ঢাকা, শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪

বঙ্গবন্ধু এক সাহসের নাম

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১০:২৩, ২৫ আগস্ট ২০২০

বঙ্গবন্ধু এক সাহসের নাম। তাঁর জীবন নিয়ে যতই জানা যাবে তাতে এ বিষয়টি আরও বেশি অনুভূত হবে। হলফ করেই বলা যায়, তাঁর মধ্যে আরও বড় কিছু গুণ ছিল, তাঁর মুল্যবোধ নিয়ে কোনো স্মৃতি থাকলে সেখানেও তা দেখতে পাবেন। তাঁর এমনসব গুণাবলির জন্য তিনি মানুষের শ্রদ্ধারপ্রাত্র হয়ে ওঠেছিলেন। ইতিহাসের পাতায় থাকা বিখ্যাত সব মানুষের মধ্যে ও তাদের জীবনে এমন দেখা গেছে। এবং সে সব মূল্যবোধগুলোর মধ্যে রয়েছে- অন্যায়ে আপোস না করা, ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য আদর্শ থেকে পিছপা না হওয়া। যা আমাদের প্রিয় এ মানুষটির মধ্যে সব সময়ই ছিল। এমনকি ১৯৬৯ সালে কাওলাপিন্ডিতে গোলটেবিল বৈঠক চলাকালীন সময়ে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ওই প্রস্তাবে রাজি হননি বাংলার এ নেতা। ১৯৬৬ সালের ৬ দফার দাবিতে মুক্তি আন্দোলনে চালিয়ে যাওয়া এক স্বভাবজাত নেতার কাছে ওই সময়কার চলতি পরিস্থিতি হার মেনেছিল। তখন কেবল স্বাধীন বাংলাই ছিল তার সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অন্য কিছুই তিনি চাননি বা করেনও নি।

বঙ্গবন্ধুর চরিত্রটাই ছিল এমন। তিনি যেটাকে সঠিক মনে করেছেন বা তার কাছে ঠিক মনে হয়েছে সেটা করা বা বলা থেকে তাকে কেউ দমাতে পারেনি। ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বরে, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীর স্মরণ অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বকে জানিয়ে দেন যে পূর্ব পাকিস্তানের নাম হবে বাংলাদেশ। দীর্ঘ সংগ্রামের পথ পেরিয়ে এসেছিল বলে মুজিবকে মানুষের কাছে এর জন্য প্রমাণ দেয়ার কোনো প্রয়োজন পরেনি। ১৯৫৭ সালে, তখনকার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীকেও যে কথা বলেছিলেন তাতে কোনো ভুল করেননি তিনি। কথায় কথায় তাকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাঙলাকে যদি আলাদা দেশ না করা হয় তবে জিন্নাহ বেশিদিন ক্ষমতায় টিকতে পারবেন না। এ ধরনের চিন্তার জন্য সোহরাওয়ার্দী সেদিন বঙ্গবন্ধুকে তিরস্কার করেছিলেন। তবে, মুজিব তখন শুধু সময়ের অপেক্ষা করছিলেন। সময় আসলে কী করতে হবে তা তিনি জানতেন। তাঁর লক্ষ্যের প্রতি তিনি অবিচল ও দ্ব্যর্থহীন ছিলেন। ১৯৬০ এর দশকের গোড়ার দিকে পাকিস্তানের প্রতি তাঁর অসন্তোষ দৃঢ় আকার ধারণ করেছিল। তিনি জানতেন তাঁকে কোন পথ বেছে নিতে হবে। এবং তিনি দৃঢ়তার সাথে সে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। সেক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার চিন্তাভাবনার করার মতো ব্যক্তি তিনি ছিলেন না।

ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি এবং অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তির বার্তাবাহক বঙ্গবন্ধু ছিলেন সেই নেতা, যিনি বাংলার বিভিন্ন গ্রাম ও গ্রামান্তরে ছুটে বেড়িয়েছেন। এখনো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের সাথে যদি আপনি কথা বলেন যারা ‘মুজিবর’ কে চিনতেন এবং জানতেন। দেখবেন তারা তাঁর সমস্ত কিছুই মনে রেখেছেন। ১৯৭১ সালে তিনি যখন পাকিস্তানের কারগারে একাকী দুর্বিষহ জীবনের প্রহর গুনছিলেন তখন সাড়ে সাত কোটি বাঙালী তার জন্য দোয়া করেছিলেন। ওই বছর বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্তের দিকেই সব দলের, সব ধর্মের লোকজন তাকিয়ে ছিলেন। জাতীর মুক্তির পুরো বিষয়টি তাকে ঘিরে জেগে উঠেছিল এবং তা ছড়িয়ে পড়েছিল। আলজেরিয়ায় ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত জোট-নিরপেক্ষ সম্মেলনে কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ট্রোর সাথে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতার দেখা হয়। সে সময় তিনি বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গন করে বলেছিলেন, ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষটি হিমালয়ের সমান। যার স্বীকৃতি দিয়েছেন নাইজেরিয়ার ইয়াকুবু গাওনের মতো ব্যক্তিরাও। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাহস দেখে সৌদি আরবের ক্ষমতাধর রাজা ফয়সলও মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। বাঙালিরা কেন পাকিস্তানকে থেকে বেড়িয়ে গিয়ে স্বাধীন হতে চান তা বুঝে উঠতে পারছিলেন না রাজা ফয়সালের মতো ব্যক্তিও। এরপরে মুজিব তাঁর সুস্পষ্টভাবে বক্তৃতার মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছিলে কীভাবে পাকিস্তানিরা ইসলামের নাম ভাঙ্গিয়ে ধর্মকে নিপিড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছিল। মৌলিক রাজনৈতিক ভিত্তি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর নীতিগুলো দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে জুলফিকার আলী ভুট্টো যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতা করার কথা বলতে এসেছিলেন তখন বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, নির্বাচনে জনগণ যে রায় দিয়েছে সেখানে ভুট্টোর পিপলস পার্টির সংসদীয় বিরোধী দলের মধ্যেই থাকা উচিত। একাত্তরের মার্চ মাসের পরিস্থিতি অশান্ত হয়ে উঠার সময়েও তিনি তার এমন অবস্থান বজায় রাখেন। যদিও ওইসময় বিভিন্ন দিক থেকে তাঁকে চাপে রাখা হচ্ছিল। তবে ৬-দফা দাবিকে দমাতে পারেনি। এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাকে গুলি করে হত্যা করার চেষ্টা করলেও তিনি তা থেকে সরে আসেননি। তখন এক দফা হিসেবে সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ার আগে তিনি জাতির স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি ঘোষণার মধ্যে সবসময় একটা দূরদর্শিতা ছিল। তিনি ১৯৪৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচারের চূড়ান্ত সময়ে পশ্চিমা এক সাংবাদিককে দেয়া সাক্ষাৎকারে দৃঢ়ভাবেই বলেছিলেন, ‘আপনি জানেন, তারা আমাকে এখানে ছয় মাসের বেশি বন্দী রাখতে পারবেন না।’ সাত মাসের মাথায় তিনি ওই মামলা থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। ১৯৬০ এবং ১৯৭০ এর দশকের গোড়ার দিকে তিনি বাঙালি জাতিকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে তাদের জীবনে স্বাধীনতা আসবে। এবং সেটা তিনি করে দেখিয়েছেন। তিনি স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করার বিষয়টি এমনভাবে করেছিলেন যা কেবল সাংবিধানের রাজনীতিতে বিশ্বাসী একজন মানুষের পক্ষ্যেই সম্ভব। তিনি বিপ্লবী ছিলেন না, তাই তিনি পাকিস্তান সরকারের সাথে সরাসরি লড়াইয়ে যেতে চান নি। তিনি চিন্তাশীল ছিলেন, আর এই কারণেই ১৯৭১ সালের মার্চে সকল ষড়যন্ত্রকে উড়িয়ে  দিয়ে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এবং সে সময়ের তাঁর দেয়া বক্তব্য বাঙালি ইতিহাসের অংশ হিসাবে আছে, যাতে তিনি রাজনীতির মঞ্চে অনুপস্থিত থাকলেও সেখানে লোকদের জন্য স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। ওই নির্দেশনা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ৯ মাস জুড়ে বাস্তবায়িত হয়েছে।

তাঁর প্রতিটি কথা, তাঁর প্রতিচ্ছবি, তাঁর আদর্শ স্বাধীনতার সশস্ত্র সংগ্রামের রূপক হিসাবে কাজ করেছিল। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে, পাকিস্তানি কারাগারে বন্দী থেকে মুক্ত হয়ে যখন তিনি লন্ডনে বিশ্ববাসীর সাথে কথা বলছিলেন, তখন জেনে গেছেন যে তিনি ইতিহাসের একটি প্রতিমূর্তিতে পরিণত হয়েছেন। তিনি সেসময় মহাকাব্যিক মুক্তি সংগ্রামের অন্তর্নিহিত স্বাধীনতার আনন্দের কথা বলেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার নম্রতা এবং শালীনতা দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা যায়। তিনি কখনও কারো নাম ভুলে যেতেন না এবং সকলকেই মনে রাখতে পারতেন। এমকি যৌবনে যাদের সাথে তার পরিচয় হয়েছে তাদেরও তিনি ভুলেননি। তিনি ১৯৭২ সালের জানুয়ারির শেষদিকে ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থাকা ভারতীয় সাংবাদিক নিখিল চক্রবর্তীকে অবাক করে দিয়েছিলেন। তাদের দুজনের শেষ দেখা হয়েছিল ১৯৪৪ সালে। এরপর আর দেখা হয়নি। এবং চক্রবর্তী নিজেও ভেবেছিলেন যে বঙ্গবন্ধু তাকে চিনতে পারবেন না। কিন্তু তার ধারণা ভুল ছিল। বঙ্গবন্ধুর কক্ষে ঢোকার পরে যখন বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টি ওই সাংবাদিকের উপর পড়েছিল। তখন তিনি তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তুমি নিখিল না?’ বাকী বিষয় তো আর বলার দরকার নেই। বঙ্গবন্ধু অখ্যাত রাজনৈতিক কর্মীসহ সাধারণ মানুষ, কৃষক ও শ্রমিকদের নামও মনে রাখতে পারতেন। এমন বৈশিষ্ট্যের কারণে তিনি লাখ লাখ মানুষের কাছে প্রিয়ভাজন হয়ে উঠেছিলেন। এ গুণাবলী তাকে এমন এক পথপ্রদর্শক হিসেবে উপস্থিত করেছিল যিনি অন্ধকার থাকা মানুষদের পথ আলোকিত করেছেন। অধ্যাপক রাজ্জাক এবং ড. আবদুল মতিন চৌধুরীর মতো শিক্ষাবিদদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ছিল প্রশ্নাতীত।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বভাবজাত নেতা। তিনি উচ্চস্বরে ও গভীরভাবে হাসতে জানতেন। বিভিন্ন উপাখ্যান তার হাসির মাত্রা বাড়িয়ে দিত। দীর্ঘ সময় জুড়ে কারাগারে থাকা সত্ত্বেও তাঁর হাস্যোরস অন্যান্য রাজনীতিবিদদের থেকে তাকে আলাদা করেছিল। তার সাথে সাক্ষাত করতে গিয়ে ১৯৭০ সালের আবদুস সামাদ খান বলেছিলেন, আইয়ুব খান তাকে বুড়ো বানিয়ে দিয়েছে। তখন তিনি তার সরস প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন, ‘আইয়ুব খান তুমকো ভি বুদ্ধো বানা দিয়া, হাম কো ভী বুদ্ধো বান দিয়া' (আইয়ুব খান আপনাকে বৃদ্ধ বানিয়ে দিয়েছে এবং আমাকেও বৃদ্ধ বানিয়ে দিয়েছে)। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুকে তার দেশে স্বাগত জানিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ান বলেছিলেন যে তিনিও শেখ, মুজিবও শেখ। বাংলাদেশের জাতির পিতা তখন মজা করে বলেছিলেন, ‘তবে দুই শেখের মধ্যে তফাত আছে, আমি দরিদ্র শেখ।’ একথা শুনে দুজনেই হাসিতে ফেটে পড়েন।

এবং এটি সেই ব্যক্তির গল্প যিনি শ্রেষ্ঠত্বের উচ্চ আসনে আসীন হলেও ঘাসের শিশিরের সাথে তাঁর সম্পর্কের এতটুকু কমতি ছিল না। এক্ষেত্রে তিনি ছিলেন রাজা। এমন রাজা আর কবে আসবে?
এসএ/
 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি