ঢাকা, শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪

মুক্তি সংগ্রামে নেপথ্য অনুপ্রেরণাদাত্রী বঙ্গমাতা

সাইদ আহমেদ বাবু

প্রকাশিত : ১৩:০৮, ৮ আগস্ট ২০২১

পৃথিবীর কোলে কাল বা সময় এক অমোঘ বিস্ময়। নতুবা বাঙালি নারীর বিস্ময়কর আর্বিভাব হবে কেন? আমি ‘বেগম রোকেয়া, মাদার তেরেসা বা মার্গারেট থেচার’- এর কথা লিখছি না, আমি ওইসব মানবীর উত্তরসূরির কথা বলছি- আমি বেগম ফজিলাতুন্নেছার কথা বলছি। যিনি আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর গর্ভধারিণী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী, যিনি আমাদের বঙ্গজননী।

প্রায় অর্ধশত বছর আগে এক বাঙালি নারী, হতেই পারেন তিনি বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের বিখ্যাত বক্তৃতাদানের আগে তার পটভূমি তৈরি করে দিয়েছেন কী মহান রাজনৈতিক আদর্শের আত্মজিজ্ঞাসা থেকে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ, সেদিনের সেই অলিখিত ও স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন, আর এজন্যই শেখ মুজিবুর রহমান আজও বাঙালির বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা। 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে লাখ লাখ মানুষ জীবন দিয়ে, অর্থ-সম্পদ বিলিয়ে, সম্ভ্রম দিয়ে মাতৃভূমিকে স্বাধীন করে স্বাধীনতার লাল সবুজের পতাকা ওড়াতে সক্ষম হয়েছিল। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করার পরে বিখ্যাত সেই ৭ মার্চের ভাষণের পূর্ব পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা তাঁর তুলির একটি আঁচড়ে (বঙ্গবন্ধু কন্যার লেখা থেকে জানা) উজ্জ্বল করে তুলেছেন বঙ্গবন্ধু পত্নী বেগম ফজিলাতুন্নেছাকে। তাঁর তীক্ষ্ণ বুদ্ধিতে মহৎ করেছে বালক কালের প্রবীণতাকে ধৈর্য সহকারে। প্রচণ্ড ধীশক্তি দিয়ে পরিচালনা করেছেন স্বামী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

ফরাসিতে একটি প্রবাদ আছে “First self revelation than social ravolation”. অক্ষরে অক্ষরে নিজের জীবনে তিনি তা প্রয়োগ করেছেন, মেনেছেন, জেনেছেন- তার প্রমাণ তার সমস্ত জীবনব্যাপী সংসারে রাষ্ট্রে।

বঙ্গমাতাকে সরাসরি দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ভবনে বিকালে ভাইবোনেরা মিলে ক্রিকেট খেলতেন, সেখানে শেখ কামালের খেলার সাথীরাও অংশগ্রহণ করতেন। আমার মেজভাই সেখানে খেলতে যেতেন। আমিও যেতাম, তবে খেলতে নয়, দেখতে। ছোট ছিলাম বলে। টেনিস বলে ম্যাচ হতো, সেখানে শেখ হাসিনা, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রেহানা ও পাড়ার সহপাঠীরা এসে খেলতেন। রাসেল তিন চাকার সাইকেল চালাতেন, বঙ্গমাতা খেলা দেখতেন। আমিও খেলা দেখতাম, সেই সুবাদে বঙ্গমাতাকে দেখা। আমার স্মৃতিতে বঙ্গমাতার ছবি অম্লান হয়ে আছে।

বঙ্গবন্ধু, বাঙালি ও বাংলাদেশ যেমন একই সূত্রে গ্রথিত, তেমনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবও পরস্পর অবিচ্ছেদ্য নাম। ফজিলাতুন্নেছার শৈশবের সঙ্গী শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁরা একই পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন।

১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মোহাম্মদ শেখ জহুরুল হক ও মাতা হোসনে আরা বেগম। মাত্র ৩ বছর বয়সে পিতা ও ৫ বছর বয়সে মাতাকে হারান। তার ডাক নাম ছিল ‘রেনু’। বড় হন দাদার কাছে। দাদা শেখ কাসেম, চাচাত ভাই শেখ লুৎফর রহমানের পুত্র শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বেগম ফজিলাতুন্নেছার বিবাহ দেন। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বেগম মুজিবের অনানুষ্ঠানিকভাবে যখন বিয়ে হয়, তখন তাঁর বয়স ছিল ৩ বছর, আর বঙ্গবন্ধুর বয়স ছিল ১০ বছর। তখন থেকে বেগম ফজিলাতুন্নেছাকে শাশুড়ি বঙ্গবন্ধুর মাতা সাহেরা খাতুন নিজের সন্তানদের সঙ্গে মাতৃস্নেহে লালন-পালন করেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পরিবারের সবার প্রতি ছিল তার সমদৃষ্টি। 

গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে তিনি প্রাথমিক লেখাপড়া করেন। অতঃপর সামাজিক রীতিনীতির কারণে গ্রামে গৃহশিক্ষকের কাছে পড়াশোনা করেন। তার স্মৃতিশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর। যে কোনো পরিস্থিতি অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা, অসীম ধৈর্য ও সাহস নিয়ে মোকাবেলা করতে পারতেন। গভীর ধর্মবিশ্বাস, সাহসী, পরিশ্রমী, নিঃস্বার্থ জনসেবক বঙ্গমাতা ছিলেন একজন সত্যনিষ্ঠ সহধর্মিণী। সুদীর্ঘ পরিক্রমায় বারেবারেই বাঁক নিয়েছেন, সঙ্কট বন্ধুর প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েই তাকে নিজের পথটি নিজে করে নিতে হয়েছে। চোখের জলকেও তিনি বিদ্যুতে পরিণত করতে পেরেছেন। অত্যাশ্চর্য তার রূপান্তর সাধনের ক্ষমতা।

স্বামী শেখ মুজিবুর রহমান যখন কলকাতায় থাকতেন বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছার সময় কাটতো রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্রসহ নানারকম বই পড়ে। তিনি ছিলেন সঙ্গীতপ্রিয়। তখন তাদের গ্রামের বাড়িতে গ্রামোফোন ছিল, পর্যায়ক্রমে সঙ্গীতের সব রকম বাদ্যযন্ত্রই তিনি সংগ্রহ করেন।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালির জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের যে নবধারা সূচিত হয়, সেই ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে নিউক্লিয়াস গঠিত হয়েছিল, এ নিউক্লিয়াসের যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারা বঙ্গবন্ধুর অনুমোদনক্রমে সংগঠন, আন্দোলন এবং সংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়ে আপোষহীন ভূমিকা রেখেছিলেন। সেই ছাত্র তরুণ সমাজের প্রধান এবং সর্বাত্মক প্রেরণার উৎসস্থল ছিলেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।

১৯৫৪ সালে শেখ মুজিব মন্ত্রী হলে বেগম মুজিব মিন্টো রোডের বাড়িতে ওঠেন। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা ভেঙে দিলে ১৪ দিনের নোটিশে ৩ নম্বর মিন্টো রোডের বাসা ছাড়তে বাধ্য হন বেগম মুজিব। এ রকম অনেকবার তাঁর বাসা বদল করতে হয়েছে। অবশেষে ১৯৬১ সালে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে নিজেদের বাড়ির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় এবং ওই বছরের ১ অক্টোবর বেগম মুজিব ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে প্রবেশ করেন।

বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র বিভিন্ন অংশে শেখ মুজিবুর রহমানের লেখায় উঠে এসেছে ২৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৃঢ় নেতৃত্বের অনুপ্রেরণা ছিলেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে দেশ ও মানুষের কল্যাণে অবদান রেখে গেছেন, তাকে প্রেরণা-সাহস-উৎসাহ দিয়েছেন।

১৯৬২ সালের সামরিক জান্তা আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে যখন অন্দোলন শুরু হয়, তার কিছুদিন পরেই বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন। সেই সময়ে বঙ্গবন্ধুকে প্রেরিত বার্তা মোতাবেক আন্দোলন পরিচালনা ও নির্দেশনা দিতেন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে বেগম মুজিব।

১৯৬৬ সালে বাঙালির জাতির মুক্তির সনদ ৬ দফা ঘোষণা করে জনমত সৃষ্টির জন্য সারাদেশে জনসভা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু ৮ বার গ্রেফতার হন। বঙ্গবন্ধু যখন বারবার পাকিস্তানি শাসকদের হাতে বন্দী জীবনযাপন করছিলেন, তখন দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীরা বেগম মুজিবের কাছে ছুটে আসতেন। ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাকসহ অপরাপর ছাত্রনেতার সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ ছিল তাঁর। 

আর ৬ দফা আন্দোলনের সবথেকে উল্লেখযোগ্য ঘটনা- কারাবন্দিদের মুক্তির জন্য ৭ জুনের হরতাল সফল করা। সেটাও সফল হয়েছিল বেগম মুজিবের প্রচেষ্টায়। গণঅভ্যুত্থানের সময় তিনি পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন এবং আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা পৌঁছে দিতেন এবং লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা জোগাতেন।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করার পর তদানীন্তন পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে বেশ কয়েকবার জিজ্ঞাসাবাদ করে গ্রেফতারের হুমকি দেয়। নেপথ্যে থেকে তিনি ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের প্রাক্কালে সে সময় সারাদেশে আন্দোলনে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। 

সামরিক জান্তা আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে গোলটেবিল আলোচনায় বসার প্রস্তাব দেন। আওয়ামী লীগের অনেক প্রভাবশালী নেতা ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধু ভবনে বেগম মুজিবের কাছে ছুটে যান প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব মেনে নেয়ার জন্য। কিন্তু বেগম মুজিব এক অনমনীয় দৃঢ় মনোভাব প্রদর্শন করেন। কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে তাকে প্যারোলে মুক্তি না নেয়ার অনুরোধ করেন। বঙ্গবন্ধু মুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখান করায় পাকিস্তানি শাসকের সব পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে যায়। 

ইতিমধ্যে শেখ মুজিবের মুক্তি আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং তা গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। গণঅভ্যুত্থানের মুখে বেগম মুজিবের পরামর্শে বঙ্গবন্ধুর সেই বিচক্ষণ সিদ্ধান্তের জন্য আইয়ুব খান জনরোষ থেকে বাঁচতে, ‘ওয়ান ম্যান ওয়ান ভোট’ মেনে নিয়ে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। আন্দোলন সংগ্রামের সূতিকাগার, স্মৃতিবিজড়িত ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের সেই বাড়ীটি স্বাধীনতা আন্দোলনের এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ- স্বাধীনতার এক অবিনশ্বর কেন্দ্র। এই অগ্নিকুণ্ডের প্রধান শক্তি বঙ্গমাতা বেগম মুজিব। 

বঙ্গবন্ধুসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সকল অভিযুক্তরা একসঙ্গে নিঃশর্ত মুক্তিলাভ করেন। এর মাধ্যমেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত হয়।

১৯৭০-এর নির্বাচনের সময় বিভিন্ন দল দাবি তুলেছিল ভোটের আগে ভাত চাই। কিন্তু বেগম মুজিব আওয়ামী লীগের নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নেন। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, কিন্তু পাকিস্তানিরা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে তালবাহানা শুরু করে। শুরু হয়ে যায় পূর্ববাংলায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্ব। 

বাঙালির স্বাধীনতা ও অধিকারের সংগ্রামে ওপরে বর্ণিত এ দুটি ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহে যদি বঙ্গমাতা প্রত্যক্ষ অবদান না রাখতেন, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যরকম হতে পারত। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হওয়ার পর বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে পরিবারের অপরাপর সদস্যদের সঙ্গে ধানমন্ডির ১৮নং সড়কের একটি বাড়িতে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। চরম মানসিক পীড়ন ও ভয়ঙ্কর পরিবেশ সৃষ্টি করে তাদের ওপর চালানো হয় অমানবিক নির্যাতন। কিন্তু স্বামীর বন্দিদশা এবং পাকিস্তানের কারাগারে তাকে হত্যার আশঙ্কা সর্বোপরি নিজেদের বন্দিত্ব ও নির্যাতন সত্ত্বেও তিনি মুহূর্তের জন্যও ভেঙে পড়েননি; মাথানত করেননি। 

১৯৭১-এর ১৭ ডিসেম্বর তাদের বন্দিদশার অবসান ঘটে। কিন্তু তারপরও বিজয়ের আনন্দ তিনি অনুভব করতে পারেননি। অপেক্ষা করতে হয়েছে এবং দেশবাসীকেও ধৈর্য্য ধারণের জন্য পরামর্শ দিতে হয়েছে। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। অবসান ঘটে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছার দীর্ঘ প্রতিক্ষার। বাঙালি জাতি ফিরে পায় তাদের অবিসংবাদিত প্রিয় নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

এই মহীয়সী নারী জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে দেশ ও জাতির সেবা করে গেছেন। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কেবল জাতির পিতার সহধর্মিণীই নন, বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে অন্যতম এক স্মরণীয় অনুপ্রেরণাদাত্রী। আমাদের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। 

তিনি সব সময় অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দানশীল। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ মানুষদের মুক্তহস্তে দান করতেন। উত্তরাধিকার সূত্রে বেগম মুজিব যতটুকু অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছিলেন তার পুরোটাই তিনি ব্যয় করেছেন নিঃস্বার্থভাবে সংসার এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত রাজনীতির পিছনে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের রোগে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, তিনি নিজের জমির ধান বিক্রির অর্থ পাঠিয়ে স্বামীকে সহযোগিতা করেছেন। প্রয়োজনের সময় ঘরের আসবাবপত্র, ঘরের ফ্রিজ, এমনকি নিজের গহনা বিক্রি করে ছাত্রলীগের সম্মেলন ও আন্দোলনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের টাকা দিয়েছেন। শিক্ষার জন্য সহযোগিতা সবসময়ই করতেন। 

বঙ্গবন্ধু ব্যস্ত থাকতেন রাজনীতি নিয়ে, সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগদান করা নিয়ে। কিন্তু ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা, লেখাপড়ার সব দায়িত্বই তিনি নিজের হাতে নিয়েছিলেন। স্বামীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি সন্তানদের গড়ে তোলেন। আন্দোলন চলাকালীন সময়ে প্রতিটি ঘটনা জেলখানায় সাক্ষাৎকারের সময় বঙ্গবন্ধুকে জানাতেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও নির্দেশ নিয়ে আসতেন, আমৃত্যু স্বামীর পাশে থেকে দেশ ও জাতি গঠনে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন।

বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’, ‘আমার দেখা নয়াচীন’-এর মত অসামান্য বই লেখার পেছনে বঙ্গমাতার অতুলনীয় অবদানের কথা জাতি চিরদিন স্মরণ রাখবে। গ্রন্থগুলো দেশ-বিদেশে নতুন প্রজন্মের জন্য বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে জানার অপার সুযোগ সৃষ্টি করেছে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাসহ পরিবারের সকলকে নির্মমভাবে খুনিরা হত্যা করে। ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড ঘটে সেদিন। বঙ্গবন্ধুর জীবনের সুখ-দুঃখের সঙ্গী মরণকালেও সঙ্গী হয়ে রইলেন।

বাঙালির ইতিহাস কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অধ্যায় ব্যতীত অসম্পূর্ণ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ পথ ছিল কন্টকাকীর্ণ-বন্ধুর। বেগম মুজিব তাঁর কর্মচাঞ্চল্যে উত্তরোত্তর আমাদের চমৎকৃত করে গেছেন। সময় যে মানুষকে কতটা বদলে দিতে পারে, মানুষের মধ্যে যে কত রকম প্রতিভা সুপ্ত থাকে, তার একটি জলজ্যান্ত উদাহরণ বেগম মুজিব।  

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর এ লড়াই-সংগ্রামের বন্ধুর পথকে মসৃণ করে দিয়েছিলেন তিনি। পর্দার অন্তরালে থেকে বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য কাজ করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন, যথার্থ গভীর আকুলতা তীব্র সংবেগ এবং ঐকান্তিক সদিচ্ছা মানুষকে যে কবি নজরুলের ভাষায় “দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার” অতিক্রম করতে সাহায্য করে। এই মহিয়সীর জীবনের বিভিন্ন স্তরের আলোকময় বর্ণনায় আমাদের মুগ্ধ করেছে।

বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব যে আদর্শ ও দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন, তা যুগে যুগে বাঙালি নারীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। এই মহান নারীর জীবনী চর্চার মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবন, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অনেক অজানা অধ্যায় সম্পর্কে আজকের নতুন প্রজন্ম ধারণা পাবে। তাঁর চিন্তা-চেতনায় আদর্শ ও মূল্যবোধের স্থান ছিল সবার উপরে। তিনি ছিলেন চিরকালই প্রচার বিমুখ। তৎকালীন সমাজে সর্বাপেক্ষা উজ্জল জোতিষ্ক। 

যথার্থ জীবন সংগ্রামের কথাই বলি আর সামান্য গৃহবধূ থেকে অসামান্য হওয়ার কথাই বলি- এমন উদাহরণ সহসা খুঁজে পাওয়া যায় না। দীর্ঘ অপেক্ষার পর হয়তো এমন কেউ আসেন যাঁর জীবনের দিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত বিস্ময়ে আমরা বলতে পারি, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় "তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ, তাই তব জীবনের রথ/পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমার বারম্বার" বা বলতে পারি, তোমার তুলনা কেবল তুমিই। 

“বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণ কর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর"। নজরুলের এই কবিতার লাইনগুলোই বাঙালির গভীর দর্শন। সেটিও প্রমাণ করেছেন বঙ্গমাতা। সত্যিই বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনব্যাপী যা যা করেছেন গভীরভাবে ভাবলে সমস্ত কাজের প্রেরণাই বঙ্গমাতা। তাই শেষে লিখতে হয়,  “এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ, মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান”। তাই তো তিনি তৎকালীন সমাজকে অতিক্রম করে ‘বঙ্গমাতা’ সর্বকালীন সমাজে স্থান করে নিয়েছেন। তাকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।  

প্রাণের প্রদীপ নিয়ে যাঁরা এই পৃথিবীতে দীপাবলী জ্বালাতে আসেন। মৃত্যুর কাছেও তাঁর পরাজয় নেই। বর্ণময় যে জীবন তিনি যাপন করেছেন, তাতে বেঁচে থাকার অমেয় সুধা অঞ্জলিভরেই পান করেছেন তিনি। কিংবদন্তীর মতো কীর্তি  প্রতিষ্ঠা ছিল তাঁর।

বঙ্গমাতা কঠিনতম দুঃখকেও বিধাতার দান হিসাবে গ্রহণ করেছেন। কতখানি অবিচলিত হৃদয় হলে বলা সম্ভব— রবীন্দ্রনাথের ভাষায়‘ এই করেছ ভালো, নিঠুর হে, এই করেছ ভালো/ এমনি করে হৃদয়ে মোর তীব্র দহন জ্বালো।' বলতে চেয়েছেন, জীবনবিধাতা আমাকে পরীক্ষা করে, যাচাই করে নিচ্ছেন। এই যে আঘাতের পর আঘাত, এ বৃথা যাবে না, এর দ্বারা নিশ্চিত কোনো মহৎ উদ্দেশ্য সাধিত হবে; হয়েছেও। দুঃখ একটা উদ্দীপনা। দুঃখের উত্তাপে মানুষের সকল অনুভূতি সজাগ হয়ে ওঠে, দুঃখের আঘাতে সহনশীল মানুষের মনোবল শতগুণে বৃদ্ধি পায়। ব্যক্তিত্বের উজ্জ্বলতা বাড়ে, মনুষ্যত্বের মহিমা নিঃসংশয়রূপে প্রমাণিত হয়। 

৪৪ বছর বয়সে পরিপূর্ণ জীবনভাণ্ডারটি উজাড় করে দিয়ে গেলেন দেশের স্বাধীনতা ও জনগণের জন্য। তিনি নেই। তিনি বহুদিন বেঁচে থাকবেন। তিনি নতুন করে এবং আরও অনেক অনেক বেশী করে, অধিষ্ঠিত হচ্ছেন বিশ্বমানবের হৃদয়মন্দিরে। সূর্য অস্ত গেলে সর্বত্রই যেমন নীরন্ধ্র অন্ধকারে ডুবে যায় না, কোথাও কোথাও বিরাজ করে অশেষ অমলিন জ্যোতিঃপ্রভা, বঙ্গমাতা চলে গেলেও, তেমনি দীপ্যমান তাঁর কীর্তিপ্রভা। শুধু এই ক্ষুদ্র বাংলাদেশেতে নয়—বিশ্বভূমিতে।

প্রতিটি মানুষের মতো বঙ্গমাতা নিজেও জানতেন, তাঁর জন্মদিনের মধ্যে আসন গেড়ে বসে আছে মৃত্যুদিনের আগাম নোটিস। অর্থাৎ বিচ্ছিন্নতা, মানুষের কাছ থেকে তাঁর বিচ্ছেদ। শ্রাবণের ধারার মতো অবিচ্ছিন্ন। বিগত দিনের পথের সঞ্চয়ই আজ হয়ে উঠুক আমাদের পাথেয়। সেই হোক তাঁর অকৃপণ আশীর্বাদ। তাঁর আশীর্বচন শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝড়ে, পড়ুক ঝড়ে।

বঙ্গবন্ধুর কন্যা আজকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সেই ‘সোনার বাংলা’ বিনির্মাণের জন্য কাজ শুরু করেছেন। আমাদের স্বাধীনতার পতাকাকে বহন করে তিনি বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে রোল মডেলে পরিণত করেছেন। বঙ্গমাতার ৯১তম জন্মদিনে গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।

লেখক: সভাপতি, ‘আমরা ক’জন মুজিব সেনা’ ও সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, ‘উত্তরণ’।

এনএস//


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি