ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪

বিপর্যয় থেকে বিজয়

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৬:২০, ২২ মে ২০২০ | আপডেট: ১৬:২৩, ২২ মে ২০২০

পবিত্র কোরআন-এ আল্লাহ রব্বুল আলামীন সূরা আহজাব-এর ২১ নং আয়াতে বলেন, ‘(হে মানুষ!) নিশ্চয়ই তোমাদের জন্যে নবীজীবন সর্বোত্তম আদর্শ।’ নবীজীবন কোরআনের ফলিত রূপ। কোরআন বুঝতে হলে, কোরআনের গভীরে ডুব দিতে হলে নবীজীবনকে জানতে হবে। নবীজীবনকে যত গভীরভাবে অধ্যয়ন করা যায়, নবীপ্রেমে নিজের অন্তরকে যত প্লাবিত করা যায়, ততোই কোরআনের বাস্তব ও পরাবাস্তব জ্ঞানের ছটায় উপকৃত হওয়া যায়। কোরআনে ব্যক্ত ও সুপ্ত সব কথারই মর্মমূলে প্রবেশ করার ফলে; বিশ্বাসের স্তর থেকে উত্তরণ ঘটবে জানার স্তরে। 

প্রথম পর্বে আপনারা জেনেছেন নবী আগমনের পটভূমি। আইয়ামে জাহেলিয়াত। মক্কার বিবর্তন। কাবার নিয়ন্ত্রক বেনিয়া পুরোহিত চক্রের শোষণ ও ভোগবাদী সমাজে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের চরম বিপর্যয়ের বিবরণ। দ্বিতীয় পর্বে জেনেছেন শূন্য থেকে জীবন শুরু। অনিশ্চয়তার পর অনিশ্চয়তা। নিজ শ্রম ও মেধায় ৩৫ বছর বয়সে আসীন হলেন মক্কার সমাজে উচ্চ মর্যাদায়। তৃতীয় পর্বে আপনারা জেনেছেন জীবনের বাঁকবদল। জাহেলিয়াত থেকে উত্তরণের সূত্র লাভ। আল্লাহ এক, তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। সকল মানুষ সমান। শুরু করলেন সত্যের প্রচার। প্রথমে গোপনে। তারপর প্রকাশ্যে। চতুর্থ পর্বে আপনারা জেনেছেন নির্মম নির্যাতন ও উৎপীড়নের মুখে স্বল্পসংখ্যক সঙ্ঘবদ্ধ মানুষের বিশ্বাস ও অহিংসায় অটল থেকে আত্মিক তূরীয় আনন্দে অবগাহনের বিবরণ। 

পঞ্চম পর্বে জেনেছেন হিজরত- চরম অনিশ্চয়তার মুখে সোনালি সকালের পথে যাত্রার বিবরণ। ষষ্ঠ পর্বে জেনেছেন মদিনায় আগমনের পর সামাজিক রাজনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্যে ধাপে ধাপে তার ঘর গোছানোর কাহিনী। সপ্তম পর্বে জেনেছেন- সীমিত শক্তি ও উপকরণ নিয়ে বড় বিজয়ের উপাখ্যান। অষ্টম পর্বে জেনেছেন ঘর গোছানোর সাথে সাথে ধনীর সম্পদে দরিদ্রের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যাকাতের বিধানাবলির বিবরণ। নবম পর্বে জেনেছেন নিশ্চিত বিজয় বিপর্যয়ে রূপান্তরের উপাখ্যান। এবার দশম পর্বে আপনারা জানবেন বিপর্যয় থেকে বিজয়ে উত্তরণের কাহিনী।

দ্বিতীয় খলিফা ওমরের শাসনামলে বাইজেন্টাইন আধিপত্য থেকে পুরো সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের মুক্তির জন্যে নিবেদিত বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন তিনি। তার নেতৃত্বেই ডানে ফোরাত নদী ও বামে এশিয়া মাইনর পর্যন্ত পুরো সিরিয়া শোষণের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়। ওমর সিরিয়া সফরের সময় মুসলিম অফিসারদের শরীরে জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক দেখে অত্যন্ত ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, তোমরা এত তাড়াতাড়ি অনারবদের পোশাকে অভ্যস্ত হয়ে গেলে! আবু ওবায়দা যখন তার কাছে এলেন, তখন তার শরীরে ছিল সাদামাটা আরবীয় পোশাক।

খলিফা তার বাড়িতে গেলেন। সেখানে দেখলেন আরো সাধারণ অবস্থা। একটা তরবারি, একটা ঢাল আর উটের হাওদা ছাড়া কিছুই নেই। ওমর তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কিছু আসবাবপত্র জোগাড় করে নিলে না কেন? ওবায়দা বিনয়ের সাথে জবাব দিলেন, ‘আমার শেষ বিশ্রামস্থল পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার জন্যে এগুলোই যথেষ্ট।’ একটি ব্যতিক্রম ছাড়া আবু ওবায়দা কখনো কোনো নির্দেশ অমান্য করেন নি।

তিনি তখন সমগ্র সিরিয়ায় অবস্থানরত মুসলিম বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। এমন সময় সিরিয়ায় প্লেগ মহামারিরূপে বিস্তার লাভ করে। প্লেগে বহু মানুষ মারা যায়। মুসলিম সৈন্যদের মাঝেও প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে। এ খবর মদিনায় পৌঁছলে ওমর আবু ওবায়দাকে নির্দেশ পাঠালেন, ‘এই চিঠি পাওয়ামাত্র তুমি মদিনার পথে রওনা করো।’ কারণ ওমর চাচ্ছিলেন, আবু ওবায়দাকে তিনি পরবর্তী খলিফা হিসেবে মনোনয়ন দেবেন। আবু ওবায়দা পত্র পেয়ে বললেন, ‘আমি জানি আমিরুল মোমেনিন কেন আমাকে যেতে বলছেন। তিনি এমন একজনের বেঁচে থাকাকে নিশ্চিত করতে চান, যে চিরঞ্জীব নয়।’

তিনি খলিফাকে লিখলেন, ‘আমি জানি আমাকে আপনার প্রয়োজন। কিন্তু আমি মুসলিম বাহিনীর সাথে রয়েছি এবং সেখানে প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। তাদেরকে বিপন্ন রেখে নিজেকে বাঁচানোর কোনো অভিপ্রায় আমার নেই। আমি তাদের থেকে আলাদা হতে চাই না। তাই আমার চিঠি পাওয়ার পর আপনার আদেশ পালন থেকে অব্যাহতি দিয়ে আমাকে সৈন্যদের সাথে থাকার অনুমতি দিন।’

এই চিঠি পেয়ে ওমরের চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। এর কিছুদিন পর প্লেগে আক্রান্ত হয়ে আবু ওবায়দা মারা যান। আবু ওবায়দার স্থান ত্যাগ না করার আর একটি বড় কারণ ছিল নবীজীর নির্দেশনা। নবীজী বলেছেন, যখন কোনো স্থানে মহামারি আক্রমণ করে তখন সেখানে কেউ প্রবেশ করবে না। আর সেখানে যারা থাকবে তারা সে স্থান ত্যাগ করে বাইরেও আসবে না। সংক্রামক ব্যাধির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার আধুনিক কোয়ারেন্টাইন পদ্ধতি নবীজীর এই নির্দেশনারই অনুরূপ।

মৃত্যুশয্যায় আবু ওবায়দা তার সৈনিকদের শেষ উপদেশ দেন, ‘তোমরা নামাজ কায়েম করবে, রমজান মাসে রোজা রাখবে, দান করবে। ঐক্যবদ্ধ থাকবে। পরস্পরকে সহযোগিতা করবে। আন্তরিকভাবে কমান্ডারের নির্দেশ পালন করবে। কমান্ডারের কাছ থেকে কোনোকিছু গোপন করবে না। পার্থিব আকাঙ্ক্ষা যেন তোমাদের বিনাশ না করে। মনে রেখ, এমনকি তুমি যদি হাজার বছরও বেঁচে থাকো, আমার দিকে তাকাও, তোমার নিয়তিও হবে এই একই। আল্লাহর করুণা তোমাদের ওপর বর্ষিত হোক।’ এরপর তিনি মুয়াদ ইবনে জাবলের দিকে তাকালেন। বললেন, ‘মুয়াদ তুমি নামাজে এদের ইমামতি করো (তাদের নেতৃত্ব দাও)।’ এ কথার সাথে সাথে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

যাইহোক, আবু ওবায়দা নবীজীর শিরস্ত্রাণের বেড়ি খুলে ফেলতে সক্ষম হলেন। তখন আলীর ঢালে করে আনা পানি দিয়ে মা ফাতেমা নবীজীর মুখমণ্ডলের ক্ষতস্থান পরিষ্কার করায় রক্তের ধারা বইতে শুরু করল। মা ফাতেমা খেজুর পাতার চাটাই পুড়িয়ে সেই ছাই দিয়ে ক্ষতস্থান চেপে ধরলেন। ক্ষতস্থান থেকে রক্ত বেরোনো বন্ধ হলো। পাহাড়ের ঢালে নবীজীকে ঘিরে সবাই ধীরে ধীরে জড়ো হতে থাকল। নতুন করে প্রতিরোধ গড়ে তুলল। আর ওদিকে কোরাইশরা ময়দানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নিহত মুসলমানদের লাশ বিকৃত করতে শুরু করল।

আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দার নেতৃত্বে ১৬ জন মহিলার একটি দল এই জঘন্য কাজে অংশ নিল। তারা ৬৯ জন শহিদের লাশ বিকৃত করে কান, নাক কেটে নিয়ে তা দিয়ে অলঙ্কার বানিয়ে হাতে গলায় পরিধান করল। একমাত্র হানজালা ইবনে আবি আমিরের লাশই অবিকৃত ছিল। অবশ্য প্রতিহিংসা বর্বরতায় সবাইকে ছাড়িয়ে গেল আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা। হামজার ব্যাপারে হিন্দার প্রতিহিংসা ছিল একেবারেই ব্যক্তিগত পর্যায়ে। বদরে হামজার হাতে তার বাবা নিহত হওয়ার পরই সে প্রতিশোধের শপথ নিয়েছিল। হাবশি ক্রীতদাস ওয়াহেশীকে মুক্তি দেয়ার শর্তে হামজাকে হত্যা করার দায়িত্ব দিয়েছিল।

ওহুদের রণক্ষেত্রে ওয়াহেশীর উপস্থিতি ছিল শুধু এজন্যেই। সে হিন্দাকে নিয়ে এলো হামজার লাশের কাছে। হিন্দা ছুরি দিয়ে পেট চিরে হামজার কলিজা বের করে মুখের সামনে এনে কামড়ে চিবানোর চেষ্টা করল। হিন্দা হামজার নাক ও কান কেটে মালা বানিয়ে নিজের গলায় ধারণ করল। এদিকে মুহাম্মদকে হত্যা করতে পেরেছে এই আনন্দ নিয়ে কোরাইশরা শিবির গোটানোর কাজ শুরু করল। আবু সুফিয়ান ও খালেদ ইবনে ওয়ালিদ ঘোড়ায় চড়ে শেষবারের মতো ময়দান পরিদর্শনে এলেন। উদ্দেশ্য মুহাম্মদের লাশের সন্ধান করা। কিন্তু কোনো লাশের মাঝেই তাকে না পেয়ে তাদের মন সংশয়াচ্ছন্ন হয়ে পড়ল।

পাহাড়ের ঢালে যেখানে মুসলমানরা নিরাপদ অবস্থান নিয়েছিল, সেখানে এসে ওমরের কথা শুনে তারা নিশ্চিত হলো যে মুহাম্মদ জীবিত আছেন। তখন আবু সুফিয়ান ঘোষণা দিলো, আগামী বছর আবার বদরে দেখা হবে। নবীজীর (স) নির্দেশে ওমর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে বললেন, আমরা অবশ্যই আসব। কোরাইশরা ময়দান ত্যাগ করার পর নবীজী সহযোদ্ধাদের নিয়ে রণাঙ্গনে এলেন। ৭০ জন শহিদের প্রত্যেকের লাশের সামনে দাঁড়িয়ে আলাদাভাবে দোয়া করলেন। রণাঙ্গনে যিনি যেখানে শহিদ হয়েছিলেন, সেখানেই একই কবরে দুজন/তিন জন করে তাদের দাফনের ব্যবস্থা করলেন।

মুসআব ইবনে উমায়েরের লাশ কবরে নামানোর পর নবীজী তেলাওয়াত করলেন: ‘বিশ্বাসীদের মধ্যে অনেকেই আল্লাহর সাথে তাদের অঙ্গীকার পূরণ করেছে। তাদের কেউ শহিদ হয়েছে, কেউ (অঙ্গীকার পূরণের) সময় আসার অপেক্ষায় রয়েছে। তারা তাদের অঙ্গীকারে অটল।’ (সূরা আহজাব: ২৩)। আহত যে কয়জনকে পেলেন তাদের চিকিৎসা ও সেবাযত্নের ব্যবস্থা করা হলো। ওহুদের যুদ্ধে মুসলিম পক্ষে শহিদ হন ৭০ জন। এর মধ্যে ৬৫ জনই মদিনার আনসার। ৪১ জন খাজরাজ গোত্রের। ২৪ জন আউস গোত্রের। চার জন মোহাজির। একজন ইহুদি। কোরাইশ পক্ষে নিহতের সংখ্যা ২২। 

ওহুদ প্রান্তরের সবার মনোজাগতিক অবস্থা সম্পর্কে কোরআনে পরিষ্কারভাবে বলা হয়: ‘আল্লাহ তাঁর ওয়াদা পূরণ করেছেন। প্রথমে তাঁর হুকুমেই (ওহুদে) তোমরা ওদের প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছিলে। কিন্তু এরপরই তোমাদের দৃষ্টি গেল গনিমতের মালের দিকে, যা ছিল তোমাদের অনেকের কাঙ্ক্ষিত বস্তু। এ কারণে তোমাদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হলো। তোমরা নেতার (নির্দেশ লঙ্ঘন করে) অবাধ্য হলে। আসলে তোমাদের কিছু সংখ্যক পার্থিব লোভে পড়েছিলে আর কিছু সংখ্যক চাচ্ছিলে পরকাল। তখনই সত্য অস্বীকারকারীরা তোমাদের পর্যুদস্ত করল। এটি ছিল আল্লাহর তরফ থেকে তোমাদের জন্যে পরীক্ষা। অবশ্য এরপরও তিনি তোমাদের ক্ষমা করলেন। বিশ্বাসীদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ সীমাহীন। ‘স্মরণ করো! (ওহুদের প্রান্তরে) পেছনে কারো দিকে কোনো খেয়াল না করেই তোমরা পাহাড়ের দিকে কেমন করে পালাচ্ছিলে। অথচ রসুল তোমাদের পেছন থেকে ডাকছিল। (ফিরে আসো! শত্রুর মোকাবেলা করো। কিন্তু তোমরা সে ডাকে সাড়া দাও নি)। এর প্রেক্ষিতে আল্লাহ তোমাদেরকে (লজ্জাস্কর) দুঃখের পর দুঃখ দিলেন। (এই লজ্জাজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হলো, যাতে গনিমতের মাল) হারানোর বেদনা ও বিপদ যেন কখনোই তোমাদের মর্মাহত না করে। তোমরা যা করো আল্লাহ তা ভালোভাবেই জানেন।’ 

‘দুঃখ ও বিপর্যয়ের পর তিনি তোমাদের নিরাপত্তা ও প্রশান্তি দিলেন। একদল তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে গেল। আরেক দল মূর্খদের মতো আল্লাহ সম্পর্কে অবান্তর ধারণা করে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় নিমজ্জিত হচ্ছিল। ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলছিল, আমাদের কি কিছু বলার অধিকার আছে?’ (হে নবী! ওদের) বলো, ‘সবকিছুই আল্লাহর এখতিয়ারে! আসলে এদের অন্তরের গোপন কথাটি হচ্ছে, তারা বলতে চায়, এ ব্যাপারে আমাদের সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার থাকলে আমরা এখানে মারা পড়তাম না।’ (হে নবী!) বলো, ‘যদি তোমরা ঘরেও থাকতে তবুও মৃত্যু নির্ধারিত হয়ে থাকলে, তোমরা তোমাদের মৃত্যুস্থানে নিজে নিজেই পৌঁছে যেতে।’ আর আল্লাহ এভাবে তোমাদের মনে যা আছে তা পরীক্ষা করেন এবং অন্তরকে পরিশুদ্ধ করেন। আসলে তোমাদের মনের খবর আল্লাহ ভালোভাবেই জানেন।’ ‘মোকাবেলার দিন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে যারা পালিয়ে গিয়েছিল, তাদের পালানোর কারণ হচ্ছে শয়তান দুর্বল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে তাদের পদস্খলন ঘটিয়েছিল। অবশ্য আল্লাহ তাদেরও ক্ষমা করেছেন। তিনি অতিশয় ক্ষমাপরায়ণ, পরমসহনশীল।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৫২-১৫৫)

এদিকে কোরাইশরা রণাঙ্গন ছেড়ে গেলেও নবীজী নিশ্চিত হতে পারছিলেন না তাদের অভিপ্রায় সম্পর্কে। এই বিপর্যস্ত অবস্থায় এরা যদি এখন মদিনার দিকে যায় তবে মদিনাকে রক্ষা করা কঠিন হবে। তিনি আলীকে পাঠালেন এদের খোঁজ নেয়ার জন্যে। বললেন, দেখ, যদি এরা ঘোড়ায় চড়ে উট সাথে নিয়ে যায়, তাহলে বুঝবে এদের লক্ষ্য হচ্ছে মদিনা। আর যদি এরা উটে চড়ে ঘোড়া সাথে নিয়ে যেতে থাকে, তাহলে বুঝবে এদের লক্ষ্য মক্কা। আলী পাঁচ মাইল পর্যন্ত এদের পেছনে পেছনে অনুসরণ করে এসে জানালেন, এরা মক্কার পথেই যাচ্ছে। এরপর নবীজী সবাইকে নিয়ে মদিনায় ফিরে এলেন।

নবীজী যখন মদিনায় ফিরে এলেন তখন স্বাভাবিকভাবেই মদিনায় কোনো উল্লাস ছিল না-ছিল বেদনার্ত ক্রন্দন। কিন্তু রসুলের প্রতি ভালবাসায় বিশ্বাসী নারীদের অন্তর ছিল প্লাবিত। বনু দিনার গোত্রের সুমাইরা বিনতে কায়েস খবর পেলেন তার পিতা, ভাই ও স্বামী যুদ্ধে শহিদ হয়েছেন। এটা শোনার পর তার প্রথম প্রশ্ন ছিল, আল্লাহর রসুল কেমন আছেন? তাকে বলা হলো, তিনি ভালো আছেন। মহিলা বললেন, আমি তাঁকে দেখতে চাই। দেখার সুযোগ করে দেয়ার পর মহিলা বললেন, হে আল্লাহর রসুল! আপনি যেহেতু বেঁচে আছেন, আমার জন্যে কোনো দুর্ভাগ্যই দুর্ভাগ্য নয়। 

সন্তানহারা, স্বামীহারা, পিতাহারা অধিকাংশ নারীর মুখে ছিল এই একই কথা। তারা সান্ত্বনা খুঁজে পেলেন তৎক্ষণাৎ নাজিলকৃত আয়াতে: ‘হে বিশ্বাসীগণ! (সাহস) ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে তোমরা সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথেই থাকেন। (হে বিশ্বাসীগণ!) যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়, তাদের মৃত বোলো না। প্রকৃতপক্ষে তারা জীবিত, কিন্তু তোমরা তা বোঝো না।’ ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদের অনেককে ভয়, ক্ষুধা, জানমাল ও শ্রমের ফল বিনষ্ট করে অর্থাৎ বিপদ-আপদ দিয়ে পরীক্ষা করব। তবে এ বিপদের মধ্যে যারা ধৈর্যধারণ করে তাদের সুসংবাদ দাও। ধৈর্যশীলরা বিপদে পড়লে বলে, ‘ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন’, আমরা আল্লাহর। তাঁর কাছ থেকে এসেছি। তাঁর কাছেই ফিরে যাব। এদের ওপর তাদের প্রতিপালকের বিশেষ অনুগ্রহ ও রহমত বর্ষিত হয়। বস্তুত এরাই সৎপথে পরিচালিত।’ (সূরা বাকারা : ১৫৩-১৫৭)

ওহুদ যুদ্ধের পারিপার্শ্বিক প্রভাব কী হতে পারে তা বুঝতে নবীজীর সময় লাগার কোনো কারণ ছিল না। তিনি স্পষ্টই বুঝলেন, বদর যুদ্ধের বিজয় যে প্রভাব বলয় সৃষ্টি করেছিল, তার পুরো বিপরীত ঘটনা ঘটতে পারে এখন। মুসলমানরা তখনো মদিনায় সংখ্যালঘু। মদিনার ইহুদি, পৌত্তলিক ও মুনাফেকরা যদি কোনোভাবে কোরাইশদের সাথে মিলিত হয় বা কোনোভাবে যদি এখন কোরাইশরা মদিনায় আক্রমণ করতে চলে আসে, তবে তা মুসলমানদের পুরো অস্তিত্বই বিপন্ন করে তুলবে। নবীজী আত্মরক্ষায় দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিলেন। পরদিন সকালে ঘোষকরা মদিনার পথে পথে ঘোষণা দিতে লাগল- নবীজী যুদ্ধযাত্রা করবেন। যারা ওহুদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে, শুধু তারাই এই যুদ্ধে অংশ নিতে পারবেন।

সুস্থরা শুধু নয়, গুরুতর আহতরাও চলে এলেন। গুরুতর আহত নুসাইবাও অন্যের কাঁধে ভর দিয়ে যুদ্ধের জন্যে হাজির হলেন। কোরআনে শত্রুর পশ্চাদ্ধাবনকে উৎসাহিত করে বলা হয়: ‘শত্রুর সন্ধানে বা তাদের পশ্চাদ্ধাবনে কখনো শিথিলতা বা দুর্বলতা প্রদর্শন কোরো না। মনে রেখো, এটা তোমাদের জন্যে কষ্টকর হলে ওদের জন্যেও কষ্টকর। আর পার্থক্য এই, তোমরা এ কষ্টের বিনিময়ে আল্লাহর কাছ থেকে যা প্রত্যাশা করতে পারো, ওরা তা পারে না। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা নিসা : ১০৪)

মসজিদে সবাইকে নিয়ে নামাজ পড়ে পুরো যুদ্ধসাজে সজ্জিত হয়ে আহত নবীজী ঘোড়ায় উঠলেন। মদিনা থেকে মক্কার পথে ১৪ কিলোমিটার দূরে হামরা আল আসাদ নামক স্থানে শিবির স্থাপন করলেন। সেখানে তিন দিন অবস্থান করলেন। দিনের বেলা প্রচুর কাঠ সংগ্রহ করে রাতে যত বেশি সংখ্যক সম্ভব আগুন জ্বালানোর নির্দেশ দিলেন। যাতে রাতে দূর মরুভূমি থেকেও আগুন দেখা যায়। মুসলমানদের সৈন্যসংখ্যা যেন বাস্তবের চেয়েও অনেক বেশি মনে হয়। 

যুদ্ধ শুধু অস্ত্রেরই নয়, যুদ্ধ আসলে হচ্ছে কৌশল ও মনস্তত্ত্বের সমন্বিত লড়াই। প্রতিপক্ষকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দিতে পারলে লক্ষ্য অর্জন সহজ হয়। রাসুলুল্লাহ (স) এ ব্যাপারে সবসময়ই ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তাঁর পুরো রণনীতির লক্ষ্যই ছিল রক্তপাতহীন মনস্তাত্ত্বিক বিজয়। নবীজী ঠিকই ধারণা করেছিলেন যে, কোরাইশরা যুদ্ধে তাদের লক্ষ্য অর্জনের ব্যর্থতা অনুধাবন করতে পেরে পুনরায় মদিনা আক্রমণের জন্যে ফিরে আসতে পারে।

হামরা আল আসাদ-এ শিবির স্থাপনের পর পরই সেখানে বন্ধুভাবাপন্ন খুজাহ গোত্রের নেতা মাবাদ ইবনে আবু মাবাদ তাঁর সাথে দেখা করলেন। নবীজী তাকে বললেন, তুমি আবু সুফিয়ানের শিবিরে যাও। তারা যাতে পুনঃ আক্রমণ করতে না আসে সেজন্যে তাদেরকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে দুর্বল করে দাও। মাবাদ রওনা হলেন। মদিনা থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে আল রাওয়া নামক স্থানে কোরাইশ শিবিরে যখন পৌঁছলেন, তখন সেখানে মুসলমানদের পুরোপুরি ধ্বংস না করে চলে আসাটা যে বোকামি হয়েছে, এজন্যে নিজেদেরকে দোষারোপ করছে সবাই। অধিকাংশই চাচ্ছে পুনরায় মদিনায় অভিযান চালাতে। 

আবু সুফিয়ান ও অন্যান্যরা মাবাদকে পেয়ে কাছে বসালেন। জানতে চাইলেন মুসলমানদের খবর। মাবাদ ভীতিপ্রদ বিবরণ দিলেন যে, ‘মুহাম্মদ মদিনায় তাঁর সকল সৈন্য জড়ো করে মক্কার দিকে ধেয়ে আসছে।  এত বিশাল বাহিনী এর আগে আমি কখনো দেখি নি। প্রত্যেকের চোখে মুখে প্রতিহিংসার আগুন। মনে হচ্ছে সামনে পেলে এবার তোমাদের কলিজা চিবিয়ে খাবে। আমি তো আসার পথে হামরা আল আসাদে তাদের দেখে এসেছি। না জানি এতক্ষণে কতটা আরো কাছে এসে পড়েছে।’

ধূর্ত আবু সুফিয়ান নবীজীর প্রস্তুতি ও অভিযাত্রার খবর শুনে পাল্টা আক্রমণের চিন্তা বাদ দিয়ে শিবির গুটিয়ে মক্কার পথে ফিরে চললেন। নবীজী হামরা আল আসাদে তিন দিন পর্যন্ত অবস্থান করে আপাত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মদিনায় ফিরে এলেন। ওহুদের ক্ষয়ক্ষতি যে বিশ্বাসীরা দ্রুত কাটিয়ে উঠবে কোরআনে তাও বলা হলো সুস্পষ্ট ভাষায়: ‘তোমাদের আগেও বহু ধরনের জীবনধারা বিদ্যমান ছিল। সুতরাং তোমরা সারা পৃথিবী ভ্রমণ করো এবং দেখ সত্য অস্বীকারকারীদের পরিণতি কত মর্মান্তিক! বস্তুত এর মধ্যে রয়েছে মানবজাতির জন্যে সুস্পষ্ট শিক্ষা আর আল্লাহ-সচেতনদের জন্যে হেদায়েত ও উপদেশ।’ ‘আর কখনো হতাশ হয়ো না, দুঃখ কোরো না, সত্যিকার বিশ্বাসী হলে তোমাদের উত্থান সুনিশ্চিত (তোমরাই বিজয়ী হবে)। এখন যদি তোমাদের ওপর কোনো আঘাত এসে থাকে, তবে অনুরূপ আঘাত তো বিরুদ্ধপক্ষের ওপরও এসেছিল। আসলে আমিই পর্যায়ক্রমে (সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যের) এ দিনগুলোকে মুখোমুখি করি, যাতে দেখতে পারি কারা সত্যিকারের বিশ্বাসী, কারা জীবন দিয়েও সত্যের সাক্ষী হতে পারে। নিশ্চয়ই আল্লাহ জালেমদের অপছন্দ করেন। বস্তুত পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি বিশ্বাসীদের শোধরান এবং সত্য অস্বীকারকারীদের নিশ্চিহ্ন করেন।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৩৭-১৪১)

ওহুদের যুদ্ধ মুসলমানদের পরাজয়, না বিজয়রূপে গণ্য হবে-এ নিয়ে প্রচুর আলোচনা ইতিহাসবিদরা করেছেন। কিন্তু বাস্তব ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে এ থেকেই অনেকগুলো সত্য বেরিয়ে আসে। 

এক. যুদ্ধের শুরুটা প্রমাণ করে, লক্ষ্যে উদ্বুদ্ধ সাহসী সঙ্ঘবদ্ধ শক্তির মোকাবেলায় চার গুণ শক্তিশালী শত্রুপক্ষকেও নাস্তানাবুদ করে দেয়া যায়। প্রথম দফা আক্রমণে মুসলমানরা সফল হয়।

দুই. নেতার নির্দেশনা লঙ্ঘন করায় যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়ে মুসলমানরা নাস্তানাবুদ হয়। বিপুল প্রাণহানি ঘটে। নবীজী আহত হন। কিন্তু এটি কোরাইশদের বিজয়রূপে চিহ্নিত করা যায় না। কারণ তাদের মূল লক্ষ্য মুহাম্মদকে হত্যা বা মদিনার মুসলমানদের বিনাশ-কোনোটাই অর্জিত হয় নি।

তিন. কোরাইশ বাহিনী মুসলমানদের শিবির দখল করতে ব্যর্থ হয়। ব্যাপক বিশৃঙ্খলা ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও মুসলমানরা রণক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যায় নি। বরং তারা পাহাড়ের ঢালে পুনরায় সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে সাহসিকতার সাথে কোরাইশদের মোকাবেলা করে। ফলে কোরাইশরা কোনো মুসলমানকে বন্দি করতে ও শিবির লুট করতে ব্যর্থ হয়।

চার. যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় সফল হলেও কোরাইশরা খুব তাড়াহুড়ো করে মুসলমানদের আগেই রণাঙ্গন ছেড়ে চলে যায়। রাজধানী মদিনা অরক্ষিত থাকলেও তা দখল বা লুট করার জন্যে কোনো অভিযান চালাতে সাহসী হয় নি। আসলে রণাঙ্গন ত্যাগ করে ৮০ কিলোমিটার দূরে শিবির স্থাপন করার আগ পর্যন্ত যুদ্ধের লক্ষ্য যে অর্জন করতে পারে নি, এ সত্যও কোরাইশরা বুঝতে পারে নি। বরং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও আহত নবীজী তাঁর বাহিনীকে পুনরায় সঙ্ঘবদ্ধ করে কোরাইশ বাহিনীকে ধাওয়া করেন। তিনি কৌশল অবলম্বন ও তথ্য বিভ্রান্তির মাধ্যমে কোরাইশ বাহিনীকে দ্রুত মক্কায় ফেরত গিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে বাধ্য করেন। তাই নিঃসংশয়ে বলা যায়, ওহুদের সংঘর্ষ সেনানায়ক হিসেবে মুহাম্মদের (স) অসাধারণ সাহসিকতা ও দূরদর্শিতার উদাহরণ হয়েই ইতিহাসে প্রোজ্জ্বল থাকবে।

এনএস/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি