ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪

বোরো ধানে করোনার প্রভাব ও করণীয়

আনোয়ার ফারুক

প্রকাশিত : ২২:৩৬, ১৩ এপ্রিল ২০২০

করোনা সংকটে অর্থনীতির আর ক‘টা খাতের মতো দুশ্চিন্তা কৃষিখাত নিয়েও। চিন্তিত কৃষকরাও। বিশেষ করে ধানচাষী কৃষকরা। তাদের সংশয় ঠিক সময়ে বোরো ধান ঘরে তোলা নিয়ে। সারাদেশের বিভিন্ন জেলায় পাকতে শুরু করেছে বোরো ধান। এই সংকটটা বেশি সিলেট জেলার হাওরাঞ্চল নিয়ে। চৈত্রের মাঝামাঝি অর্থাৎ এপ্রিলের শুরুতেই হাওরাঞ্চলে ধান পাকা শুরু হয়। গ্রামে গ্রামে করা হয় নবান্নের আয়োজন। তবে এবারের চিত্রটা ব্যতিক্রম। বলতে গেলে সেই রকম আয়োজন নেই বললেই চলে। বরং, করোনার সংক্রমণ রোধে ঘরে থাকা কৃষকরা মাঠের সোনালি ধান দেখার পরও এক ধরণের অনিশ্চতায় দিন কাটাচ্ছেন। তাদের উৎকন্ঠা পাকা ধান ঠিকঠাক কেটে ঘরে তোলা নিয়ে। এই সংকট তীব্র হয়েছে শ্রমিক সংকটে। করোনা সংকটের কারণে অন্যান্য জেলা থেকে এবার শ্রমিকরা সময়মতো হাওড়াঞ্চলে আসতে পারেননি। এর ফলে ফসলের পরিচর্যা কিংবা ঘরে তোলা কিছুই সম্ভব হচ্ছে না। একদিকে ইদুরের উৎপাত, অন্যদিকে কালবৈশাখী ঝড়ে ফসলের ক্ষতির আশঙ্কা তাদের মনে। এমনকি সংকটকালীন সময় পরিবারের খরচ চালানোও তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এবারের বোরো মৌসুমে সারাদেশে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে প্রায় ৪১ লাখ ২৯ হাজার হেক্টর জমিতে। সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এই ধান চাষের পরিমাণ প্রায় ২৩ শতাংশ। যার পরিমাণ নয় লাখ ৩৬ হাজার হেক্টর। হাইব্রিড ধান কাটার মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। আর, পুরোদমে ধান কাটার সময় শুরু হবে বলা যেতে পারে এপ্রিলের মধ্য সময় থেকে। এ মৌসুমের চিত্র অন্য যেকোনো মৌসুমের থেকে ভিন্ন। এবার করোনার প্রভাবে শ্রমিক সংকট যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে আবহাওয়াজনিত সমস্যাও। মূলত শ্রমিক সংকট কৃষকদের ভোগাবে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিগত বছরগুলোর অভিজ্ঞতা বলছে, সাধারণত মধ্য এপ্রিল থেকে সিলেট অঞ্চলে বৃষ্টি শুরু হয়। অতিবৃষ্টির কারণে কোনো কোনো বছর দেখা দেয় আগাম বন্যা ও ঢল। এরই মধ্যে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, এপ্রিলের শেষের দিকে বড়ধরণের বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে। বাড়তি বৃষ্টি আবার আগাম বন্যারও কারন হতে পারে। এ কারণে প্রতিবছরই ধান পাকার সাথে সাথেই কেটে নেওয়ার ঝোঁক দেখা যায় কৃষকদের মধ্যে। তবে এবারের চিত্রটা ভিন্নরকম। 

হাওড়াঞ্চলের বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে আবাদ করা ধান কাটার জন্য অন্যান্য জেলা থেকে শ্রমিক নিয়ে আসতে হয়। ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, ফরিদপুর, মাদারীপুর, কুষ্টিয়া, শরীয়তপুর, রংপুর, দিনাজপুরসহ উত্তরাঞ্চল থেকে প্রচুর শ্রমিক আসেন হাওড়াঞ্চলে ধান কাটতে। এদের প্রতিদিনের মজুরির ভিত্তিতে পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। তারা নিজেরা কৃষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দলবেধে আসেন। আবার কখনো আসেন গ্রাম্য মাতব্বর বা ঠিকাদারের মাধ্যমেও। তবে এবার নভেল করোনাভাইরাসের শঙ্কায় ধান কাটতে আসতে পারছেন না তারা। উচ্চমজুরি দিয়েও কাঙ্খিত শ্রমিক মিলছে না। কৃষকরা অনেক জেলায় আগাম যোগাযোগ করে রেখেছিলেন। তবে, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা ও লকডাউন পরিস্থিতির কারণে তারা হাওড়াঞ্চলে যেতে পারেননি। কারণ, লকডাউন পরিস্থিতিতে জরুরি সেবার বাইরে সাধারণ যানবাহনের চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমন অবস্থায় কৃষকরা বলতে গেলে দিশেহারা অবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। 

পাহাড়ী ঢল বা অতিবৃষ্টিতে যেনো কৃষকদের ধান নষ্ট না হয়ে যায়, তার জন্য বেশ তৎপরতা দেখিয়েছে। সেটি প্রশংসার দাবি রাখে নিঃসন্দেহে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে দেখলাম, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে হাওড়াঞ্চলে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ শুরু হবে। যদিও ধান কাটতে প্রচুর শ্রমিকের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় যন্ত্রের দরকার। কিন্তু বর্তমানে হাওড়াঞ্চলে ৩৬২টি কম্বাইন হারভেস্টর ও এক হাজার ৫৬টি রিপার সচল রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে পুরনো মেরামতযোগ্য ২২০টি কম্বাইন হারভেস্টর ও ৪৮৭টি রিপার মেশিন। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। তার ওপর রয়েছে শ্রমিক সংকট। এ অবস্থায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে ফসল রক্ষায় নতুন আরেকটি উদ্যোগের কথাও জানতে পেরেছি। বিভিন্ন জেলা থেকে বাসে করে অন্তত ৫০০ ধানকাটা শ্রমিক হাওড়াঞ্চলে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্তমান করোনা সংকটের কারণে সতর্কতার সাথেই তাদের আনা হবে। সামাজিক দূরত্ব মেনেই বাস, ট্রাকসহ বিভিন্ন পরিবহনে তাদের নিয়ে আসা হবে। বলা হচ্ছে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই ধান কেটে ঘরে আনা হবে। আর, তাদের রাখা হবে আলাদা তাবু তৈরি করে বা হাওর এলাকার স্কুল-কলেজগুলোতে। 

তবে কথা এখানেই শেষ নয়। গত রবিবার পর্যন্ত সারাদেশে করোনা শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা দাঁড়ালো মোট ৬২১ জনে। আর করোনায় মোট প্রাণহানি হলো ৩৪ জনের। এ ছাড়া রাজধানীর বেশ কিছু স্থানসহ দেশের কয়েকটি জেলা ও মহানগর সম্পূর্ণ লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। এমন অবস্থায় বাস, ট্রাক বা অন্য যানবাহনে করে বিভিন্ন জেলা থেকে হাওড়াঞ্চলে ধানকাটা শ্রমিক নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ কতটুকু যুক্তিযুক্ত? যতই বলা হোক, তাদের সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে সহযোগিতা করা হবে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে সাধারন মানুষের মধ্যে শহরাঞ্চলের মানুষের চেয়ে সচেতনতার অভাব রয়েছে। তারা যখন ধান কাটবে, সেই ধান বাড়িতে নিয়ে আসবে-মাড়াই করবে। তখন স্বাভাবিকভাবেই একে অপরের সংস্পর্শে চলে যাওয়ার শঙ্কা রয়ে যায়। শুধু তাই নয়, তারা কে কোন জেলা থেকে আসছে- তারও ঠিক নাই। যে জেলা থেকে আসবে- সেখানে করোনা পরিস্থিতি কেমন, তারা ঠিক মতো কোয়ারেন্টিন পালন করেছে কি না- এসব প্রশ্নেরও উত্তর খোঁজা জরুরি। এর চেয়ে সহজ সমাধান রয়েছে। কম্বাইন হারভেস্টর ও  রিপার মেশিনের সাহায্যে কম শ্রমিক দিয়েই সহজেই ধান কাটা ও মাড়াই করা সম্ভব। ১০০ জন শ্রমিক আট ঘন্টায় যে পরিমাণ ধান কাটতে পারবে, একটি মেশিনে একই সময়ে সেই পরিমাণ ধান কাটতে পারবে। এর মানে, ১০০ জন শ্রমিকের কাজ করছে একটি মেশিন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এবারের করোনা সংকট মোকাবেলায় শ্রমিকের বিকল্প হিসেবে হাওড়াঞ্চলের সাত জেলায় জরুরিভিত্তিতে নতুন ১৮০টি কম্বাইন হারভেস্টর ও ১৩৭টি রিপার মেশিন কিনছে কৃষি মন্ত্রণালয়। তবে সার্বিক বিবেচনায় মনে হয়েছে, যন্ত্রপাতির এই সংখ্যা টা প্রয়োজনের তুলনায় খুব একটা প্রতুল নয়, অপ্রতুল। এর সংখ্যা বাড়ানো দরকার। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এটাই জরুরি যে, বাড়তি ৫০০ শ্রমিকের বিপরীতে বাড়তি আরও কিছু কম্বাইন হারভেস্টর, রিপার মেশিন ও রাইস ট্রান্সপ্লান্টার সরকারের পক্ষ থেকে সরবরাহ করা হোক। লকডাউন পরিস্থিতিতে দেশের বাইরে থেকে এসব মেশিন আনা সম্ভব নয়। তার প্রয়োজনও নেই। কেননা, দেশেই এসব মেশিনের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। আর কেবল হাওড় অঞ্চলই নয়, বোরো প্রধান সব অঞ্চলেই এখন এই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

করোনা ভাইরাস শুধু স্বাস্থ্য ঝুঁকি নয়, গোটা বিশ্বের অর্থনীতিকেই নাড়িয়ে দিচ্ছে। এর ধাক্কা লেগেছে বাংলাদেশের উদীয়মান অর্থনীতিতেও। করোনার কঠোর আঘাতে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে। ধীর হয়ে যেতে পারে অর্থনীতির গতিও। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এডিবি এরইমধ্যে বলেছে, বাংলাদেশের জিডিপি সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে এক দশমিক এক ভাগ কমে যেতে পারে। তাদের হিসাবে, এতে মোট তিনশো কোটি ডলারের ক্ষতি হবে। অন্যদিকে, বিশ্ব ব্যাংক বলছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চলতি অর্থবছরে নেমে দাঁড়াতে পারে দুই থেকে তিন শতাংশে; যা গত অর্থবছরেই ছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ। শুধু তাই নয়, আগামী অর্থবছরে তা আরো কমে ১ দশমিক ২ থেকে ২ দশমিক ৯ শতাংশ দাঁড়াতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপ। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গেল ১০ বছরে যখন দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন নভেল করোনাভাইরাসের প্রকোপে এমন প্রাক্কলন করলো বৈশ্বিক ঋণদাতা সংস্থাটি।

বাংলাদেশের কৃষি খাতে করোনা সংকটের প্রভাব উঠে এসেছে বাংলাদেশ পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)। সংস্থাটির পক্ষ থেকে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী জুন থেকে আগস্ট- এই সময়ে কৃষির বিপদের প্রভাব আরও স্পষ্ট হবে। পুরো কৃষি খাত বিশেষত খাদ্য সরবরাহের পুরো সার্কেল এই প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পিকেএসএফের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে বোরোর উৎপাদিত ধানের ২০ শতাংশ আসে হাওর থেকে। মৌসুমের প্রথম ধান পাকে ওই এলাকায়। এরপর পর্যায়ক্রমে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের ফসল পাকতে শুরু করে। কিন্তু করোনা সংকটের প্রভাবে ঠিক সময়ে এসব ফসল ঘরে তোলা কঠিন হবে। 

কাজেই এখনই সময় এদেশের কৃষিখাতকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। সরকারের নীতি নির্ধারকরা গুরুত্ব দিয়ে এ বিষয়ে কাঙ্খিত পদক্ষেপ নিবেন বলেই মনে করি।

লেখক- সাবেক সচিব, কৃষি মন্ত্রণালয়। 
ইমেইল: anwarfaruquebd@gmail.com 

আরকে//


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


টেলিফোন: +৮৮ ০২ ৫৫০১৪৩১৬-২৫

ফ্যক্স :

ইমেল: etvonline@ekushey-tv.com

Webmail

জাহাঙ্গীর টাওয়ার, (৭ম তলা), ১০, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

এস. আলম গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান

© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি