ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪

বাউল গান দিয়ে তরুণদের বদলে দিতে চান মোশাররফ

প্রকাশিত : ১৭:২৮, ২৬ অক্টোবর ২০১৭

‘যে ভাবনায় জীবন কেটেছে বাবার। আমারও কাটছে সে ভাবনায়। ছেলেটা? সেও তো একই ভাবনায়। অহর্নিশ কাদি (কান্না) এ ভাবনায়, কেমনে চিনাবো বাউল গান। কেমনে বদলাব তরুণদের মানসিকতা। কীভাবে বুঝাবো তাদেরকে (তরুণ) এ গান শিকড়ের গান। জীবনের গান। মাটি ও মানুষের গান।’ কথাগুলো এক নাগারে বলে যাচ্ছিলেন বাউল শিল্পী মোশাররফ হোসেন।

রাজধানীর রামপুরা সংলগ্ন হাতিরঝিলের আলো ঝিলমিলে পরিবেশে প্রায় রাতেই গানের আসর বসান বাউল শিল্পী মোশাররফ ও তার দল ‘বন্ধু বাউল’। না, আর্থিক স্বার্থসিদ্ধি কিংবা খ্যাতির তাড়না থেকে নয়। স্রেফ মনের টানে। ইট কাঠের যান্ত্রিক এ শহরের ব্যস্ত মানুষগুলোকে একটু বিনোদন দিতে, লোকজ সংস্কৃতি মনে করিয়ে দিতে দীর্ঘদিন ধরে তার এ সাধনা। তিনি চান নতুন প্রজন্ম বাউল গান ভুলে না যাক। মাটির এ গান তাদের এক সুঁতোয় বেঁধে রাখুক। নরম এ সুরের মর্ম হৃদয়ে গেথে মাদকসহ নানা অন্যায় ছেড়ে ঠিকপথে চলুক আজ ও আগামীর তরুণরা। মাদক, সন্ত্রাসসহ সব অপরাধ ও অপসংস্কৃতির প্রতিবাদ আসুক বাউলের সুরে সুরে।

শুক্রবার রাত ১১টায় বাসায় ফেরার পথে দেখা মেলে এ ‘নগরবাউলের’। চারদিকে গাড়ির হর্ণ আর শব্দদূষণের ভিড়ে হঠাৎ কানে বেজে উঠে মাটির সুর। একটু এগিয়ে যেতেই দেখা গেল মানুষের জটলা। গানের সুর শুনে পাশ দিয়ে যাওয়া পথিকরা থমকে দাঁড়াচ্ছেন। কেউবা দূর থেকে গুটিগুটি পায়ে আসরের দিকে এগিয়ে আসছেন। কেউ বা মোটরবাইক ও প্রাইভেট কার থামিয়ে আসর ঘিরে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। রাত বেশি হওয়ায় হাতিরঝিল ঘিরে চা বিক্রেতাসহ অন্য হকাররাও তাদের ব্যবসা ছেড়ে যোগ দিচ্ছেন আসরে। আসরে হাতির ঝিলের লাল, নীল, সবুজ আর হলুদ বাতির আলো এসে চুইয়ে পড়ছে। হাতির ঝিলে বাতির আলো-আধারের খেলা গানের আসরকে দিয়েছে ভিন্ন এক মাত্রা। যা সত্যিই শ্রোতাদের নিয়ে যাচ্ছে সুর আর ভাবনার অন্য এক জগতে। বাউল শিল্পীর সুরের লহরীতে রাত যে গভীর হচ্ছে সেদিকে যেন কারো খেয়ালই নেই।

কেউ অপলক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকছে আসরের দিকে। কেউ কান পেতে গান শুনছে। কেউ গানে সুর মিলাচ্ছে। আবার কেউ গায়কদের সঙ্গে ঠোট মেলানোসহ নৃত্যও করছে। একটি গান শেষ না হতেই দর্শকরা বলে উঠছে, ভাই আরও একটা গান হোক। এভাবেই চলছে গানের পর গান। ফাঁকে ফাঁকে চলছে চা ও পানসহ হালকা কিছু খাওয়ার বিরতি। আসরের পাশে দাঁড়াতে প্রথমে শুনতে পেলাম মোশাররফ বাউল গানের সুরে আপন ভঙ্গিমায় মনের সুখে গেয়ে চলেছেন-

‘আমাকে পাগল বলো না- আমি নই পাগল জামানায়;

কাঙ্গাল হয়েছি ভবের, এই দুনিয়ায়- আমি কাঙ্গাল হয়েছি ভবের, এই দুনিয়ায়।

তোমাকে খুঁজে বেড়াই মসজিদ মন্দির, মাঝারে- আসল খুঁজলে নকল মিলে ভবের, এই বাজারে;

পাগল মনে খুঁজি যে তাই- কোথায় গেলে তোমাকে-ই পাই

আল্লাহ বিনে মাবুদ কেহ নাই- আমি নই পাগল, জামানায়।

 পিতা আদম গন্ধম খাইলো ভুলে পড়িয়া- সেই ভুলের মাশুল দিতে আইলো দুনিয়া

মা হাওয়া আইলো ভবে- মানবের-ই কল্যাণে; সেই মানবের-ই জন্ম হলো অনুশোচনায়।

গানটি শেষ না হতেই চা ও সিগারেট বিক্রেতা হাশেম বলে উঠলেন, মামারা আমি বহুত নাচ্ছি (নেচেছি)। আমার চা বিক্রি কম অইছে। আমনেরা কিন্তু হোশায় দিয়েন। আমারেও কিছু বকশিশ দিয়েন। বয়স পশ্চাশোর্ধ এ বিক্রেতা এ প্রতিবেদককে উদ্দেশ্য করে বললেন, সাম্বাদিক (সাংবাদিক) ছ্যার-আমারে ভিডিওতে নিছেন তো? আমি কিন্তু বহুত জমাইছি। চা বিক্রি বন্ধ কইচ্ছি। টিভিতে দ্যাহায়েন আমারে। আমনেরে এক কাপ চা দেব ছ্যার? চা না দেওয়ার কথা বলতে না বলতে-ই বয়স্ক লোকটি আবারও বললেন, ‘খান খান ছ্যার, আজ মরলে কাল দু’দিন। আমরাও তো মানুষ-আমাগো তা খাইবেন না ক্যান? আরে হুনেন (শুনেন) হেয় (যেই) গান হুনছি। হে গানে পাপ নাই। হেয় গান হুনলে আল্লাহ এর কথা মনে পরে। এতো কষ্টের মাঝেও মনডা বালা থাহে। পরানডা জুরাই আহ।’

হাশেমের কথার ফাঁকে আবারও শুরু হয়ে গেল মোশাররফের গানের আসর। এবার মোশাররফ নতুন আর একটি গান গাইছেন-

ভালোবাসার ময়না পাখি, কেথায় গেলে পাই?- পিঞ্জর ভাইঙ্গা চইলা গ্যাছে, কাহারে জানায়?

এতো আপন করে পোষলাম তোরে, পিঞ্জিরার ভিতর- ফাক পাইয়া চইলা গেলি, ভাঙ্গিয়া অন্তর।

গানটি শেষ করে-ই আসরের মূল উদ্যোক্তা মোশাররফ ডেকে বলেন, ভাই শোনেন-এটা বাউল সঙ্গীত। মাটি ও মানুষের গান। যে গানের সুরে বেজে ওঠে গ্রাম বাংলা আর খেটে খাওয়া মানুষের কথা। আগের দিনগুলোতে এ গান ছিল মানুষের প্রাণের সুর। একসময় তরুণ-যুব সমাজের বিনোদনের মাধ্যমই ছিল বাউল গান। এই ‍সুর এক সুঁতোয় বাধত তরুণ থেকে বয়স্ক সব বয়সীদের। সমাজের নানা অনাচার ও অসঙ্গতির প্রতিবাদের ভাষা ছিল বাউল গান। কিন্তু এখন সে কদর যেন দিনদিন হারিয়ে যাচ্ছে। যা আমাকে খুব ব্যথিত করে।

‘‘ভাবনায় বারবার ঘুরপাক খায়- নতুন প্রজন্ম কি শিকড়ের এ গান শুনছে? অসংখ্য সুর আর গানের ভিড়ে নতুনরা হয়তো জানেই না, বাউল গানের সাধ ও মাধুর্যতা। তরুণরা যদি এভাবে বাউলকে না চিনে, বাউল গানকে না জানে, একদিন এ গান হারিয়ে যাবে। মুছে যাবে এ গানের অতীত।’’

তাই আমি মনের ব্যাথা ঘুচাতে ও তরুণদের মধ্যে এ গান বাঁচিয়ে রাখতে হাতিরঝিলসহ বিভিন্ন ফুটপাতের খোলা জায়গায় গানের আসর বসাই। আমার ‘বন্ধু বাউল’ এর ৭ সদস্যকে নিয়ে আসরে বসি। তরুণ প্রজন্মকে বাউলগানে বেঁধে রাখা যায় এমন কথামালায় গান লিখি। নিজেই সেটার সুর দিই। দলের সবাইকে নিয়ে সেটি গাই। আমার লেখা ও সুর করা পঞ্চাশের বেশি গান আছে। হাতিরঝিলের এ ব্রিজের আশপাশে জায়গাতে প্রতি শুক্রবার আসর বসাই। বিকালের দিকে অনেক তরুণ-তরুণী দাঁড়িয়ে আমাদের এ গান শুনে। ঠোট মিলায়। এমনকি অনেকেই ভিডিও করে। যা আমার খুব ভালো লাগে। তখন একটু হলেও নিজেকে স্বার্থক বলে মনে হয়।

মোশাররফ জানান, ঢাকার নবাবগঞ্জ জেলার কলাকোপা গ্রামে তার বাড়ি। বাবা আবদুল জলিল চৌধুরীও ছিলেন একজন বাউল শিল্পী। বাবার গুরু ছিলেন সিদ্দিক পাগলা। তিনি গুরুর কাছ থেকে গানসহ সাধক জীবনের বিভিন্ন তালিম নিয়েছিলেন। বাবা গ্রামে গ্রামে ঘুরে গানের আসরে বাউল গান গাইতেন। বাবার কণ্ঠে শুনেই বাউল গানের প্রতি ভক্তি আসে মোশাররফের। তাই বাবা-ই মোশাররফের গানের গুরু।

মোশাররফ শৈশবের স্মৃতিচারণ করে বলেন, তার বাবা ১৯৯৪ সালে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেছেন। উনি জীবতাবস্থায় আমাদের বাড়িতে প্রতি বছর উরস হতো। সেখানেও গানের আসর বসতো। কী-যে ভালো লাগতো ওই সময়ে, আমার পিতার গলায় গান শুনতে; বলে বোঝানো যাবে না। আমার পিতা সৌদি ও জাপানে ১০ বছর চাকরি করে এসেছেন। দেশে ফিরে এ গানই ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। আমার পিতার একটা হারমোনিয়াম ছিল। আমাদের সংসারে যখন কোন সমস্যা হতো। তখন তিনি ওই হারমোনিয়াম নিয়ে গান ধরতেন। সুর ছাড়লে মনে হতো আমার বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা। যার মনে কোনো কষ্ট নেই, অসুখ নেই। নির্বাক চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আমার সঙ্গে আমার মা ও তাকিয়ে থাকতেন বাবার দিকে। গান শেষে বাবা বলতেন, বাবা এ জীবন নশ্বর। সবাইকে একদিন চলে যেতে হবে। কী হবে মিছামিছি দুনিয়ার চিন্তা করে। তার চেয়ে মালিককে স্মরণ করো। উনি সব মুশকিলে আহসান করে দিবেন।

আমি বলতাম আব্বা মালিক কে? বাপ উত্তর দিতেন মালিক হলো তোমার আমার জীবন দাতা। এ দুনিয়াই আইছো ফসল ফলাইবার লাইগা। ফসল ফলাইবার পারলেই তোমার জীবন স্বার্থক। মানুষকে জানাতে হবে- তুমি মাটির তৈরি, দাঁড়িয়ে আছো সেই মাটিতেই, যতদিন দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে- ততোদিনই তোমার দুনিয়াবী জীবন। দম যখনই ফুরাবে আর দাঁড়াতে পারবে না। তখন ওই মাটিতেই আবার মিশে যেতে হবে। তাই সময় থাকতে অহঙ্কার, হিংসা, বিদ্যেষ ভুলে মানুষকে মানুষ ভাবো। মনে রাখবে মানুষ খোদা নয়, কিন্তু মানুষ-ই খোদা। অর্থাৎ মানুষকে কদর করলেই তার মাঝে তুমি তোমার প্রভু নিরঞ্জনকে খুঁজে পাবে। কথাগুলো বলতে বলতে অনেকটা হাপিয়ে উঠলেন মোশাররফ। চোখের দুকোনে জ্বল ছলছল করছে। বুঝতে না দিয়ে সেটা খুব দ্রুতই মুছে ফেলার চেষ্টা করলেন মোশাররফ।

রাজধানীতে রাস্তায় রাস্তায় গান করে সমাজকে কি বার্তা দিতে চান, এমন প্রশ্নের জবাবে মোশাররফ বলেন, আমার বয়স ৪৩ চলছে। বাবার সেই সাধনা আজও আমি করে যাচ্ছি। তবে গ্রামে নয়, রাজধানীর এ মনোমুগ্ধকর পরিবেশের হাতিরঝিলে। আমার বড় ছেলে সাব্বির এইচএসসি প্রথম বর্ষে পড়ে। ছেলেও তার দাদুর পথে হাটছে। ওর দাদুর হারমনিয়ামটা নিয়ে গান গায়। নবাবগঞ্জ কলেজের পাশে ললিতকলা একাডেমিতে ছেলে নিয়মিত গান চর্চা করে। এরইমধ্যে সে উপজেলা স্কুল পর্যায়ে গান প্রতিযোগীতার ২টি বিভাগে প্রথম হয়েছে। আর একটিতে দ্বিতীয় হয়েছে। আমি মনে করি আমার বাবা গান গেয়ে সাধনা করেছেন। কিন্তু সেভাবে পরিচিতি পাননি।

‘‘আমিও গান গেয়ে যাচ্ছি ছোট বেলা থেকে। প্রাণান্তকর চেষ্টা করে যাচ্ছি, মানুষের মাঝে এ গান তুলে ধরতে। হয়তো বা সেভাবে এখনও কোনো পরিচিতি পাই নি। কিন্তু আমার ছেলে অর্থাৎ পরবর্তী প্রজন্ম যেন এ গানেই প্রতিষ্ঠা পায়, আমি সেটাই চাই। আমার বাসনা বাউল গানে-ই সমাজের সব অসঙ্গতি উঠে আসুক। প্রতিবাদের ভাষা হোক বাউল সঙ্গীত। মাদক ছেড়ে তরুণদের পথচলার দিশা হোক বাউল সঙ্গীত।’’  

সংসারের খরচ কীভাবে আসে-জানতে চাইলে মোশাররফ বলেন, আমি ২০০২ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সময়ে দুবাই ছিলাম। এ সময় কিছু অর্থ উপার্জন করেছি। এছাড়া আমার স্ত্রী নাসরিন কোলাকোপা শিশুপার্ক কাউন্টারে চাকরি করেন। আর আমার বড় ভাই কাইয়ুম চৌধুরী। যিনি যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। উনি মাঝেমধ্যে কিছু টাকা পাঠান, যা দিয়ে দিন কেটে যায়।

মোশাররফ জানান, রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় একটি ভাড়া বাসায় থাকেন তিনি। গানের জন্য তার বাসায় আছে ২টি বায়না, ২টি হারমনিয়াম, ৩টি গিটার, ১ জোড়া খনজুরি, ১টি চোটি, ১টি দোতারা ও কয়েকটি আড়বাঁশিসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র। ‘বন্ধু বাউল’ নামে তার গানের দলের সদস্যরাই চাঁদা তুলে এ যন্ত্রগুলি কিনেছেন। তিনি জানান, তার গানের দলে রনি, সুমন, নাসিমা, খোকনসহ সব সদস্যই তরুণ। তরুণদের নিয়ে এ দল গঠন করার উদ্দেশ্য একটাই। আর তা হলো- তারুণ্য দিয়ে-ই তরুণ-তরুণীদের মনে বাউল গানের জায়গা করে নেওয়া। মাটি, মানুষ, সৃষ্টি আর স্রষ্টার কথা তুলে ধরা।

মোশাররফ জানান, দুটি টিভি চ্যানেল এরইমধ্যে তার গান প্রচার হয়েছে। এভাবে অন্য মাধ্যমগুলোও এগিয়ে এলে তরুণ প্রজন্মের কাছে বাউল গান তুলে ধরা সহজ হবে বলে তার বিশ্বাস। 

/ এআর /


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি