ঢাকা, সোমবার   ২৯ এপ্রিল ২০২৪

স্মরণ

পান্না কায়সার : রক্তাক্ষরে লেখা নাম

ডা. নুজহাত চৌধুরী

প্রকাশিত : ১৬:২৫, ১১ আগস্ট ২০২৩

পান্না কায়সার

পান্না কায়সার

১৯৭২ সাল। যুদ্ধে বাবাকে হারিয়ে আমার মা তখন অতল সাগরে পড়েছেন। এর মধ্যে জানা গেল ইস্কাটনে একটি বাড়ি আছে। তার নিচতলায় মায়ের মতোই ছোট দুটি সন্তানসহ শহীদ শহীদুল্লা কায়সারের স্ত্রী শহীদ জায়া পান্না কায়সারকে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু।

চেষ্টা করলে মা সেই বাড়ির দোতলা পেতে পারেন। যুদ্ধের আগে মা ছিলেন তখনকার ঢাকার অন্যতম ব্যস্ত চিকিৎসকের স্ত্রী, যাঁর তিনতলা নিজস্ব হাসপাতাল ছিল। মা নিজে স্কুল শিক্ষিকা হলেও পরিবারের মূল উপার্জনকারী ছিলেন আমার বাবা। বাবাকে হারিয়ে আক্ষরিক অর্থেই আমাদের সব হারিয়ে গেল।

মা আবেদন করলেন। বঙ্গবন্ধু অতিদ্রুত বাড়িটি আমাদের থাকার জন্য ব্যবস্থা করে দিলেন। আমরা ১৬ ইস্কাটন রোডের বাড়ির দোতলায় উঠে এলাম। সেই থেকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দুটি পরিবারের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী জীবনযুদ্ধে একসঙ্গে পথ চলা।

সংগ্রাম করেছেন আমাদের মায়েরা। আমার বড় বোনের বয়স তখন তিন, আমার দুই, শমী আমার ছয় মাসের ছোট, অমি তো আরো ছোট। কী ক্ষতি হয়ে গেছে আমাদের জীবনে বোঝার বয়স হয়নি। খেলা নিয়েই ব্যস্ত আমরা। আমাদের দুই মা-ই ছিলেন শিক্ষিকা।

দুজনেই সাহসী সংগ্রামী। নিজেদের জীবনের চাকা শক্ত হাতে ধরলেন শুধু নয়, তাঁরা নিজেদের সন্তানদের জন্য হয়ে উঠলেন একই সঙ্গে বাবা ও মা। আমাদের সঙ্গে নানি, মামা-খালারাও ছিলেন। শমীদের সঙ্গেও তাঁদের পরিবারের অন্যরাও ছিলেন বলেই মনে পড়ে। মনে আছে, সেই ঢাকায় যখন গাড়িই ছিল কম, তখন মা চালাতেন বাবার মরিস মাইনোর গাড়ি, পান্না চাচি চালাতেন ভক্সওয়াগন গাড়ি। জীবন গড়ার পাশাপাশি দেশ গড়ার কাজেও থেমে ছিলেন না। সেই বাড়িটি রাজনীতি ও সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্রবিন্দুও হয়ে উঠেছিল দুই আলোকিত নারীর নেতৃত্বে। ১৯৭৪ সালে আমরা ধানমণ্ডিতে আমাদের দাদার বাড়িতে উঠে আসি। সেই পর্যন্ত আমার জীবনের শুরুর কয়টি বছরের কিছুটা ধূসর কিন্তু এক তীব্র মায়াবী স্মৃতির অংশ এই পরিবারটি।

১৯৭২ সালে যে কজন শহীদ জায়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি নিয়ে সর্বপ্রথম রাজপথে নেমেছিলেন, তাঁদের ভেতর শহীদ জায়া পান্না কায়সার ও শহীদ জায়া শ্যামলী চৌধুরী ছিলেন অন্যতম। সেই থেকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের মশাল ঊর্ধ্বে তুলে ধরে দেশ ও পরবর্তী প্রজন্মকে এই আদর্শের পথে অবিচল রাখতে তাঁরা সংগ্রাম করে গেছেন। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি যে ১০১ প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী গঠন করেছিলেন, মা ও পান্না চাচি তাঁদের অন্যতম। আজীবন পান্না চাচি এ আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তি ছিলেন। তাঁরা দুজনেই তাঁদের আত্মজীবনী রচনা করে গেছেন। এর মধ্য দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে দিয়ে গেছেন ১৯৭১ সালের অবিকৃত ইতিহাস, যেন কেউ কখনো একাত্তর, গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যা নিয়ে মিথ্যাচার করতে না পারে। এটাও দেশের প্রতি তাঁদের একটি বড় অবদান। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে পান্না চাচি জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে মহিলা এমপি হিসেবে মনোনীত হয়ে, দেশের আইন প্রণয়নের সর্বোচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত হয়ে দেশ সেবার সুযোগ পেয়েছিলেন।

অনুধাবন করতে হবে, তাঁদের এই যাত্রা কতটা কণ্টকাকীর্ণ ছিল। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর তাঁদের মাথার ওপর শেষ অভিভাবক যে মানুষটি ছিলেন সেই ছায়াও হারিয়ে গেল। স্বামীর হত্যাকারীদের দেশের ক্ষমতার মসনদে দেখলেন। তাদের দ্বারা আবারও পদে পদে নিপীড়নের শিকার হলেন। তবু তিনি পিছপা হননি, বরং আরো শক্তভাবে আদর্শের হাত ধরে এগিয়ে গেছেন। গড়ে তুলেছেন পরবর্তী প্রজন্ম। মুক্তিযুদ্ধের শহীদ সন্তানদের সংগঠন ‘প্রজন্ম ৭১’ শহীদ জায়া পান্না কায়সারের হাত ধরেই সংগঠিত হয়েছে। আমরা পান্না চাচি ও শমীর ডাকেই এক হয়েছিলাম। অনেকেই আমরা একজন অন্যজনকে চিনতাম না। তাঁদের সবাই চিনত, সেই বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল। তাই তাঁদের ডাকে সবাই এক হয়ে ১৯৯১ সালের ২৯ অক্টোবর গড়ে তুলি ‘প্রজন্ম ৭১’। শেষ দিন পর্যন্ত তিনি প্রজন্ম ৭১-এর উপদেষ্টা ছিলেন।

শহীদ জায়া পান্না কায়সার অধ্যাপক ছিলেন, শিক্ষার মধ্য দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের মেধা ও মননকে গড়ে তুলেছেন। ছিলেন ‘খেলাঘর’-এর সভাপতি। শুধু শিক্ষিত নয়, পরবর্তী প্রজন্মকে সংস্কৃতিমনা করে গড়ে না তুললে, নিজের সংস্কৃতির আলোয় হৃদয় উদ্ভাসিত না হলে সেই শিক্ষা যে মানুষকে আলোকিত করে তুলতে পারে না—তা পান্না কায়সার জানতেন। তাই খেলাঘরের কার্যক্রম নিয়ে ছুটেছেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। সেই অবিরাম ছুটে চলা তাঁর বৃথা যায়নি। তাঁর শেষ যাত্রায় খেলাঘরের ছোট ছোট ছেলেমেয়ে শহীদ মিনারে ছুটে এসেছে, শৃঙ্খলিতভাবে শ্রদ্ধা জানিয়েছে। এদের মধ্যেই তো তিনি বেঁচে থাকবেন। তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর ছাত্রদের মধ্যে। বেঁচে থাকবেন তাঁর আদর্শিক অনুসারীদের মধ্যে এবং এই দেশের ইতিহাসে।

তাই আজ ছেলেবেলার মায়াবী স্মৃতি যতই ভারাক্রান্ত করুক আমার হৃদয়কে, আমি সব বেদনা সরিয়ে, শূন্যতা মুছে ফেলে শহীদ জায়া পান্না কায়সারের কাছ থেকে শোককে শক্তিতে পরিণত করার দীক্ষা নিতে চাই। ফিনিক্স পাখির মতো ছাই থেকে আগুন পাখি হয়ে উড়ে যাওয়ার উদাহরণ হিসেবে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে চাই। তাঁর কর্মময় জীবনের জয়গান গাইতে চাই, ইতিহাসের পাতায় রক্তাক্ষরে লেখা অশ্রুতে ভেজা এক টুকরো অমলিন ইতিহাস হিসেবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পরিচিত করিয়ে দিতে চাই। শেষ বিদায়ে অসীম শ্রদ্ধা শহীদ জায়া পান্না কায়সার আপনার প্রতি। 

লেখক: অধ্যাপক শহীদ ডা. আব্দুল আলীম চৌধুরীর সন্তান। 


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


টেলিফোন: +৮৮ ০২ ৫৫০১৪৩১৬-২৫

ফ্যক্স :

ইমেল: etvonline@ekushey-tv.com

Webmail

জাহাঙ্গীর টাওয়ার, (৭ম তলা), ১০, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

এস. আলম গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান

© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি