নভেম্বরে দেশ ছাড়লেও আমিই দলের সাধারণ সম্পাদক: ওবায়দুল কাদের
প্রকাশিত : ১৬:৩৩, ৬ জুন ২০২৫ | আপডেট: ১৬:৪০, ৬ জুন ২০২৫

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচিত, সমালোচিত ওবায়দুল কাদের লম্বা সময় গা ঢাকা দিয়ে থাকার পর এখন মুখ খুলেছেন। এখনো বাংলাদেশে কার্যত নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক থাকার কথা দাবি করেছেন তিনি।
প্রতিবেশী দেশ ভারতের কলকাতায় অবস্থান করা ওবায়দুল কাদের বিবিসি বাংলার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন।
ওবায়দুল কাদের দাবি করেছেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের শাসনের পতনের তিন মাস তিনি বাসা বদল করে করে আত্নগোপনে ছিলেন; শেষ পর্যন্ত তিন মাস পর গত বছরের নভেম্বরে তিনি নিরাপদে দেশ ছেড়ে গেছেন।
পাঁচই অগাস্ট ওবায়দুল কাদের জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় সরকারি বাসভবনে ছিলেন বলে জানান ওবায়দুল কাদের। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সড়ক পরিবহন মন্ত্রী হিসেবে সরকারি ওই বাড়িতে থাকতেন তিনি।
ওবায়দুল কাদের উল্লেখ করেছেন, তিনি সেদিন যখন ঢাকামুখী মিছিলের খবর পান, তখন সংসদ ভবন এলাকাতেই অন্য একটি বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
"আমি আমার বাসায় ছিলাম, সংসদ ভবন এলাকায়। যখন ঢাকা নগরী অভিমুখে বিভিন্ন দিক থেকে মিছিল আসছিল। মিছিলে তাদের একটা আক্রমণাত্মক মনোভাব ছিল। লাঠি-সোটা নিয়ে তারা যখন ঢাকা মহানগরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন তাদের মধ্যে যে বিদ্বেষের ভাব, সেটা বুঝতে পারলাম," বলেন ওবায়দুল কাদের।
রাজপথের পরিস্থিতি দেখে বাসভবন থেকে সরে পড়ার বিষয়টা যে অনুধাবন করতে হলো, সেটা স্পষ্ট মি. কাদেরের কথায়।
তিনি এক পর্যায়ে জানতে পারেন যে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বেতার ও টেলিভিশনে ভাষণ দেবেন। "সে খবরটি পেয়ে আমার বাইরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। সংসদ ভবন এলাকাতেই আর একটা বাড়িতে আমি আশ্রয় নিয়েছিলাম," বলেন মি. কাদের।
বাথরুমে আশ্রয়, জীবন বাঁচালেন আন্দোলনকারীরা-দাবি কাদেরের
সংসদ ভবন এলাকায় অন্য একটি বাড়িতে যখন আশ্রয় নেন মি. কাদের, তখন সঙ্গে তার স্ত্রীও ছিলেন। এক পর্যায়ে সেই বাড়িও আক্রান্ত হয়। তখন স্ত্রীসহ তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন বাথরুমে।
যদিও আওয়ামী লীগের পতনের দিন থেকে ওবায়দুল কাদেরের কোনো সাড়াশব্দ ছিল না, ফলে তাকে ঘিরে নানারকম গল্প ছিল আলোচনায়।
এখন মি. কাদের সেদিন বাথরুমের আশ্রয় থেকে বেঁচে যাওয়ার গল্প তুলে ধরলেন বিবিসির কাছে।
তিনি বললেন, "আমি একটু অনন্যোপায় হয়ে বাথরুমে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম। সেখানে অনেকক্ষণ থাকতে হয়েছে। "একটা পর্যায়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামে যারা সেদিন এসেছিল আমাদের বাসাবাড়ি আক্রমণ করতে, অনেকে ভাঙচুর-লুটপাট করছে। একটা বিভৎস অবস্থা," বলছেন মি. কাদের।
ঘটনার বর্ণনায় তিনি এ-ও বলেন, "এরা যখন সারা ঘরের সবকিছু লুটপাট ভাঙচুর করে, এতক্ষণ ধরে আমার ওয়াইফ তাদেরকে বাথরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে বারবার বলছিল আমি অসুস্থ। তারা প্রথমে বিষয়টিকে বিশ্বাস করে তারা অগ্রসর হয়নি।"
"কিন্তু শেষ পর্যন্ত যেটা বাস্তবে দেখলাম, ভেতরে যে কমোড এবং বেসিন- এটা তাদের টার্গেট। সেজন্য তারা জোর করে ঢোকার চেষ্টা করছিল। তো আমার ওয়াইফ আমাকে জিজ্ঞেস করল কী করব? আমি বললাম খুলে দাও।"
'আমি তখন নির্বাক, কিছু বলিনি'
মি.কাদেরের বর্ণনায়, "বাথরুমের দরজা খুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পড়িমড়ি ছুট। অনেকেই ঢুকে পড়ল। তারা হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে - তাদেরকে দেখলাম যে বিস্ময়ে ভরা চোখ। অবাক বিস্ময়ে তারা আমার দিকে তাকিয়ে।"
"আমাকে জিজ্ঞেস করল, আপনার প্রধানমন্ত্রী তো চলে গেছে, আপনি যাননি? আমি তখন নির্বাক। আমি কিছু বলিনি।"
মি. কাদেরের দাবি, "এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে একটা বিভক্তি দেখলাম। একটা গ্রুপ বলছে যে, না ওনাকে জনতার হাতে তুলে দেই। আবার কেউ কেউ বলছে, সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেই।
"একটা পর্যায়ে যারা আমাকে রক্ষা করতে চেয়েছিল তাদের সংখ্যার আধিক্যটা লক্ষ্য করলাম এবং তারা শেষ পর্যন্ত জয়ী হলো, " বললেন মি. কাদের।
শেষপর্যন্ত আন্দোলনকারীদের সেই দলটি মি. কাদেরের শার্ট পাল্টিয়ে এবং মুখে মাস্ক দিয়ে তাকে নিয়ে রাস্তায় নামল। তারাই তাকে ও তার স্ত্রীকে একটা ইজিবাইকে নিয়ে রাস্তায় মানুষের ভিড় থেকে রক্ষা করল বলে দাবি করেন তিনি।
"রাস্তায় লোকজনের ভিড় বেশি। আমার চাচা- চাচি অসুস্থ হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি- এ কথা বলে বলে বিভিন্ন জায়গায় বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমাদেরকে নিয়ে গেল। আমরা বিপদমুক্ত হলাম একটা পর্যায়ে," বলেন ওবায়দুল কাদের।
পাঁচই অগাস্ট ঢাকায় এভাবে বিপদমুক্ত হওয়ার কথা বলেন মি. কাদের। কিন্তু কোথায় গিয়ে বিপদমুক্ত হলেন এবং এরপর কোন এলাকায় বা কার আশ্রয়ে আত্মগোপনে ছিলেন––এ নিয়ে কিছু বলেননি মি. কাদের।
মি. কাদেরের দেশ ছাড়া নিয়েও নানা আলোচনা ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে। তবে এখনো তিনি তা স্পষ্ট করেননি।
এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে মি. কাদের বলেন, "দেখুন কীভাবে এসেছি, এটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। এটা বলার কী দরকার আছে? এসেছি তিন মাস পরে। পাঁচই অগাস্টের তিন মাস পর আমি নভেম্বর মাসে দেশ ছেড়েছি। এটুকু বলতে পারি।"
কারও সঙ্গে ছিল না যোগাযোগ
পাঁচই অগাস্টের পর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের দেশ ছেড়ে পালানোর বা গ্রেফতার হওয়ার নানা রকম খবর প্রকাশ হচ্ছিল। কিন্তু ওবায়দুল কাদের সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না। ভারতসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থান নেওয়া দলটির অন্য নেতারাও তার সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য দিতে পারেননি।
মি. কাদেরও বলছেন, ভারত যাওয়ার আগে তার সঙ্গে তাদের দলের নেত্রী শেখ হাসিনা বা অন্য কারও সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল না।
"কোনো যোগাযোগ ছিল না। সেখান থেকে আমি কোনো যোগাযোগের চেষ্টা করিনি। তখন আসলে আমার একটা কনসার্ন ছিল যে, আমাকে ধরার জন্য বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি অভিযান চলছিল।"
"আমাকে বার বার বাসা পরিবর্তন করতে হয়েছে। আমার ওখানে অ্যারেস্ট হওয়ার একটা ঝুঁকি আছে," বলেন মি. কাদের।
তিনি আরও বলেন, "আমাকে অনেকগুলো মেডিসিন নিতে হয়। আমার তো বাইপাস সার্জারি হয়েছিল। সেই কারণেই তখন এ ঝুঁকি নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। অনেকেই আমাকে প্রথম থেকেই দেশ ছাড়তে বলেছিল। কিন্তু আমি চেষ্টা করেছি দেশেই থাকার।"
"কিন্তু শেষ পর্যন্ত যেভাবে এখানে সেখানে তল্লাশি, তাতে আমি আর ঝুঁকি নিতে চেষ্টা করলাম না। বাধ্য হয়েই আমাকে দেশত্যাগ করতে হয়েছে," দাবি মি. কাদেরের।
কার্যত নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের কোনো পরিবর্তন হয়নি বলে উল্লেখ করেন মি. কাদের।
তিনি দাবি করেন, "আমি এখনো দলের সাধারণ সম্পাদক। আমাদের দলে তিন বছর পর পর কাউন্সিলে নেতৃত্ব পরিবর্তন হয়। আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ আছে। আমি এখন সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কথা বলা শুরু করেছি।"
'ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় নেওয়ার বিষয়ে ধারণা ছিল না'
পাঁচই অগাস্টে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, সংসদের স্পিকার ও আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, এমপিদের অনেকে এবং পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীরও অনেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
ওবায়দুল কাদেরও দেশের কোনো একটি সেনানিবাসে আশ্রয় নিয়েছিলেন– এমন আলোচনা, গুঞ্জন ছিল।
সে সময় আশ্রয় নেওয়াদের ৬২৬ জনের একটি তালিকা সম্প্রতি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়েছে। অবশ্য সেই তালিকায় ওবায়দুল কাদেরের নাম নেই।
মি. কাদের দাবি করেন, ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় নেওয়ার বিষয়টা তার ধারণায় ছিল না।
তিনি বলেছেন, "ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় নিতে হবে, এরকম কোনো ধারণা আমার ছিল না। তখন আমি একটা প্রাইভেট বাড়িতেই আশ্রয় নিয়েছিলাম। প্রথম দুই দিন চেঞ্জ (বদল) করে করে ছিলাম। ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে আশ্রয় নিতে হবে, এরকম চিন্তা আমি তখন করিনি।"
ক্ষমা চাইবে কিনা
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত বছরের জুলাইয়ের শুরু থেকে ১৫ই অগাস্ট পর্যন্ত কমপক্ষে ১৪০০ জন নিহত হয়েছে বলে জাতিসংঘের পরিসংখ্যানে বলা হচ্ছে। বাংলাদেশের সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে পাঁচই অগাস্ট পর্যন্ত সময়ে ৮৩৪ জন নিহত হয়েছে।
এত প্রাণহানির ঘটনার পরও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের এখনো কোনো অনুশোচনা নেই। এনিয়ে রয়েছে আলোচনা, সমালোচনা।
শেখ হাসিনাসহ দলটির নেতৃত্ব তাদের পতনের পেছনে 'ষড়যন্ত্রের' কথা বলছে। এই তত্ত্বের ওপর ভর করেই তারা ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে, এখনো পর্যন্ত এমনটাই মনে হচ্ছে দলটির নেতাদের কথায়।
তাদের এই অবস্থান নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝেও নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, তারা আসলে ভুল স্বীকার করবে কি না বা ক্ষমা চাইবে কি না?
এ সম্পর্কে ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য হচ্ছে, "একটা কথা আমি বলি আপনাকে। আমাদের মধ্যে চর্চা আছে। ঘটনার বিশ্লেষণে আমাদের ভূমিকা নিয়ে কথাবার্তা আছে।"
অবশ্য একইসঙ্গে তিনি বলেন, "দেশের অভ্যন্তরে যখন শান্তি, স্থিতি আসবে এবং আমরা দেশের মাটিতে রাজনীতি যখন করতে পারবো, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড যখন আমরা পরিচালনা করতে পারবো, যদি কোনো ভুল হয়ে থাকে- মানুষকে নিয়ে আমাদের রাজনীতি, এদেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চাওয়ার বিষয়ে আমরা কখনো পিছিয়ে থাকতে প্রস্তুত নই।"
মি. কাদের বলেন, "ক্ষমা চাওয়ার বিষয় দেশের মাটিতে। দেশের বাইরে থেকে আমরা ক্ষমাটা চাইবো কেমন করে? সব কিছুরই সূত্র হলো দেশ। দেশের মাটিতে বসেই আমরা যদি কোনো কিছু অনুশোচনা, ক্ষমা এসব বিষয় যদি থাকে তাহলে অবশ্যই আমরা দেশের মাটিতেই আমাদের যে বিশ্লেষণ, আমাদের যে রাজনৈতিক চিন্তা ভাবনা, তার প্রতিফলন অবশ্যই হবে।"
তবে বাংলাদেশে জুলাই আন্দোলনে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতাদের বিচার করা হচ্ছে। সেই বিচার না হওয়া পর্যন্ত দলটির কার্যক্রমও নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কার্যত নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ সহসাই রাজনীতিতে ফিরতে পারবে কি না, সেই প্রশ্ন রয়েছে। দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারাও অনিশ্চয়তার কথা বলছেন।
এমন প্রেক্ষাপটে ওবায়দুল কাদেরও স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারেননি।
এএইচ
আরও পড়ুন