ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

‘বাংলার মানুষ কাহারো করুণা চাহে না, চায় ইনসাফ-চায় তাদের হক’

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৫:০৫, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | আপডেট: ১৫:২২, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০

১৯৭০ সালের ৩০ অক্টোবর রোজ শুক্রবার আরমানিটোলার জনসভায় আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দলীয় কর্মীদের প্রতি গোলযোগের উস্কানির মুখে সংযম ও সহিষ্ণুতার পরিচায়দানের আহ্বান জানাইয়া বলেন, বাংলার স্বাধিকারকামী জনতার অগ্রযাত্রার মুখে নিজেদের পায়ের তলা হইতে মাটি সরিয়া যাইতেছে দেখিয়া কায়েমী স্বার্থবাদী ও শোষককুলের ভাড়াটিয়া মহল নির্বাচন বানচালের উদ্দেশ্যে যোগাযোগ সৃষ্টির উস্কানি দিতেছে।

সংশ্লিষ্ট মহলের প্রতি আগুন লইয়া খেলা না করার আহ্বান জানাইয়া বঙ্গবন্ধু বলেন, “গুণ্ডামির রাজনীতির দিন আর নাই। আর এ পথ যে সঠিক নয় এ দেশের ইতিহাসই তার প্রমাণ। সুতরাং বন্ধুভাবে আহ্বান জানাইতেছি, সত্যিকার রাজনীতি করিতে হইলে গুণ্ডামির রাস্তা ছাড়িয়া গণআদালতে আসুন, ৭ ডিসেম্বরেই রায় পাইবেন, দেশবাসী কাহাদের চায়।’

এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু অভিযোগ করেন যে, আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী একটি দলের লোকজন গত বৃহস্পতিবার রাত্রে লালবাগের আওয়ামী লীগ অফিসে অগ্নিসংযোগ ও দুইজন ছাত্রকর্মীকে ছুরিকাহত করিয়াছে। আজও (শুক্রবার) আবার তাহারা জিন্দাবাহারে আওয়ামী লীগ অফিস আক্রমণ করিয়াছে এবং রাস্তা হইতে আওয়ামী লীগ কর্মীদের নিকট হইতে একটি মাইক ছিনাইয়া নিয়াছে।

তিনি এই সমস্যার কঠোর নিন্দা করিয়া বলেন, আওয়ামী লীগ এ ধরনের সমস্যার সমুচিত জবাব দিতে সক্ষম- শতগুণ বেশি শক্তিতে আঘাতের পাল্টা আঘাত হানার ক্ষমতাও আওয়ামী লীগের আছে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ নির্বাচন ও গণতন্ত্রের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার স্বার্থেই যোগাযোগ পরিহার করিতে চায়। বঙ্গবন্ধু ঢাকার প্রবীণ সমাজপতি, মহল্লা প্রধান ও গণতান্ত্রিক শিবিরের প্রতি শপথ রক্ষায় সাহায্য করার আহ্বান জানান।

প্রদেশবাসী জনসাধারণকে সতর্ক করিয়া দিয়া বঙ্গবন্ধু বলেন, স্বাধীনতার সময় হইতে সুপরিকল্পিতভাবে বাংলার চাষি-মজুর-মধ্যবিত্ত-ব্যবসায়ীদের সমূলে ধ্বংস করার যে সুগভীর চক্রান্ত শুরু হইয়াছে, আজও ‍উহা চলিতেছে। তাই, এবার বাংলার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হইয়াই স্বাধীনতা সংগ্রামকালীন স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যমে সে ষড়যন্ত্রের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে হইবে।

আওয়ামী লীগ প্রদেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহবান জানাইয়া বলেন, ‘আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে ছয়-দফার পক্ষে আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কায় ভোট দিয়া সম্পদলোভী ২২ পরিবার, ষড়যন্ত্রকারী, শোষককূল ও বিশ্ববাসীকে জানাইয়া দিন যে, বাংলার মানুষের স্বাধিকারের দাবি স্তব্ধ করিয়া দেওয়ার সাধ্য পৃথিবীতে কাহারও নাই।”

প্রতিপক্ষীয় সকল অপপ্রচারের জবাবে বঙ্গবন্ধু উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন, আওয়ামী লীগ সাফ সাফ জানাইয়া দিতে চায়, বাংলার সাড়ে ৭ কোটি মানুষ কাহারো করুণা চায় না, চায় ইনসাফ- চায় তাদের হক। তারা মানুষের পরিচয়েই বাঁচিতে চায়, কাহারো কলোনি হইয়া নয়। আর এই কারণেই আওয়ামী লীগের সংগ্রাম এদেশের মাটি হইতে শোষণ বঞ্চনার শেষ কলঙ্ক চিহ্নটুকুও মুছিয়া ফেলার সংগ্রাম।

বঙ্গবন্ধু পুনরায় বুড়িগঙ্গার সেতু নির্মাণ, ঢাকা শহরের এক হাজার টাকা পর্যন্ত মূল্যের হোল্ডিং-এর কর মওকুফ এবং বস্তিবাসীদের বাসোপযোগী কলোনি নির্মাণের দাবি জানান।

আওয়ামী লীগ প্রধান তাঁহার বক্তৃতায় ২৩ বছর ধরিয়া বাংলার জনগণের বিরুদ্ধে পরিচালিত শোষককূলের ষড়যন্ত্রের ইতিবৃত্ত, বাঙালির দুঃখের কাহিনী ও কারণ, দুই প্রদেশের মধ্যকার পর্বত প্রমাণ বৈষম্যের খতিয়ান এবং শোষণ লুণ্ঠনের চারণক্ষেত্র বাংলাকে অর্থনৈতিক উপনিবেশবাদের শৃঙ্খল হইতে মুক্ত করার উপায় বর্ণনা করিতে থাকিলে জনতা পর্যায়ক্রমে বিক্ষোভ ও উল্লাসে ফাটিয়া পড়িতে থাকে।

আবেগ কম্পিত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলার তেইশ বছরের ইতিহাস শোষণ-বঞ্চনা নির্যাতন-গুলির ইতিহাস, দুর্দশাগ্রস্ত বুভুক্ষু দুঃখী-দরিদ্র্যের অসহায় আর্তনাদের ইতিহাস। আসন্ন নির্বাচনে ছয়-দফার পক্ষে ভোট দিয়া দুই যুগের এই কলঙ্কজনক অধ্যায়কে বিস্মৃতির আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করিয়া নতুন এক শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়িয়া তোলার ব্যাপারে সমর্থন জানানোর জন্য তিনি জনগণের প্রতি আহবান জানান।

সমবেত জনতার গগনবিদায়ী স্লোগান ও করতালি ধ্বনির মধ্যে বঙ্গবন্ধু দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, তেইশ বছর ধরিয়া যারা বাঙালির রক্তমাংস চিবাইয়া খাইয়াছে, যারা সোহরাওয়ার্দী-শেরেবাংলাকে অপমান করিয়াছে, যারা বাংলার অগণিত ভাইবোনকে হত্যা করিয়াছে, তাদের সাথে বাংলার তথা এদেশের মানুষের কোন আপস নাই। 

জনাব গিয়াসউদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় পাঞ্জাব আওয়ামী লীগের সভাপতি মালিক হামিদ সরফরাজ, সৈয়দ আহমদ রেজা প্রমুখও বক্তৃতা করেন। সভায় বঙ্গবন্ধু রমনা-মিরপুর-মোহাম্মদপুর এলাকায় জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জনাব জহিরুদ্দিন, রমনা-লালবাগ প্রাদেশিক পরিষদ আসনে দলীয় প্রার্থী কাজী গোলাম মোস্তফা, কোতোয়ালী-সূত্রাপুর প্রাদেশিক আসনে প্রার্থী জনাব সিরাজুল ইসলাম এবং তেজগাঁও প্রাদেশিক আসনে স্বীয় দলের প্রার্থী জনাব হেদায়েতুল ইসলামকে পরিচয় করাইয়া দেন। সভার শুরুতে বঙ্গবন্ধুকে সোনা, রূপা ও কেকের নৌকার প্রতিকৃতি, টাকার মালা ইত্যাদি বহু উপহার দেওয়া হয়।

তথ্যসূত্র : এই দেশ এই মাটি গ্রন্থ।

এএইচ/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি