি বলেন, ‘আমার পা বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। মাথা নিচের দিক, পা ওপরে দিক। আমার শরীরে কোনো পোশাক রাখে নাই তখন। তারপর আমাকে দুজন একসঙ্গে এলোপাথাড়ি পিটাতে থাকে। খুব সম্ভব বেতের লাঠি দিয়ে। পরবর্তীতে আমাকে অসংখ্যবার টর্চার করেছে এবং মারতে মারতে আমার এমন হয়েছে যে, চোখের কাপড়ও খুলে গেছে। নাকে-মুখে চড়ানো, থাপড়ানো...। শুধু পেছনে মারছে। ওই সময়ে চামড়া ছিঁড়ে, মানে চামড়া ফেটে রক্ত ঝরেছে। তিনি ৭২ দিন গুম ছিলেন।
নতুন নতুন কৌশলে নির্যাতন করা হতো টর্চার সেলে। প্রায়ই নখ উপড়ে ফেলা হতো সেখানে। ২০১৭ সালে র্যাব-১১ কর্তৃক অপহৃত হন ৫৬ বছর বয়সী এক ভুক্তভোগী। তিনি বলেন, ‘পরে নাম জানতে পেরেছি। তখন জানতাম না। সে (আলেপ উদ্দিন) লাঠি দিয়ে খুব টর্চার করত। একদিন আমাকেও বেশ টর্চার করে। টর্চার করে আর বলে যে, ‘তাকে টাঙায় রাখ, ঝুলায় রাখ।’ সেলের গ্রিলের সঙ্গে আমাকে ঝুলায় রাখল। সঙ্গে হাতকড়া ছিল। তো এইভাবে অনেক ঘণ্টা রাখার পর আমি আর পারছিলাম না। ওইদিনের পরে যখন টর্চার করল, আঙুলের নখটা পুরা উঠে গেছিল।’
থাকার স্থানের ভয়াবহ ও অমানবিক অবস্থার কথা তুলে ধরেন অপর এক ভুক্তভোগী। গুম হওয়া ব্যক্তি বলেন, ‘ঘুমাতে গেলে একজন আইসা বলতেছে যে, ‘এই ঘুমাইতেছেন ক্যান?’ মানে ঘুমাইতে দিত না। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে যাওয়ার পর বালিশ সরাই ফেলত। শীতের মধ্যে কম্বল-বালিশ সব সরাই ফেলত। এছাড়া চেয়ার ছাড়া (খালি পায়ের ওপর ভর দিয়ে) বসায় রাখত। আবার দেখা গেছে, হ্যান্ডকাপ পরায়ে বিছানার পাশে আটকে রাখত। এক হাতে মশা কামড়ালে মারা যেত না। খুব কষ্ট পাইতাম আর কী!’ তিনি ৩৯১ দিন গুম ছিলেন। তার বয়স ছিল ৪৬ বছর।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সেলগুলো ছিল ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ। সেখানে টয়লেট ব্যবহারের জন্য নিচু বিল্ট-ইন প্যান বসানো ছিল। তবে, মাঝে কোনো দেয়াল না থাকায় ভুক্তভোগীরা যখন শুয়ে থাকতেন, তখন তাদের শরীর প্রায়শই ওই প্যানের ওপরে পড়ে থাকত। ফলে তারা ময়লা, প্রস্রাব ও মলের অস্বাস্থ্যকর অবস্থার মধ্যে থাকতে বাধ্য হতেন। আরও ভয়াবহ ছিল, এসব সেলে স্থাপন করা ছিল সিসিটিভি ক্যামেরা। যার মাধ্যমে প্রতিটি কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করা হতো। অর্থাৎ ভুক্তভোগীদের সবচেয়ে ব্যক্তিগত মুহূর্তেও, যেমন- প্রাকৃতিক কাজের জন্য টয়লেট প্যান ব্যবহারের সময়ও চরম অপমান ও লজ্জার মধ্যে থাকতে হতো। অত্যন্ত ছোট ও সংকীর্ণ কক্ষগুলো বন্দিদের জন্য সর্বোচ্চ অস্বস্তি তৈরি করত।
‘বাস্তব পরিস্থিত আরও ভয়াবহ’
গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন (দ্য কমিশন অব এনকোয়ারি অন এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স) গঠিত হয়। এরপর কমিশন বলপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান, শনাক্ত, কোন পরিস্থিতিতে গুম হয়েছিলেন-তা নির্ধারণে কাজ শুরু করে।
এসএস//
আরও পড়ুন