ঢাকা, মঙ্গলবার   ১৯ মার্চ ২০২৪

ড্রেজিং বাজেটের অর্ধেক যায় প্রভাবশালীদের পেটে: ড. আইনুন নিশাত

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৯:০২, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ | আপডেট: ২২:০৬, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯

নদীমাতৃক বাংলাদেশের অনেক নদীই সময়ের পরিক্রমায় হারিয়ে যাচ্ছে। কোন কোন নদী মানচিত্র ছাড়া এখন খুঁজে পাওয়া দায়। যদিও সরকার বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নিয়ে নদীগুলো বাঁচাতে উদ্যোগ নিয়েছে। তবে নদী নিয়ে নেই তেমন একটা গবেষণা এবং সাধারণ মানুষের জানাশোনা।

এ বিষয়ে একুশে টেলিভিশনের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় নদী, নদীর মনস্তত্ত্ব, ড্রেজিং, নদী শাসন, মরুকরণ, বৃষ্টির পানি ব্যবহার, নদী দূষণ, নৌপথ পকিল্পনা নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন বিশিষ্ট পানি ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি সম্পদ প্রকৌশল বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশনের প্রতিবেদক মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

একুশে টেলিভিশনের পাঠকের কথা বিবেচনা করে তার এই বিশেষ সাক্ষাৎকারকে তিন পর্বে ভাগ করা হয়েছে। আজ প্রকাশ করা হলো এর দ্বিতীয় পর্ব (ড্রেজিং ও নদী শাসন)। 

একুশে টেলিভিশন: নদীর গভীরতা ও প্রশস্ততা রক্ষায় ড্রেজিং‘র কার্যকরীতা কতটুকু?   
ড. আইনুন নিশাত: ড্রেজিং দুই রকম। একটা হলো ক্যাপিটাল ড্রেজিং আর অন্যটা মেন্টেনেন্স ড্রেজিং। মেন্টেনেন্স ড্রেজিং যেখানে করা হয় সেখানে কিছু দিন পরপরই মেন্টেনেন্সে ড্রেজিং করতে হবে। যেমন পাটুরিয়া-গোয়ালন্দ, আরিচা-নগরবাড়ি সেখানে নিয়মিত ড্রেজিং করতে হয়। যেমন মাওয়া ও কাওরাকান্দি এখানে দুইটা ঘাট আছে। এখানে নিয়মিত ড্রেজিং করতে হয়। ড্রেজিং করে বালুগুলো পাশেই ফেলা হচ্ছে। এই বালুগুলো সরিয়ে ফেললে ভালো হতো। এ ড্রেজিং তেমন একটা কাজে আসে না। যেমন আড়িয়ালখা’র মুখে ঔখানে একটা চ্যানেল আছে সে চ্যানেলটা যদি ড্রেজিং করা যায় তাহলে কাজ হবে। 

অন্যদিকে নতুন চ্যানেল কাটাকে ক্যাপিটাল ড্রেজিং বলে। এই ড্রেজিং করে নতুন চ্যানেল কাটলেও কিছুদিন পর পর এর দৈর্ঘ্য ড্রেজিং করে আবারও বাড়ানো হয়। এরপরও ভরাট হয়ে যায়, তার মানে চ্যানেল ঠিক রাখার জন্য যে প্রবাহ লাগবে তা নেই। নদীর সেডিমেন্ট, প্রশস্ততা, প্রবাহ ও ঢাল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কাজেই গাবখান চ্যানেলে নদী শাসন প্রয়োজন। নদী শাসন করে তার প্রবাহ ঠিক রাখতে হবে। নদী শাসন অত্যন্ত ব্যয়বহুল। পদ্মা সেতু করতে যে খরচ হচ্ছে সে খরচেও বেশি লাগছে নদীটাকে ঠিক রাখার জন্য। নদীটা যাতে ব্রিজের তলা দিয়ে প্রবাহিত হয়। 

                                                       অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত

একুশে টেলিভিশন: দেশের একমাত্র কৃত্রিম আন্তর্জাতিক নৌপথ গাবখান চ্যানেলে কোন ড্রেজিং কার্যকর হবে বলে আপনি মনে করেন?
ড. আইনুন নিশাত: গাবখানে মেন্টেনেন্স ড্রেজিং করে অন্য চ্যানেলটির সঙ্গে সংযুক্ত করে দেন তাহলেও হবে না। এর প্রবাহটাকে টেনে আনতে হবে। মেঘনার অনেকগুলো চ্যানেলের অংশে গাবখান অবস্থিত সেখানে নদী শাসন করা প্রায় অসম্ভব।

একুশে টেলিভিশন: তাহলে গাবখানকে ঠিক রাখার জন্য কি প্রক্রিয়া অবলম্বন করা যায়?  
ড. আইনুন নিশাত: আপনি যদি ড্রেজিং করে তার গভীরতা বাড়ান তাহলে প্রবাহ বাড়াতে হবে। প্রবাহ বাড়ালে প্রশস্ততা বাড়বে। উল্টোটাও সত্য। প্রশস্ততা ও গভীরতা বাড়ালে প্রবাহ বেশি দিতে হবে। গাবখান চ্যানেল কাটার সময় প্রশস্ততা যতটুকু ছিল তা এখন আর নেই। এখন আগের থেকে আরও চওড়া হয়েছে। নদী তার ধর্ম পালন করে বিভিন্ন চ্যানেলে সংযুক্ত হয়েছে। মূল স্রোতটা অন্য চ্যানেলের সঙ্গে মিশে যাওয়ায় সেটা আর আগের মতো নেই। প্রশস্ততার জন্য যে দরকারী প্রবাহ নেই। প্রশস্ততা ঠিক রাখার তাকে উপযুক্ত প্রবাহ দিতে হবে।

যেমন সিরাজগঞ্জের এক জায়গায় আমরা নদীকে ঠেকিয়ে দিয়েছে। সেখানে নদী আর ভাঙ্গবে না। তবে এখনও নদী উন্মাদ। সেখানে কিছু চ্যানেল বন্ধ করে কিছু চ্যানেল উন্মুক্ত করতে হবে। নদী প্রশস্ত হতে চায়। যেমন ধরুন ১৯৫০ সালে বা তার আগে সিরাজগঞ্জে নদীর প্রশস্ততা ছিল প্রায় ৪ কিলোমিটার। আজকে ১২ কিলোমিটার। অর্থাৎ যখন নদীর প্রশস্ততা ৪ কিলোমিটার ছিল তখন পানি প্রবাহ কিন্তু এর থেকে কম ছিল না। এখন ১২ কিলোমিটার হলেও পানির জন্য ৪ কিলোমিটারের বেশি লাগে না। ১২ কিলোমিটার মধ্যে পানি-চর, পানি-চর এমন অবস্থা। এ চরগুলো নিয়মিত জায়গা পরিবর্তন করছে। আপনি আজকে একটা চর দেখলেন তো দুই বছর পর ওটা ভেঙ্গে গেছে। 

তাহলে নদী নিয়ে আমরা যখন কর্মকাণ্ড করি, নদী ঐ নির্দিষ্ট এলাকায় কিভাবে চলছে সেটা বিশ্লেষণ না করে কাজ করি নদী সেটাকে গ্রহণ করবে না। আমি মেন্টেনেন্স ড্রেজিং করছি আর নদী বলছে মানলাম না। সেডিমেন্ট এসে ভরে গেল।

একুশে টেলিভিশন: তাহলে কি নদী শাসন করে নদীর গভীরতা বাড়ানো সম্ভব?
ড. আইনুন নিশাত: প্রায় অসম্ভব। কারণ চ্যানেল তো অনেকগুলো। এই যে সম্প্রতি শরীয়াতপুরের নড়িয়াবাজার ভেঙ্গেছে। এ অংশটা ভাঙ্গার আগে অনেকভাবেই কিন্তু ভাঙ্গার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল। গত বিশ বছর ধরে ঐ জায়গাটা একটু আর গত দশ বছর ধরে বেশি করে ভেঙ্গেছে। এখানের যে চ্যানেলটা ছিল তা কিন্তু ভেঙ্গে বেঁকে গেছে। এখন ঐখানে নদী ভাঙ্গন ঠেকাতে হাজার কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে। কিন্তু তার কোন প্রয়োজনীয়তা ছিল না। ড্রেজিং এর প্রয়োজন ছিল না। কারণ নড়িয়াবাজারের সামনে যে চর পড়েছে তার কারণে কিন্তু এ অংশ ভাঙ্গে নাই। এটা ষোল আনাই প্রকৃতিক। নদী ভাঙ্গন ঠেকাতে এখানে বিভিন্ন পদক্ষেপ ভালো হলেও শত শত কোটি টাকা খরচ করে যে ড্রেজিং করা হচ্ছে সেটা অর্থহীন। 

একুশে টেলিভিশন: আপনি বলছেন অনেক ক্ষেত্রে ড্রেজিং অর্থহীন। আপনার কাছে এমনটি মনে হচ্ছে কেন?
ড. আইনুন নিশাত: গাবখান চ্যানেলের এখন যে জিওম্যাট্রিক অবস্থা এখানে আপনি যতই ড্রেজিং করেন সেখানে পলিতে ভরে যাবে কারণ প্রবাহ ঠিক নাই। যতক্ষণ না প্রাকৃতিকভাবে মূলধারাটা গাবখানের পাশে আসছে অথবা জোর করে ধারাটা আনছেন। তবে জোর করে ধারাটা আনা যাবে না। যেমন করতোয়া, গাবখান, মেঘনা এক না। করতোয়ার বিদ্যা দিয়ে মেঘনাকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এখানে যারা কাজ করছেন তারা পেশাগতভাবে নদী বোঝেন না। 

              নাব্যতা সংকটে শিমুলিয়া- কাঁঠালবাড়ি নৌ-রুট, সেখানে ড্রেজিং করা হলেও তা কাজে আসছে না।: ছবি-সংগৃহীত

এখন ড্রেজিং করলে অনেকের লাভ হয়। ঠিকাদারের লাভে আমাদের আপত্তি নাই। আমরা ঠিকাদারকে ১০ শতাংশ লাভ তো দিতে চাই। কিন্তু বাকি ৯০ শতাংশের কি হচ্ছে? এর অর্ধেক খরচ হয়, অর্ধেক চুরি হয়। নির্দিষ্ট কিছু লোক ড্রেজিং’র কাজ পায় অথবা সরকারের কিছু লোক তা চুরি করে। সরকারের কিছু লোক যখন চুরি করে সেখানে কেউ ধরতে যায় না।  

একুশে টেলিভিশন: তাহলে ড্রেজিং’র কোন উপকারিতা কি নেই?
ড. আইনুন নিশাত: আমি ড্রেজিং’র বিরোধিতা করছি না। শুধু ড্রেজিং করে নদীকে ঠিক রাখা যাবে না। তার সঙ্গে নদী শাসন করতে হবে। সব নদীর তো এক ব্যবস্থা নিলে চলবে না। প্রায় প্রতিটি নদীরই স্বতন্ত্র ধারা রয়েছে। প্রবাহের ধারা বুঝতে হবে। 

নদী যখন এঁকেবেঁকে যায় ওর তলাটাও কিন্তু সমান হয় না। কোথাও বেশি খাদ কোথা কম। যারা ড্রেজিং করেন তারাও জানেন এখন করছি আবার তিন কি চার বছর পর করতে হবে।
 
একুশে টেলিভিশন: দক্ষিণাঞ্চলের বেড়ি বাঁধের কারণে নদীর ক্ষতি হচ্ছে কি? এ বেড়ি বাঁধ তো তেমন একটা কাজে আসছে না। 
ড. আইনুন নিশাত: এখন থেকে একশত বছর আগে যে নদী উজানে আসছে আর ভাটায় নেমে যাচ্ছে তা কিন্তু আর আগের মতো নেই। নদীর পানি বিলে ঢুকে যেত। এখন আমরা বাঁধ দিয়ে পানি আটকে দিলাম। যে পানিটা বিলে যেত সেটা আর যেতে পারছে না। এমন অবস্থা পুরো উপকূল জুড়ে। এখানে জোয়ার ভাটা খেলত ৬ মিলিয়ন মিটার কিলো অর্থাৎ নদীর আকার ছিল এ প্রবাহকে কেন্দ্র করে। এখন নদীগুলোর প্রবাহ কমেছে কারণ বিলে পানি ঢুকছে না। বিলে ঢোকার ক্ষেত্রে ঐ পানি খালে যেত। এখন জোয়ারের পানি ঢুকছে না বলে ঐ পানি তিন ভাগের এক ভাগ হয়ে গেছে। পানির স্তর তো স্থায়ী। আগে যদি একশত ইউনিট পানি ঢুকত। তাহলে একশত ইউনিটের চ্যানেল ছিল। এখন এটা কমে ত্রিশ ইউনিট হয়ে গেছে। কারণ বিলে পানি ঢুকতে পারছে না। পানি যাওয়ার জায়গা নেই। কারণ পানি তো ভাটার সময় উল্টো দিকে রওনা দিবে।

পানি এসে তো কোন দিকে যেত পারে না। এতে নদী ভরে যায়। অর্থাৎ নদীর তলাটা ভরে যায়। কাজেই মংলার ঐ দিকের চ্যানেল ভালো রাখতে হলে মংলা বা মংলা-ঘাষিয়াখালির লিংকে নদীর প্রবাহ বাড়াতে হবে। এখানে যতগুলো বেড়ি বাঁধ আছে সেগুলো কেটে দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকতে দিতে হবে। প্রবাহ বাড়ান গভীরতা বড়বে, প্রবাহ বাড়ান প্রশস্ততা বাড়বে। দুটোর মধ্যে মিল রেখে রাড়াতে হবে। প্রশস্ততা সঙ্গে মিল করে গভীরতা বাড়ান প্রশস্ততা ঠিক থাকবে। 

উত্তরাঞ্চলের নদীগুলো আলাদা, ননটাইডাল রিভার। ছোট চ্যানেল। রাজশাহীতে পদ্মা ভেঙ্গে এখন শহরের দিকে আসছে আবার দশ বছর পর নদী মিয়ান্ডার করে ভারতের দিকে চলে যাবে। এটা নদী করবেই। নদী শক্তির ভারসাম্য রক্ষা করতে চায়। সারা বছর ওর প্রবাহ এক রকম থাকে না। বর্ষার সঙ্গে সমন্বয় করতে করতে শীতকাল চলে আসে আবার শীতকালের সঙ্গে সমন্বয় করতে করতে বর্ষা চলে আসে। কাজেই সেখানে একটা অস্থিরতা আছে।

এমএস/এসি
 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি