ঢাকা, শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪

পিআইবিতে একজন ডিজি ছিলেন

প্রকাশিত : ১৮:৫৫, ৫ মার্চ ২০১৯ | আপডেট: ০৯:১০, ১৯ মার্চ ২০১৯

মো. শাহ আলমগীর বাংলাদেশে সাংবাদিকতার বিশাল পরিমণ্ডলে একটি সংবাদনন্দিত নাম। ১৯৫৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ধরণীতে ভাষার মাসে এসে আবার বিদায় নিলেন ভাষার মাসেই ২০১৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। যার কর্মোদ্দোগ ও অনুপ্রেরণায় অনুরিত হয়েছে দেশের সংবাদকর্মীগণ। একজন অভিজ্ঞ ও চৌকস সাংবাদিক নেতা হিসেবে সংবাদকর্মীদের কতটা কাছের মানুষ ছিলেন তা পরিলক্ষিত হয় পিআইবি’র ডিজি পদ অলংকরণের পর। প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ সমগ্র বাংলাদেশের কর্মরত গণমাধ্যমকর্মীদের পেশাগত মানোন্নয়ণে কাজ করায় যোগাযোগটা একেবারে নাড়ীর সঙ্গে। দেশের জেলা উপজেলার প্রান্তিক পর্যায়ের সংবাদকর্মীদের নিয়ে কর্মযজ্ঞ। সমগ্র দেশের প্রেসক্লাবগুলোর সঙ্গে পিআইবি’র নিবিড় সম্পর্ক। তারপরেও পিআইবিতে সাধারণ সংবাদকর্মীদের যাতায়াত ছিল যেন গৌণ। ২০১৩ সালের ৭ জুলাই শাহ আলমগীর এই প্রতিষ্ঠানে মহাপরিচালক হয়ে আসার পর পিআইবি পরিণত হলো সাংবাদিকদের চারণভূমিতে।

ব্রা²নবাড়িয়ার নবীনগরে জন্মগ্রহণ করলেও শৈশব-কৈশর কেটেছে ময়মনসিংহ অঞ্চলের দূর্গাপুর-গৌরীপুর স্কুল কলেজে অধ্যায়ণসহ। শিশু কিশোর সংগঠন চাঁদের হাট ছিল তার প্রাণের সংগঠন। শাহ আলমগীর পিআইবি’র মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেই দেশব্যাপী সংবাদকর্মীদের সঙ্গে পিআইবির সম্পর্কোন্নয়নের কাজে মনোযোগী হন। আমার মনে আছে প্রথম মাসেই একসঙ্গে তিনটি জেলায় প্রশিক্ষণ প্রদানে সফর করেন বাগেরহাট, খুলনা ও যশোর জেলা। এর পরের মাসেও একইসঙ্গে উত্তরবঙ্গের তিনটি জেলায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। এভাবেই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সংবাদকর্মীদেরকে প্রশিক্ষণের ফ্রেমে আনার ব্যবস্থা করেন এবং নিজে প্রায় প্রতিটি প্রশিক্ষণ ভেন্যুতে উদ্বোধন অথবা সমাপণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে তাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। পিআইবিতে প্রিন্ট মিডিয়ার সংবাদকর্মীদের পেশাগত মানোন্নয়নে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের মডিউল তৈরি ছিল যা দিয়ে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চলমান। তিনি ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সংবাদকর্মীদের জন্যও বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ প্রয়োজনীতা অনুভব করেন এবং প্রথমবারের ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকদের জন্য বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের মডিউল তৈরির দায়িত্ব পালনের সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তার সময়েই আলাদা আলাদাভাবে টিভি রিপোর্টিং, নির্বাচনি রিপোর্টিং, অনুসন্ধানমূলক রিপোর্টিং, অনলাইন মাধ্যমে রিপোর্টিংসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিষেশায়িত প্রশিক্ষণের প্রসার ঘটে। তিনি কাজের প্রতি এতটাই অনুরক্ত ছিলেন যে তার কর্মদিবসে কোন ছুটির দিন ছিল না অর্থাৎ সপ্তাহে পাঁচদিন নয় সাতদিনই ছিল তার কর্মদিবস।

পিআইবিতে অনলাইন সাংবাদিকতায় প্রশিক্ষণ-এর প্রবর্তন ঘটে শাহ আলমগীরের স্যারের উদ্যোগে। অনেক জটিলতা কাটিয়ে পিআইবি’র সান্ধ্যকালীন ডিপ্লোমা কোর্সকে মাস্টার্স কোর্সে উন্নীত করেন এবং মাস্টার্স কোর্স চালু করেন দ্রুততম সময়ে। মাস্টার্স কোর্স চালু করা তার প্রবল ইচ্ছার প্ররিস্ফুটন তবে কোর্সের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে অসুস্থতার কারণে উপস্থিত থাকতে পারেনি। আমি দেখেছি স্যারকে নিয়মের মধ্যে থেকে দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করতে। আরেকটি বিষয় খুবই অপ্রতুল যে শাহ আলমগীর স্যার দেশের সিনিয়র-জুনিয়র রাজধানী মফস্বল সব সাংবাদিককে সমান মর্যাদায় শ্রদ্ধা করতেন ভালোবাসতেন, সেখানে কোন কার্পণ্য ছিল না। সচারচর জুনিয়র ও নবীন সংবাদকর্মীরা সিনিয়র সাংবাদিকদের সানিধ্যে যাওয়ার সুযোগ কম পায়। কিন্তু স্যারের সঙ্গে দীর্ঘ ছয় বছর কাজ করার সৌভাগ্যে দেখেছি নতুন ও জুনিয়র সংবাদকর্মীগণ নির্দ্বিধায় সমুজ্জলে সহাবস্থানের পরিবেশ। মোদ্দাকথায় শাহ আলমগীর ছিলেন তরুণ সাংবাদিকদের একটি নির্ভরযোগ্য অভিভাবক। সংস্থার প্রধান হিসেবে তিনি তার কলিগদের ওপর কিছু চাপিয়ে না দিয়ে বরং মতামত শুনতেন ও আলোচনা করতেন। উদাহরণ স্বরূপ আমি বলতে পারি প্রশিক্ষণের রিসোর্সপার্সনদের তালিকা বাছাইয়ে আমার যথেষ্ট স্বাধীনতা ছিল এবং আমার তৈরি তালিকাকে তিনি সম্মান করতেন ভেবে আমি কর্মক্ষেত্রে অনুপ্রাণিত হয়েছি।

শাহ আলমগীরের কর্মোদ্দিপনায় পিআইবিতে আবাসিক কোর্স চালু হয় ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের মাধ্যমে। আমার মনে আছে আবাসিক কোর্স চালু হলে মন্ত্রণালয় থেকে আবাসিক চাপ ছিল তাদের জন্য কিছু সিট বরাদ্দ রাখা কিন্তু দৃঢ়চিত্তের শাহ আলমগীর তার প্রিয় সাংবাদিক সমাজের জন্য তৈরি এই অল্প কিছু সিট কাউকে ছাড়েননি। তাই পিআইবিতে শুধু ঢাকার বাইরে থেকে আসা সাংবাদিকরাই আবাসিকভাবে অবস্থান করতে পারে খুব সুলভে। পিআইবিতে বসে তিনি শুধু পিআইবি’র কাজই করতেন না, রাতদিন জেগে সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের কাজ করেছেন সাংবাদিকদের সাহায্য করার উদ্দীপণায়। তিনি শুধু একজন দক্ষ সাংবাদিক নেতাই ছিলেন না বরং পিআইবি’র সুবাধে দেখেছি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা খ্যাত মন্ত্রণালয়গুলির সঙ্গে দারুন আন্ডারস্ট্যান্ডিং। তাকে দেখেছি প্রশিক্ষণ সমাপণে প্রশিক্ষণ মূল্যায়ন কপিগুলো খুটিয়ে খুটিয়ে পড়তে। দারুন বিরক্ত হতেন পিআইবি’র ওয়েবসাইটে প্রশিক্ষণ সংবাদ-ছবি দিতে দেরী হলে। নতুন নতুন ধারণা ও চিন্তা চেতনার পিপাষু ছিলেন তিনি। বয়সে যত তরুণই হোক যুক্তিসম্পন্ন সময়োপযোগী যে কোন ধ্যান-ধারণার বাহককে প্রশংসায় মুগ্ধ করতে কখনো দ্বিধা করতেন না।

২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শাহ আলমগীরের কাজের বিবরণীতে তার দীর্ঘ ৫ বছর ৭ মাসের কর্মপ্রেরণায় বিরতিহীন শ্রমের স্বাক্ষর দীপ্তমান।

প্রকাশনা বিভাগ এ পর্যন্ত বের করে ৬১টি বই যার মধ্যে শাহ আলমগীরের সময়কালে ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বই বের হয়েছে ২১টি। গবেষণা বিভাগ ২০১৩-১৪ অর্থ বছর থেকে সম্পন্ন করা হয়েছে মোট ১৬টি। চলমান রয়েছে মোট ৫টি যেমন: (১) সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু ৪র্থ খণ্ড; (২) দৈনিক ইত্তেফাক ও সমসাময়িক সমাজ: ৫৩-৭০; (৩) বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের সংবাদ: ট্রিটমেন্ট ও পূর্বাপর সংবাদ সংশ্লিষ্ট ঘটনা বিশ্লেষণ ও (৪) child male treatment in Bangladesh magnitude and pattern portrait in newspaper.

শাহ আলমগীরের অক্লান্ত উদ্যোগে ২০১৯ সালের বইমেলা উপলক্ষ্যে গবেষণা বিভাগ থেকে বাংলা একাডেমীর জন্য ৪টি বই প্রকাশ করে পিআইবি: (১) খবরের কাগজে সংবাদ সূচনা: একটি মূল্যায়ণ (২) যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও সংবাদপত্র (৩) সংবাদপত্রে ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ এবং (৪) ঘটনাপঞ্জি ২০১৭।


পিআইবি’র ইতিহাসে এই প্রথম গবেষণালব্ধ জার্নাল বের করার চিন্তা করেন শাহ আলমগীর এবং ২০১৮ খৃষ্টাব্দে পিআইবি জার্নাল প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এসংক্রান্ত একটি গবেষণা কমিটি গঠন করে পিআইবি বোর্ড যেখানে কমিটির সদস্য নির্বাচন করা হয় ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে।
তিনি পিআইবিতে এসেই বাংলা একাডেমীর বইমেলায় নিয়মিত বই প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তারই উৎসাহে প্রকাশনা বিভাগ থেকে এবারের ২০১৯ সালের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে “ক্রীড়া সাংবাদিকতা”।

পিআইবি’র সদ্য প্রয়াত মহাপরিচালক শাহ আলমগীর-এর প্রকাশনা ও সম্পাদনায় প্রকাশিত গবেষণালব্ধ বইসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বঙ্গবন্ধু ও গণমাধ্যম (২০১৩); সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু (প্রথম খণ্ড)। পঞ্চাশের দশক) (২০১৪); তৃণমূল সাংবাদিকতা (২০১৫); বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সাংবাদিক (২০১৫); মিডিয়া ও সাম্প্রদায়িকতা (২০১৫); সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: দ্বিতীয় খণ্ড ষাটের দশক (প্রথম পর্ব) (২০১৫); দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তন গণমাধ্যম সহায়িকা (২০১৫); সাংবাদিকদের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক ১০টি হ্যান্ডবুক (২০১৫); অগ্রজের সঙ্গে একদিন : কামাল লোহানী (২০১৬); অগ্রজের সঙ্গে একদিন : তোয়াব খান (২০১৬); বেতার টেলিভিশন সাংবাদিকতা ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা (২০১৬); ঘটনাপঞ্জি- ২০১৩, ঘটনাপঞ্জি-২০১৪ ও ঘটনাপঞ্জি-২০১৫ (২০১৬); অগ্রজের সঙ্গে একদিন : আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী (২০১৭); গণমাধ্যম সহায়িকা ডিজিটাল বাংলাদেশ (২০১৭); সংবাদপত্রে প্রমিত বাংলার প্রয়োগ (২০১৭); জাতীয় উন্নয়নে আঞ্চলিক সাংবাদিকতা, সমস্যা ও সম্ভাবনা (২০১৭); তথ্য অধিকার আইন: প্রেক্ষাপট ও সম্ভাবনা (২০১৭); সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক: দ্বিতীয় পর্ব (২০১৭); হাবিবুর রহমান মিলন: ঘরে-বাইরে: সন্ধানী (প্রথম খণ্ড) (২০১৭); প্রধানমন্ত্রীর ব্রান্ডিং কার্যক্রমের গণমাধ্যম সহায়িকা (২০১৭); ডিজিটাল বাংলাদেশ, ফিচার সংকলন (২০১৭); ; সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক: দ্বিতীয় পর্ব (২০১৭); আলতাফ মাহমুদ স্মারকগ্রন্থ (২০১৭); ; ঘটনাপঞ্জি-২০১৬ (২০১৮); বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১৬-১৭ (২০১৮); শিশু ও নারীবিষয়ক ফিচার সংকলন (২০১৮) এবং ক্রীড়া সাংবাদিকতা (২০১৮)।

তার সময়কালে পিআইবিতে রচিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর উপর একাধিক গবেষণা বই। প্রকাশিত হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ব্রান্ডিং গষমাধ্যম সহায়িকা। প্রশিক্ষণকে নিয়ে গেছেন জেলা থেকে উপজেলায় আবার প্রান্তিক সাংবাদিকদের ঢাকায় এনে আবাসিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। সরকারের যেকোন কল্যাণকর প্রজ্ঞাপণ বা ঘোষণাকে গণমাধ্যম আঙ্গিকে এনে পিআইবি’র কর্মধারায় সংশ্লিষ্ট করতে তিনি নিরলসভাবে কাজ করেছেন।

শ্রদ্ধেয় স্যার বেঁচে থাকবেন তার প্রাণবন্ত কর্মের মাঝে। বেঁচে থাকবেন পিআইবির প্রিয় মহাপরিচালক হয়ে কেননা এই প্রতিষ্টানটির দীর্ঘদিনের সংকট পিআইবি বিল জাতীয় সংসদে ২০১৮ সালে পাশ হয়েছে তারই সফল প্রচেষ্টায়। প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ মনে রাখবে শাহ আলমগীরকে, মনে রাখবে তার কর্মপরিধিকে। মনে রাখবে তার সময়ে পিআইবির কর্মপরিবেশকে। দীর্ঘ ৫ বছর ৭ মাস পিআইবিতে কর্ম ও পরিবেশের তেমন কোন ব্যতয় ঘটেনি, ঘটেনি কোন অপ্রিতিকর ঘটনা যা আগের মহাপরিচালকগণ জ্ঞানে অজ্ঞানে সৃষ্টি করে গেছেন, ব্যহত হয়েছে কর্ম পরিবেশ আহত হয়েছে পিআইবি সুনাম ক্ষুন্ন হয়েছে প্রতিষ্ঠানের। শাহ আলমগীর-এর মতো মহাপরিচালক পিআইবি’র জন্য দীর্ঘ সময়ব্যাপী প্রয়োজন ছিল।

লেখক: প্রশিক্ষক, পিআইবি।

এসএইচ/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি