ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪

পর্যটন শিল্পে রয়েছে অপার সম্ভাবনা: রাশিদুল হাসান

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৬:৪৩, ২৪ এপ্রিল ২০১৮ | আপডেট: ১৯:১২, ২৮ এপ্রিল ২০১৮

বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের রয়েছে অপার সম্ভাবনা এদেশে প্রায় পাঁচশ’ ছোটবড় প্রাকৃতিক ঐতিহাসিক পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে অপার নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য, প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহাসিক নিদর্শনসমৃদ্ধ বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প বিশ্বের ভ্রমণপ্রিয় মানুষকে আকৃষ্ট করছে। এ শিল্পের আরও বিকাশ দরকার। এতে করে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা যেমন ফুটে উঠবে তেমনি দেশের অর্থনীতির চাকাও দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাবে পর্যটন শিল্পে কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং বাংলাদেশের সম্ভাবনা নিয়ে একান্ত সাক্ষাৎকারে এমন অভিমত ব্যক্ত করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক . সৈয়দ রাশিদুল হাসান সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইটিভি অনলাইন প্রতিবেদক তবিবুর রহমান  

ইটিভি অনলাইন : পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে নিতে আমাদের কী কী করণীয় আছে বলে মনে করেন? 

. রাশিদুল হাসান : পর্যটন শিল্প যে আমাদের অর্থনীতির একটি বিশাল খাত হতে পারে- এ ধারণার বিকাশ ঘটে মূলত পঞ্চাশের দশকে। এরপর ১৯৯৯ সালে পর্যটনকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার পর্যটন কর্পোরেশনের মাধ্যমে এ শিল্পকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের প্রকৃতিক সৌন্দর্য্যে বহু পরিব্রাজক এবং ভ্রমণকারী মুগ্ধ হয়েছেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য, সমৃদ্ধ ইতিহাস, বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি আমাদের দেশকে একটি বহুমাত্রিক আকর্ষণ সমৃদ্ধ অনন্য পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করেছে। কিন্তু এ শিল্পে সমন্বয়হীন এবং দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা না থাকায়  তেমন বিদেশি পর্যটন টানতে পারছে না। আমাদের যে পর্যটননীতি আছে আমরা তার যথাযথ বাস্তবায়ন করতে পারছি না। এ খাতকে কীভাবে উন্নয়ন করা যায়- এ বিষয়ে সরকারি বা বেসরকারি কোনো ধরনের চিন্তা নেই।

আমরা এখন পর্যন্ত যতটুকু পর্যটন খাতে উন্নতি লাভ করেছি, তার সবটুকু হয়েছে বেসকারিভাবে। এ শিল্পকে আগামীতে সম্ভাবনাময় করতে হলে সরকারি ও বেসরকারি খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করতে হবে। কিন্তু সত্যি কথা হচ্ছে, এ খাত নিয়ে সরকারের যেভাবে কাজ করার কথা ছিলো, তা করেনি। তাছাড়া এ শিল্পেকে এগিয়ে নিতে একটি সুন্দর গাইডলাইন দরকার। আমাদের দেশে তারও সঠিক ব্যবস্থাপনা নেই। একজন পর্যটক কোনো সুন্দর স্থানে গিয়ে যদি তেমন গাইড লাইন না পায়, তাহলে তিনি কিভাবে বেড়াবেন?

ইটিভি অনলাইন : পর্যটন শিল্পে কী কী প্রতিবন্ধকতা আছে বলে আপনি মনে করেন?

. রাশিদুল হাসান : আমাদের দেশের পর্যটন শিল্পে সমন্বয়ের অনেক অভাব রয়েছে। এছাড়া দীর্ঘ পরিকল্পনা ও ভিশনের অভাব আছে। নিয়ম ও নীতিমালা থাকলেও তেমন বাস্তবায়ন নেই। সরকারি-বেসরকারিভাবে তেমন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। দক্ষ গাইডলাইনেরও অভাব রয়েছে। যারা আছে তাদের তেমন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। ফলে এ শিল্পে আমরা দক্ষমানব সম্পদ তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছি। ট্যুরিজম ব্যবসায় যারা জড়িত, তারা এটাকে ব্যবসা হিসাবে দেখছে। এদের মধ্যে দায়বদ্ধতার বেশ অভাব রয়েছে। আমি একবার বিদেশি পর্যটকদের সঙ্গে একটি জায়গায় গিয়েছিলাম। একজন পর্যটক একটি চিপসের প্যাকেট ফেলে দিলে। এটি লক্ষ্য করল আমাদের সঙ্গে থাকা গাইডম্যান। তিনি বললেন, স্যার আপনি একটা চিপসের প্যাকেট এখানে ফেলেছেল। প্রতি বছর এখানে হাজার হাজার পর্যটক আসে। সবাই যদি একটি করে প্যাকেট ফেলে রেখে চলে যায়, তাহলে কি হবে একবার ভাবুন তো! ট্যুর অপারেটর যদি সচেতন হয়, তাহলে পর্যটকরাও সচেতন হবেন। এ কারণে ট্যুর অপারেটরদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ খাতের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিভিন্ন মেয়াদী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। এমনকি প্রশিক্ষণ, পর্যটক স্থানের পরিবেশ রক্ষা ও জনগণের সচেতনতার জন্য অনেক টাকা ব্যয় করে। সে তুলনায় আমাদের দেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে। আমাদের দেশে এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেই। আপনি ট্যুরিজমের প্রসার বাড়ালেন, কিন্তু পর্যটন স্থানগুলো পরিবেশ ঠিক রাখলেন না; এর ফলে ধীরে ধীরে পর্যটক আসা বন্ধ করে দিবে। এছাড়া এ শিল্পে এখনও বিদেশিদের মতো বিনিয়োগ করা হয় না। দেশীয়  বেসরকারি বিনিয়োগ ও সরকারি উদ্যোগও উল্লেখ করার মতো নয়।

এছাড়া আমাদের এ শিল্পের সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট, তাদের সমন্বয় আগে দরকার। দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা ও পর্যটন স্থানগুলোর অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে পর্যটকদের ধরে রাখতে হবে। আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের সেবার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। তাহলে পর্যটকরা আমাদের দেশে বেশি দিন থাকবেন। এভাবেই ধীর ধীরে এ খাতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হবে।

ইটিভি অনলাইন :  এ শিল্পে যে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তা থেকে উত্তরণের উপায় কী ?

. রাশিদুল হাসান : সরকারসহ বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানকে একটি দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নিতে হবে। বর্তমানে বিশ্বের অর্ধেক পর্যটক যাচ্ছে ইউরোপে। তবে ২০৫০ সাল নাগাদ ৫১টি দেশের পর্যটক আমাদের দেশে আসবে। তখন পর্যটন খাতের অবস্থা কী হবে, এ বিষয়ে সরকারি বা বেসরকারি সংস্থার কোনো দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা নেই। এখন থেকে আমাদের এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। আগামী বছর আমরা কয়টা হোটেল করবো, কীভাবে করতে হবে, এ খাতে দক্ষ মানবসম্পদ কীভাবে তৈরি করা যায়- সেগুলো দেখতে হবে। বর্তমানে পৃথিবীর ৭ কোটি লোকের মধ্যে ১ কোটি হচ্ছে পর্যটক। আগামী ৫০ বছর পর ৪ কোটি ৫০ লাখ পর্যটক হবে। এখন যদি সঠিক পরিকল্পনা না গ্রহণ করি, তাহলে আমরা কিভাবে তাদের কাঙ্খিত সেবা দিতে পারবো। ট্যুরিজম বলতে, আমরা বুঝি অর্থনীতি ও পরিবেশ। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে সরকার বা আমাদের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে নিতে আমাদের সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি করতে হবে।

ইটিভি অনলাইন : বর্তমান পর্যটন খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ কেমন?

. রাশিদুল হাসান : বর্তমানে এ শিল্পে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে। একজন পর্যটক এলে ৪ জনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়। সেই হিসাবে যদি আমাদের দেশে ১ লাখ পর্যটক আসে তাহলে ৪ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এটাতো স্বাভাবিক হিসাব। আমাদের দেশের প্রায় ২২ লাখ লোক এ খাতে কাজ করেন। তবে এখানে দক্ষ লোকের অভাব রয়েছে।

ইটিভি অনলাইন : বর্তমানে দেশে যে জনবল আছে, তা যথেষ্ট কিনা?

. রাশিদুল হাসান :  আমাদের অনেক লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে। কিন্তু তেমন দক্ষ জনবল নেই। দেশের একটা দামী হোটেলে গেলে দেখা যায়, সেখানকার অধিকাংশ কর্মীই বিদেশি। এ খাতে মাত্র ২৫ শতাংশ বাংলাদেশি আর বাকিরা বিদেশি। কারণ আমরা জনবলকে তেমন দক্ষ করে তৈরি করতে পারছি না।

ইটিভি অনলাইন : আমরা তেমন বিদেশি পর্যটক টানতে পারছি না কেন?

. রাশিদুল হাসান : এর মূল কারণ হলো- আমরা তাদের চাহিদা অনুসারে সেবা নিশ্চিত করতে পারছি না। তাদের তেমন নিরাপত্তা ব্যবস্থা দিতে পারছি না। বিদেশি পর্যটক আনতে হলে, আগে দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে। এর পর দেখতে হবে কোন কোন দেশ থেকে বাংলাদেশে পর্যটক আসে। তাদের টার্গেট করে কাজ করতে হবে। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করতে হবে। পর্যটন স্থানগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণে উন্নতমানের হোটেল ও রেস্টুরেন্টের অভাব রয়েছে। যেগুলো আছে সেগুলোতেও সঠিক সেবা নিশ্চিত করতে হবে। আকর্ষণীয় পর্যটন স্থানগুলোতে যাওয়ার জন্য অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং পর্যাপ্ত রাস্তাঘাট না থাকায় পর্যটকরা নিরুৎসাহিত বোধ করেন। আমাদের পর্যটন স্থানগুলো অত্যন্ত অপরিচ্ছন্ন। এগুলো ঠিক করে সঠিক সেবা নিশ্চিত করতে কাজ করতে হবে।

ইটিভি অনলাইন : ট্যুরিজম এ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্টে শিক্ষার্থীরা কেমন কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে বলে আপনি মনে করেন?

. রাশিদুল হাসান : ট্যুরিজম এ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্টে থেকে যারা পড়াশোনা করে তাদের অধিকাংশই অন্য সেক্টরে চাকরি করছেন। অনেক শিক্ষার্থীর অভিভাবকরাও চান না তার সন্তান হোটেলে কাজ করুক। এছাড়া এখানে শুরুতে একটু কম বেতনে চাকরি করতে হয়। অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে অনেকেই এ খাতে আসতে চান না। এ শিল্পকে উন্নতি করতে হলে শিক্ষার্থীদের এ বিষয়ে আরও সচেতন হতে হবে।

ইটিভি অনলাইন : আমাকে সময় দেওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ?

. রাশিদুল হাসান : আপনাকেও ধন্যবাদ। ইটিভি পরিবারের জন্য শুভকামনা রইল।

[অধ্যাপক . সৈয়দ রাশিদুল হাসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক গ্রিসের এথেন্স ইউনিভার্সিটি অব ইকোনমিক্স অ্যান্ড বিজনেস সায়েন্স থেকে পিএইচডি  করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন]

/এআর


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি