ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

মানুষের খোলস, খোলসের মানুষ

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ১৮:২৯, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনীতি-কড়চা, Freedom for Choice প্রভৃতি।

রোববার শেষ বিকেলের দিকে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। হেঁটে হেঁটে চলে গিয়েছিলাম একেবারে বো ক্রীক পর্যন্ত। কুলু কুলু জলের শব্দ, শান্ত জলে হাঁসেদের ঘোরা-ফেরা, নানান রঙ্গের আবাসন-নৌকো, ওপারে ভিক্টোরিয়া পার্কের বার্চের উত্তরের ঠান্ডা হাওয়া মিলিয়ে কেমন যেন আনমনা হয়ে পড়েছিলাম। কিছুক্ষণ বাদে চমক ভাঙ্গলে লক্ষ্য করলাম, আশেপাশে কেউ নেই, আমি একা, আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে এবং সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। উল্টোমুখো হয়ে আবার বাড়ীর পথ ধরলাম।

ঘন গাছপালা আর ঝোপঝাড়ে ঢাকা বাগানের পাশ দিয়ে হেঁটে আসার সময়ে সেই ঘনায়মান অন্ধকারে চোখ গেল একটি বার্চ গাছের গোড়ায়। না, এমন কিছু নয় - একটি সাপের খোলস পড়ে আছে। দেখে মনে হলো- সাপটি যেন এইমাত্র খোলসটি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। কেমন যেন গা শিরশির করা শীতল একটা অনুভূতি মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে গেল। কেন জানি দ্রুত পা চালালাম জায়গাটা পেরিয়ে যেতে।

হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো- আসলে সাপের মতো মানুষেরও তো খোলস আছে। সাপ খোলস ছেড়ে চলে যায় - মানুষ খোলস ধারণ করে থাকে। সাপ খোলস ছেড়ে নিজেকে প্রকাশ করে, মানুষ খোলস ধরে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। সাপ খোলস বদলায় প্রতিবছর, মানুষ খোলস ধরে রাখে সারা জীবন। সাপের খোলস বলা যায় কেমন হবে, মানুষের খোলসের অগ্রকথন সম্ভব নয়। 

কত রকমের যে খোলস ধরে মানুষ- ভালো মানুষীর, ভদ্রতার, মানবিকতার। আবার অনেক সময়ে নানান কৃত্রিম আবরণে ঢেকে থাকার কারণে বহু মানুষের মানবিক রূপটি আমরা দেখতে পাই না- তা'ও তো সত্য।

নিজেকে লুকিয়ে রেখে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অনবরত ভালোমানুষীর খোলস ধরতে দেখি মানুষকে। ভালোমানুষ সেজে অন্যের ক্ষতি করতে মানুষের জুড়ি নেই। যে মানুষটি বন্ধুত্বের খোলস ধরে হাত বাড়ায়, তার অন্য হাতে যে ছুরি শানায়, তা অনেক সময়ে আমরা দেখতে পাই না। আস্থাভাজনের আবরণে যে নির্ভরতার আশ্বাস দেয়, বিশ্বাসভঙ্গ করতেও তার আটকায় না। যাতে দেবতুল্য মনে হয়, তার খোলস খুলে গেলে তাকে শয়তানেরও অধম মনে হয়। 

আমার এক অপরাধবিজ্ঞানী বন্ধু একবার আমার বলেছিলেন যে, সবচেয়ে পাকা ও জঘন্য অপরাধীদের মুখে, চালচলন, ব্যবহারে এমন একটা খোলস থাকে যে, তাদের আর পাঁচজন থেকে তো আলাদা করাই যায় না, বরং তাদেরকেই সবচেয়ে ভালো মানুষ বলে মনে হয় আপাতদৃষ্টিতে। তারপর এ জাতীয় মানুষদের দ্বারা সংঘটিত কিছু অপরাধের তিনি বিবরণ দিয়েছিলেন। সে সব অপরাধের ন্যাক্কারজনক আর বীভৎসতায় শিউরে উঠেছিলাম। 

ভদ্রতার খোলস যে কত দেখেছি। প্রচণ্ড বিরক্তি কারো কারো প্রতি- কিন্তু দেখা হলেই উষ্ণ করমর্দনের সঙ্গে বলেছি, 'কি যে ভালো লাগল, আপনাকে দেখে'। সহকর্মীর পিতৃবিয়োগ ঘটেছে, কিচ্ছু আসে যায় না আমার তাতে, কিন্তু চিঠি লিখে শোকে মূহ্যমান এই ব্যক্তিটিকে বলছি, 'কি যে দু:খ পেয়েছি আপনার এ অপূরণীয় ক্ষতিতে। আন্তরিক সমবেদনা জানবেন"।

পাশের বাড়ীর প্রতিবেশীর পুত্রটি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছে - হিংসায় বুকটা ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু সবার সামনে ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরে বলছি, 'এ হচ্ছে আমাদের গর্ব'। বড়দের ভদ্রতার মেকী খোলস সবচেয়ে বিভ্রান্ত করে শিশুদের। এবং তাদের সরলতার অপমৃত্যু ঘটে ওখানেই। ভদ্রতার খোলস আবার শ্রেণি বিভাজনের ওপরে নির্ভর করে। আমাদের ভদ্রতার মেকী খোলসটা খুলে যায় যখন আমরা দরিদ্র শ্রেণির সঙ্গে কথা-বার্তায় রত হই।

মানবিকতার খোলসটি বেশী দেখা যায় গোষ্ঠীগত জীবনে। নিপীড়িত মানুষের জন্য কেঁদে ভাসিয়ে দেয়ার পরে বহু মানুষকে দেখি পাঁচতারা হোটেলের ভোজন কক্ষে। ধর্মের মানবতার কথা শেষে নানান দুর্নীতি আর ন্যাক্কারজনক কাজে লিপ্ত হন ধর্মীয় নেতারা। ধর্মীয় খোলসের বর্মতো বারংবার ব্যবহৃত হতে দেখেছি নানান সমাজে, নানান ধর্মে। মানবতার নামে, মানবিকতার খোলসে কত জায়গায় কত অর্থ তোলা হয়েছে, হিসেব মেলেনি সে সব সম্পদের নানান সময়ে। কুম্ভীরাশ্রু হচ্ছে- মানবিকতার খোলসের বড় অস্ত্র।

কিন্তু মানুষের খোলসের আর একটি সুনন্দ দিকও তো আছে। অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা আপাতদৃষ্টিতে রাগী মানুষের খোলস পরে থাকেন, কিন্তু অন্তরের ভেতরে তাঁদের মমতা আর স্নেহের ফল্গুধারা বয়ে যায়। আমার এক বাহ্যত হেঁয়ালী বা খেয়ালী বন্ধু আছে, যার হৃদয়টা বুঝতে পারলে একজন অত্যন্ত মমতাময় অনিন্দ্যসুন্দর মানুষের দেখা পাওয়া যায়। কিন্তু ওটা ভেতরের, বাইরের নয়; ওটা ছুঁতে পারার, দেখার নয়; ওটা বোধের, প্রকাশের নয়। 

বহু গুণীকে দেখেছি যে, নিজেকে লুকিয়ে রাখেন, নির্গুণের খোলস পরে থাকেন। যখন তাঁদের লুকিয়ে রাখা গুণের একটু নিদর্শন পাই, তখন হতবাক হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন বিকল্প থাকে না। 

বহুকাল আগে আমাদের এক সহকর্মীর বাড়ীতে এক নৈশভোজের আমন্ত্রণ ছিল। ভোজ শেষে কফির কাপ হাতে আমরা সবাই বসার ঘরে। সেখানে গৃহকর্ত্রী জানালেন যে, আমাদের জার্মান সহকর্মীটি চমৎকার পিয়ানো বাজান। তিনি সরাসরি অবশ্য তা অস্বীকার করলেন। কিন্ত জনতা তাঁকে ছাড়বে কেন? অনেকটা টেনে-হিঁচড়ে তাঁকে পিয়ানোর সামনে বসিয়ে দিলো বন্ধুরা। আধা মিনিটের মধ্যেই বোঝা গেলো এ এক পাকা হাত। বাজালেন বেটোফেনের 'ফ্যুর এঁলিস'। মিনিট পাঁচেক বাজিয়েছিলেন তিনি। সারা ঘরে একটা নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিলো। বাজনা যখন শেষ হলো, তখন বহুক্ষণ আমরা কথা বলতে পারিনি- এমনই ছিল তাঁর বাদনের অনুরণন। নির্গুণের খোলসে নিজেকে ঢেকে রেখেছিলেন কতকাল আমাদের কাছে।

চূড়ান্ত বিচারে মানুষ হয়তো আসলেই খোলস। এই যে আমাদের প্রত্যেকের মাঝে নানান মানুষ আছে- তার আধার তো নানান খোলসই বটে। তাই হয়তো প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, 'আমার মাঝের আসল আমিটি উঠে দাঁড়াবেন কি?' আর মাঝে মাঝে ওই যে সেই গানটি হৃদয়ের গহীন কোন থেকে উঠে আসে-  'হায় রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলেই ঠুস'। তখন নিজেকে একটা খোলস ছাড়া কি ই বা ভাবা যায়?

এনএস/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


টেলিফোন: +৮৮ ০২ ৫৫০১৪৩১৬-২৫

ফ্যক্স :

ইমেল: etvonline@ekushey-tv.com

Webmail

জাহাঙ্গীর টাওয়ার, (৭ম তলা), ১০, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

এস. আলম গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান

© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি