ঢাকা, মঙ্গলবার   ১৯ মার্চ ২০২৪

রোগীর সেবায় রাসুলুল্লাহ ( সাঃ) এর উপদেশ

ছৈয়দ আহমদ তানশীর উদ্দীন

প্রকাশিত : ০৮:৪৩, ৩০ অক্টোবর ২০২০

আজ ১২ রবিউল আউয়াল। পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ)। বিশ্বব্যাপী বিশেষ দিনটি পালিত হয় খুবই ভাবগাম্ভীর্যের সাথে যা মুসলমানদের জন্য অনন্য একটি দিন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে অনেক গুলো বার্তা দিয়েছেন যেমন মহামারী আক্রান্ত এলাকায় প্রবেশ বা বাহির হতে নিষেধ করেছেন। হাতের স্বাস্থ্যবিধি গুরুত্বারোপ করেছেন। এছাড়া আরো অনেক কিছু।

রোগীর দেখভাল করা, সেবা ও সান্ত্বনা দেওয়া ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে ইবাদত এবং মহানবী (সা.)-এর একটি মর্যাদাপূর্ণ সুন্নত। কোনো কোনো ইসলামী আইনজ্ঞ একে ওয়াজিবও বলেছেন। রোগীর সেবা প্রদানের মাধ্যমে সেবাকারীর ঈমান ও সমাজের সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায়। সামগ্রিক প্রচেষ্টা ও সচেতনতার মাধ্যমে বড় ধরনের বিপর্যয় রোধ করা যায়।

সেবা রোগীর অধিকার সেবা পাওয়া অসুস্থ ব্যক্তির অধিকার। সামর্থ্য ও সুযোগ থাকার পরও রোগীর প্রতি যদি অবহেলা করা হয়, তবে কিয়ামতের দিন আল্লাহর দরবারে জবাবদিহি করতে হবে। 
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘এক মুসলমানের ওপর অপর মুসলমানের ছয়টি অধিকার...‘যখন যে অসুস্থ হবে তার সেবা করো।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২১৬২)

অন্য হাদিসে মহানবী (সা.) বলেন, ‘মুসলমানের ওপর অপর মুসলমানের জন্য পাঁচটি অবশ্যকরণীয় রয়েছে...‘রোগীর খোঁজ-খবর নেওয়া।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৫০৩০)

মহানবী (সা.) রোগীর সেবা-শুশ্রূষা করার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে আহার করাও, রোগীর শুশ্রূষা করো এবং বন্দিদের মুক্ত করো।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৩৭৩)

পরকালীন জবাবদিহির বিষয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কিয়ামতের দিন আল্লাহ বলবেন, ‘হে আদম সন্তান, আমি অসুস্থ ছিলাম তুমি আমার সেবা করোনি। সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক, আমি আপনার সেবা কিভাবে করব! আপনি তো জগত্গুলোর প্রতিপালক। আল্লাহ বলবেন, তুমি কি জানতে না আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল? তুমি তার সেবা করোনি। তুমি কি জানতে না তুমি যদি তার সেবা করতে, তবে তুমি তার কাছে আমাকে পেতে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৫৬৯)

একবার দেখে আসা যথেষ্ট নয় ‘রোগীর সেবা’ বিষয়ে হাদিসে ‘ইআদত’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যার অর্থ বারবার ফিরে আসা। শায়খ ইবনে উসাইমিন বলেন, ‘হাদিসে জিয়ারাত (সাক্ষাৎ) শব্দ ব্যবহার করা হয়নি। কেননা, তা সুস্থ ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। রোগীর ক্ষেত্রে ‘ইআদাত’ আনা হয়েছে—যার অর্থ বারবার ফিরে আসা। কেননা, ‘রোগ কখনো দীর্ঘ হয় এবং ধারাবাহিক সেবার প্রয়োজন হয়।’ (আশ-শারহুল মুমাত্তা : ৫/২৩৬)

রোগীর সেবা করার বিধান বেশির ভাগ ইসলামী আইনজ্ঞের মতে, সাধারণভাবে রোগীর সেবা করা মুস্তাহাব পর্যায়ের সুন্নত। তবে কোনো কোনো ব্যক্তির জন্য তা ওয়াজিবের স্তরে চলে যায় (যখন তার ওপর রোগীর নির্ভরতা বেড়ে যায় এবং অনন্যোপায় হয়)। ইমাম বুখারি (রহ.)সহ হাম্বলি মাজহাবের কোনো কোনো ফকিহ রোগীর সেবা প্রদানকে ওয়াজিব বলেন। ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, রোগীর সেবা প্রদান ‘ওয়াজিবে কিফায়া’ (সামষ্টিক অবশ্যকরণীয়)। অর্থাৎ যখন ব্যক্তির ভরণ-পোষণের মতো এবং উপযুক্ত চিকিৎসা নিশ্চিত করার মতো কেউ থাকবে না, তখন সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর তার প্রয়োজনীয় সেবা নিশ্চিত করা আবশ্যক। এমন গুরুতর অবস্থায় সমাজ ও রাষ্ট্রের অবহেলায় কোনো রোগী কষ্ট পেলে, ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা মারা গেলে তার দায় সমাজ ও রাষ্ট্রের সবার ওপর বর্তাবে। (বিস্তারিত দেখুন : আল মাউসুআতুল ফিকহিয়্যা কুয়েতিয়্যা : ৩৫/৯ ও ৩৬/৩৭১)

রোগীর সেবা করার সাত পুরস্কার রোগীর সেবা করার বহু পুরস্কার হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। তা থেকে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো—

এক. আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয় : জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন-যে রোগীর খোঁজখবর নিল সে আল্লাহর রহমতে ডুবে গেল আর সে যখন বসল তখন সে তার মধ্যে স্থির হয়ে গেল।’ (আল আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ৫২২)

দুই. জান্নাতের ছায়া লাভ : সাওবান (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যখন কোনো মুসলিম তার (অসুস্থ) মুসলিম ভাইয়ের সেবায় নিয়োজিত হয়, সে ফিরে আসা পর্যন্ত জান্নাতের ফল বাগানে (তার ছায়ায়) অবস্থান করতে থাকে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৫৬৮)

তিন. ফেরেশতা কর্তৃক কল্যাণের দোয়া : আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় কোনো অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যায় অথবা নিজের ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যায়-একজন ঘোষক (ফেরেশতা) তাকে ডেকে বলতে থাকে, ‘কল্যাণময় তোমার জীবন, কল্যাণময় তোমার এই পথ চলাও। তুমি তো জান্নাতের মধ্যে একটি বাসস্থান নির্দিষ্ট করে নিলে।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২০০৮)

চার. আল্লাহর রহমতে অবগাহন : জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে গেল, সে আল্লাহর রহমতে প্রবেশ করল-যতক্ষণ না সে বসে। যখন সে বসল তাতে সে ডুবে গেল।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১৪২৬০)

পাঁচ. জান্নাতে ফলের বাগান : আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোনো মুসলমান যদি অন্য কোনো মুসলিম রোগীকে সকালে দেখতে যায় তাহলে ৭০ হাজার ফেরেশতা তার জন্য সন্ধ্যা পর্যন্ত দোয়া করতে থাকে। সে যদি সন্ধ্যায় তাকে দেখতে যায় তবে ৭০ হাজার ফেরেশতা ভোর পর্যন্ত তার জন্য দোয়া করতে থাকে এবং জান্নাতে তার জন্য একটি ফলের বাগান তৈরি হয়।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৯৬৯)

ছয়. আল্লাহ কর্তৃক দায়িত্ব গ্রহণ : আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রোগীর দেখাশোনা করল, সে তার জামিন (দায়িত্ব গ্রহণকারী) হলো।’ (মুহাজ্জাবুস-সুনান ফি ইখতিসারিস-সুনানিল কাবির, হাদিস : ১৪৪২৫)

সাত. জান্নাতের সুসংবাদ : আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি দিনে পাঁচটি কাজ করবে, সে জান্নাতিদের অন্তর্ভুক্ত হবে : যে রোগীর শুশ্রূষা করে, জানাজায় অংশগ্রহণ করে, এক দিন রোজা রাখে, জুমার নামাজে অংশ নেয় এবং দাস আজাদ করে।’(সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস : ২৭৭১)

রোগী দেখার ইসলামী শিষ্টাচার মহানবী (সা.)-এর আমল ও নির্দেশনা থেকে অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া বা তাকে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার কিছু শিষ্টাচার প্রমাণিত হয়, যা শুভাকাঙ্ক্ষী, সাধারণ সেবক ও চিকিৎসক সবাই অনুসরণ করতে পারেন। যেমন—

১. রোগীর সুস্থতার জন্য দোয়া করা : রাসুলুল্লাহ (সা.) সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.)-কে দেখতে গিয়ে তিনবার দোয়া করেন, ‘হে আল্লাহ, আপনি সাদকে সুস্থ করে দিন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৬৫৯)

২. রোগীর অবস্থা জানতে চাওয়া : রাসুলুল্লাহ (সা.) কোনো রোগী দেখলে গেলে তিনি তার কাছে বসতেন এবং তার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইতেন। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) মৃত্যুশয্যায় শায়িত এক যুবককে দেখতে যান এবং বলেন, তোমার অবস্থা কেমন? ...’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৯৮৩)

৩. রোগীর কোনো প্রয়োজন বা প্রত্যাশা জানতে চাওয়া : রোগীর কোনো জিনিসের প্রয়োজন বা চাহিদা আছে কি না তা জানতে চাওয়া এবং রোগীর জন্য ক্ষতিকর না হলে তা পূরণ করা সুন্নত। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) এক ব্যক্তিকে দেখতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেন-তুমি কিছু চাও? তুমি ‘কাআক’ (খাবার জাতীয়) চাও? সে বলল, হ্যাঁ। তখন তারা রোগীর জন্য তা সংগ্রহ করল।’ (মুসনাদে আবি ইয়ালা, হাদিস : ৪০১৬)

৪. রোগীর কাছ থেকে দোয়া চাওয়া : ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে বলেন, ‘যখন তুমি কোনো রোগীর কাছে যাবে, তাকে বলবে তোমার জন্য দোয়া করতে। কেননা, তার দোয়া ফেরেশতাদের দোয়ার মতো।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৪৪১)

৫. দোয়া পাঠ করা : আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) রোগী দেখে সাতবার এই দোয়া পাঠ করতেন-(উচ্চারণ) ‘আসয়ালুল্লাহাল আজিমা রাব্বাল আরশিল আজিমি আই-ইয়াশফিয়াকা’ (অর্থ) আমি মহান আল্লাহর কাছে—যিনি মহা আরশের প্রতিপালক তোমার সুস্থতা কামনা করছি।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২০৮৩)

৬. আরো কয়েকটি বিষয় : ইসলামী আইনজ্ঞরা আরো বলেন, রোগীর সঙ্গে সাক্ষাৎ দীর্ঘ করা উচিত নয়, যাতে তার কষ্ট হয়; চিকিৎসক কর্তৃক নির্ধারিত নিয়ম ও সময়সূচি মান্য করে সাক্ষাৎ করতে যাওয়া, তাকে হতাশার পরিবর্তে আশান্বিত করা, রোগীর কষ্ট হয় এমন কথা ও কাজ পরিহার করা-এমনকি সুগন্ধি ব্যবহারে রোগীর কষ্ট হলেও তা পরিহারের নির্দেশ দেন তারা; এত বেশি দেখা-সাক্ষাৎ না করা, যাতে তার বিশ্রাম ও চিকিৎসা ব্যাহত হয়। (আল-মাউসুআতুল ফিকহিয়্যা কুয়েতিয়্যা : ৩১/৭৭-৭৯)

লেখক: নার্স ও পুষ্টিবিদ

এমবি//


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি