ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কিছু কথা

শামসুর রাহমান

প্রকাশিত : ১৪:৪৯, ৮ আগস্ট ২০১৯

তাকে যখন প্রথম দেখি তখন তিনি ছিলেন শুধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৯ সালের মার্চ মাস। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচরীদের দাবি আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তরুণ তেজী নেতা শেখ মুজিব। এই আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন অলি আহাদ, কেজি মোস্তফা এবং আরও কেউ কেউ।

শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আমরা কিছুসংখ্যক সাধারণ ছাত্র তখন ভাইস চ্যান্সেলরের বাসভবন ঘেরাও করেছিলাম। আমার মতো ভেতর-গোঁজা মানুষের পক্ষে কোন মিছিল কিংবা ঘেরাও কর্মসূচিতে যোগ দেওয়া খুব সহজ ছিল না সেকালে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলনে কী করে যে সেদিন ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম তা ভাবলে এখনও বিস্মিত হই।

সেদিন ভাইস চ্যান্সেলরের সবুজ পাতা-অলা ছোট ছোট গাছের বেড়া-ঘেরা বাসভবনের সামনে, মনে পড়ে, দশাসই ঘোড়সওয়ার পুলিশের তাড়া খেয়েছিলাম। একটি বলবান অশ্বের খুরের ঠোকর আর পুলিশের ব্যাটনের বাড়ি খেতে খেতে বেঁচে যাই কোন মতে। দীর্ঘকায়, কান্তিমান শেখ মুজিব তার কথা এবং জ্বলজ্বলে দৃষ্টি আমাদের অনুপ্রাণিত করেছিলেন, জাগাচ্ছিলেন সাহস। সেদিন ঘোড়ার পায়ের নিচে পড়ে থেঁৎলে গেলেও হয়তো কোনো খেদ থাকত না। প্রকৃত নেতার প্রেরণার শক্তি বোধহয় এ রকমই হয়।

শেখ মুজিবকে দ্বিতীয়বার দেখি সৈয়দ আওলাদ হোসেন লেনে। তিনি যাচ্ছিলেন রিকশায়। তার পাশে কে একজন ছিলেন। তাকে চিনতে পারিনি। শেখ মুজিবের পরনে ছিল মেটে রঙের খদ্দরের পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা এবং কালো কাবুলি চম্পল। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, চশমার আড়ালে এক জোড়া দীপ্তিমান চোখ। আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম তার দিকে। তিনিও আমার দিকে তাকালেন ক্ষণিকের জন্যে। আমাকে তার চেনার কথা নয়। তবু সেই সন্ধানী দৃষ্টিতে পরিচয়ের সূত্র খোঁজার আভাস ছিল। তার কি মনে পড়েছিল ভাইস চ্যান্সেলরের বাসভবন ঘেরাওয়ের সময়কার সেই অনভিজ্ঞ তরুণকে যে ঘোড়সওয়ার পুলিশের ঘোড়ার নিচে থেঁৎলে যেতে পারত, কিন্তু শেষ পর্যন্ত রক্ষা পেয়েছিল। কে জানে?

এরপর দীর্ঘকাল তাকে দেখেনি। জেনেছি তার একজন যুবনেতা থেকে পূর্ব বাংলার প্রথমসারির অন্যতম জননেতা হয়ে ওঠার কথা। ধাপে ধাপে তিনি এগিয়ে গেছেন মহত্ব এবং অমরত্বের দিকে। পাকিস্তানি স্বৈরশাসকেরা তাকে বার বার কারাবন্দি করেছে, কারণ তিনি বাঙালিদের স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে ছিলেন আপসহীন। ব্যক্তিগত আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে, আরাম কেদারার হাতছানি তুচ্ছজ্ঞান করে পথে পথে, মাঠে প্রান্তরে সাধারণ মানুষের কাছে ছুটে গিয়েছেন তাদের দুঃখ-দুর্দশা মোচনের তাগিদে। তিনি দেশের জনগণকে ভালোবেসেছেন, অকুণ্ঠ ভালোবাসা পেয়েছেন জনসাধারণের। বহু ত্যাগ ও সংগ্রামের পথে চলতে চলতে তিনি বঙ্গবন্ধু বলে খ্যাত হলেন, পরিণত হলেন জাতির জনকে। তারই নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হলো উনিশশ’ একাত্তরে, জন্ম হলো স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের।

যা হোক, তৃতীয় এবং শেষবার বঙ্গবন্ধুকে দেখলাম তখনকার গণভবনে। ‘ইত্তেফাক’-এর দেখাদেখি একদিন পর একটি বাসি টেলিগ্রাম প্রকাশ করে ‘দৈনিক বাংলা’। সরকারবিরোধী সেই টেলিগ্রাম ‘ইত্তেফাক’-এ প্রকাশিত হওয়ার একদিন পরে দৈনিক বাংলায় মুদ্রিত হওয়ায় বঙ্গবন্ধু রুষ্ট হন। চাকরিচ্যুত হলেন প্রধান সম্পাদক হাসান হাফিজুর রহমান এবং সম্পাদক আবদুল তোয়াব খান। আমরা দৈনিক বাংলার সাংবাদিক ও অন্যান্য কর্মচারী বঙ্গবন্ধুর কাছে দল বেঁধে অনুরোধ জানাতে গেলাম, যাতে হাসান হাফিজুর রহমান এবং আবদুল তোয়াব খানকে ‘দৈনিক বাংলায়’ পুনর্বহাল করা হয়। বঙ্গবন্ধু সেই যৌথ আবেদন গ্রহণ করেননি, কিন্তু কথা দিয়েছিলেন তাদের দু’জনকে ভালো কাজে নিযুক্ত করা হবে। তিনি কথা রেখেছিলেন।

সেবারও দীর্ঘকায়, সুদর্শন জননেতাকে দূর থেকেই দেখেছিলাম। তিনি কারও কারও সঙ্গে কথা বলছিলেন, কুশল বিনিময় করছিলেন হাসিমুখে। তার মুখে ক্রোধের অভিব্যক্তি ছিল না, কিন্তু ছিল আশ্চর্য দৃঢ়তা। তার সিদ্ধান্ত থেকে কেউ তাকে টলাতে পারবে না, এটা আমরা সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার বাক্যালাপ হয়নি কখনও, যদিও দু’একবার সুযোগ এসেছিল। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসের গোড়ার দিকে আলজেরিয়ার জোটনিরপেক্ষ দেশসমূহের শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের আগে বঙ্গবন্ধু আমাকে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য খবর পাঠান। যিনি এই বার্তা বহন করে এনেছিলেন তার নাম জনাব সেলিমুজ্জামান, তদানীন্তন তথ্য মন্ত্রণালয়ের একজন বড় কর্তা। তাকে বললাম : ‘এখন নয়, বঙ্গবন্ধু আলজেরিয়া থেকে ফিরে আসার পর অবশ্যই তার সঙ্গে দেখা করব।’ জনাব সেলিমুজ্জামান আমাকে জানালেন যে, বঙ্গবন্ধু আমাকে ‘দৈনিক বাংলার সম্পাদক নিযুক্ত করতে আগ্রহী।’ সেলিমুজ্জামানকে বললাম: ‘আমি সম্পাদক হতে চাই না। বড় ঝুট ঝামেলার কাজ। আমি কবিতা লিখতে চাই।’

পরে অবশ্য বঙ্গবন্ধুর কাছে আর যাওয়া হয়নি। রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে ধর্ণা দেওয়া আমার ধাতে নেই। তবু দু’একবার বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছ থেকে দেখা এবং তার কিছু কথা শোনার সাধ ছিল। কিন্তু আমি সেই সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছি। ১৯৭৫ সালের পনেরই আগস্ট ষড়যন্ত্রীদের হাতে সপরিবারে নিহত হলেন বঙ্গবন্ধু, তার শিশুপুত্র রাসেলও কাতিলবদের পাশব হাত তেকে রেহাই পায়নি। বাংলাদেশের বুক ঝাঁঝরা হয়ে গেল বুলেটের আঘাতে। সেই ঘোর কৃষ্ণপক্ষে আরও নিহত হলেন আবদুর রব সেরনিয়াবত এবং তার পরিবারের কয়েকজন সদস্য।

আমার অনুজ ব্যারিস্টার তোফায়লুর রাহমান আবদুর রব সেরনিয়াবাতের জামাতা। পনেরই আগস্টের ট্রাজেডির পর আমাদের পরিবারকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। আমার ছোট ভাই এবং তার শোকাতুরা, ভীতসন্ত্রস্ত স্ত্রী মাহুৎটুলি থেকে সৈয়দ আওলাদ হোসেন লেনে চলে এলো অতি সন্তর্পণে, লোকচক্ষু এড়িয়ে। তখন কান্নার আওয়াজও নিষিদ্ধ বাংলাদেশে। শোকার্তদের ওপর যে কোনো মুহূর্তে নেমে আসতে পারে উৎপীড়নের খাঁড়া। তাই আমার ভ্রাতৃবধূ জোরে কাঁদতেও পারেনি সেদিন।

এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের সংবাদ অপরিশীলিত, কর্কশ কণ্ঠে বেতারে উচ্চারিত হওয়ার পরই বুঝতে পারলাম আমরা প্রবেশ করছি এক অন্ধকার যুগে। আমাদের প্রিয় অনেক কিছুই পরিত্যক্ত হবে একে একে।

সত্যি বলতে কি, বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার আগে তাকে আমি হৃদয়াসনে বসাতে পারিনি। জানতাম, তিনি একজন মহান নেতা, বাংলাদেশের স্থপতি। তাকে খুব শ্রদ্ধা করতাম ঠিকই। আমার অনুজ আবদুর রব সেরনিয়াবাতের জামাতা হওয়ার সুবাদে বঙ্গবন্ধু আমার আত্মীয়ও বটে। এতদসত্ত্বেও তিনি আমার কাছে মহান, অথচ দূরের মানুষ হয়েই ছিলেন জীবদ্দশায়। মৃত্যু তাকে আমার হৃদয়ে স্থাপন করেছে, তার মতো আপন কোনো রাজনৈতিক নেতাকেই মনে হয় না আজ।

মনে পড়ে, পনেরই আগস্টের হত্যাকাণ্ড আমাকে এত মর্মাহত, বিচলিত, শোকার্ত করে যে সেদিন আমি অফিসে যেতে পারিনি। সব কিছু কেমন অর্থহীন হয়ে পড়েছিল সেদিন। দিনটিকে মনে হয়েছিল তমসাচ্ছন্ন। পরদিন ভগ্ন হৃদয়ে অফিসে গেলাম। কাজে মন বসাতে পারিনি। আমার ঘরে এসে বসলেন কয়েকজন সহকর্মী। ফওজুল করিমের মুখ এই মুহূর্তে আমার চোখের সামনে ভাসছে। আমার মুখ থেকে সেদিন একসময় বেরিয়ে এলো একটি ইংরেজি বাক্য ‘হি ইজ গোয়িং টু রাইজ ফ্রম হিজ গ্রেফ ওয়ান ডে।’ কে যেন সেই দুপুরে আমাকে দিয়ে বলিয়ে নিয়েছিল সে কথা। ফওজুল করিমের সে কথা মনে আছে, আশা করি। 

ঘাতকেরা ভেবেছিল তাকে কবরের মাটির তলায় চাপা দিলেই তিনি মুছে যাবেন, শেষ হয়ে যাবেন। তাকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার জন্যে অপপ্রয়াসের কোন বিরাম ছিল না। ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে একুশ বছর ধরে, ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করে।

কিন্তু জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মাটির তলায় চাপা দিয়ে রাখা যায়নি। এক অর্থে তিনি সগৌরবে উঠে এসেছেন কবর থেকে, উঠে এসেছেন তার প্রিয় বাংলাদেশে, ফসলের আভায়, কৃষকের হাসিতে, নদীর স্রোতে, মাঝির ভাটিয়ালি গানে, উত্তরবঙ্গের গাড়িয়াল ভাইয়ের ভাওয়াইয়া গানে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সঞ্চারী মিছিলে, সভায়। নতুন প্রজন্মের কাছে তিনি আজ উদ্ভাসিত স্বমহিমায়।

(লেখাটি ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু গ্রন্থ থেকে নেওয়া)

এএইচ/
 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি