ঢাকা, শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪

মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিলাম : বঙ্গবন্ধু

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১২:৪৩, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | আপডেট: ১২:২৫, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০

লন্ডনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রথম সংবাদ সম্মেলন করছেন বঙ্গবন্ধু। ছবি: সংগৃহীত

লন্ডনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রথম সংবাদ সম্মেলন করছেন বঙ্গবন্ধু। ছবি: সংগৃহীত

পাকিস্তান কারাগারে নয় মাসের বন্দিজীবন কাটিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পান ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ । মুক্তির পর পাকিস্তান থেকে লন্ডন চলে আসেন তিনি। সেখানেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রথম সংবাদ সম্মেলন করেন। এ সময় এক প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি মৃত্যুর জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম। মনে রাখতে হবে, যে মানুষ মরতে প্রস্তুত তাকে কেউ মেরে ফেলতে পারে না।’

বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটি লন্ডনের হিথ্রো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। বিমানবন্দরে অপেক্ষায় ছিলেন লন্ডনে বাংলাদেশ মিশনের প্রধান এমএম রেজাউল করিম। আর ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান ইয়ান সাদারল্যান্ড। বঙ্গবন্ধু ব্রিটিশ সরকার নির্ধারিত সরকারি লিমোজিন ব্যবহার না করে রেজাউল করিমের গাড়িতে চড়েই হোটেলে যান। 

এ সময় হাজার হাজার বাঙালি হোটেল ক্যারিজেস ঘিরে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে আকাশ-বাতাস মুখরিত করেন। অনেকেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার অনুরোধ করেন; যা নিয়ে সমস্যায় পড়ে হোটেল কর্তৃপক্ষ। পরে সিদ্ধান্ত হয় পাঁচজনের একটি দল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে পারবে। দুপুরে হোটেলে জনাকীর্ণ এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন বঙ্গবন্ধু।

লন্ডনের হোটেল ক্যারিজেস লবিতে জনাকীর্ণ ওই সংবাদ সম্মেলনে ইংরেজিতে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের জন্য আমাদের লড়াইয়ের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। পাকিস্তানের কারাগারের কনডেম সেলে আমি যখন ফাঁসির জন্য অপেক্ষা করছিলাম তখন বাংলাদেশের জনগণ আমাকে তাদের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেছে। আমি স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে স্বাধীনতাকামী সব রাষ্ট্র যারা আমাদের সমর্থন দিয়েছে তাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। বিশেষত ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড ও অন্যান্য পূর্ব ইউরোপিয়ান রাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা স্বাধীনতাকামী জনগণ যারা আমাদের সমর্থন জানিয়েছেন তাদের সকলকে আমি ধন্যবাদ জানাই। আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ জনগোষ্ঠীকেও তাদের সহায়তার জন্য ধন্যবাদ জানাতে চাই। এখন আমি সকল রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানাই বাংলাদেশকে অতিসত্বর স্বীকৃতি দিতে এবং জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্তিতে সমর্থন জানাতে।’

আধা ঘণ্টার কিছু কম সময়ের ওই সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বিশ্বের আর কোনো দেশের মানুষকে বাংলাদেশিদের মতো স্বাধীনতার জন্য এতটা মূল্য দিতে হয়নি। আমিও একটি মুহূর্তের জন্য তাদের এই দুর্দশার কথা ভুলতে পারিনি। তাই আমি দেশ ও দেশের বাইরে থাকা প্রত্যেক বাংলাদেশিকে ধন্যবাদ জানাই। অভিনন্দন জানাই মুক্তিবাহিনীর প্রতিটি সদস্যকে। যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করা লাখ লাখ মানুষের শোকাহত পরিবারের প্রতি জানাচ্ছি সমবেদনা ও বিদেহী আত্মার মাগফিরত কামনা করছি।’

এক ব্রিটিশ সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশে কী বীভৎসতা চালানো হয়েছে তা শুনলে আপনারা আশ্চর্য হবেন। লাখ লাখ মানুষকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে, মাইলের পর মাইল যেভাবে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, বেঁচে থাকলে হিটলারও হয়তো লজ্জা পেতেন।’ 

পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকার বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এটা আমার জন্য নতুন কোনো বিষয় নয়, আমি গত ১০-১৫ বছর ধরেই এর মধ্যে রয়েছি। আর একটা বিষয় মনে রাখবেন, যে নিজেই মরতে চায়, তাকে কেউ মারতে পারে না।’ 

অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি ৩৫ বছর ধরে রাজনীতি করছি, আমি জানতাম, আমি যদি কারাগারেও যাই বা বেঁচে নাও থাকি বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে আনবেই।’ 

স্বাধীন দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়ার সংবাদ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমাকে যে কারাগারের যে সেলে রাখা হয়েছিল সেখানে সূর্যের আলো বা বাতাস কিছুই ঢুকত না, কোনো রেডিও বা খবরের কাগজও দেওয়া হতো না। বিশ্বের কোনো কিছুর সঙ্গেই আমার যোগাযোগ ছিল না। অবশ্য জুলফিকার আলী ভুট্টো আমার কাছে এসেছিল। তার মাধ্যমেই প্রথম জানতে পারি বাংলাদেশের সরকার গঠনের কথা, আমাকে প্রেসিডেন্ট করার কথা।’ 

সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমি সহায়তার জন্য সারা বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানাই। কারণ সুজলা সুফলা বাংলাদেশে শুধু লাখ লাখ মানুষই মারা যায়নি, হাজার হাজার কিলোমিটার রাস্তা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে, রেলপথ ধ্বংস করা হয়েছে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, অর্থনীতিকে পুরো ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। আমি আবেদন জানাই দরিদ্র মানুষকে বাঁচানোর জন্য।’ 

এক প্রশ্নকারী ব্রিটিশ সাংবাদিককে উদ্দেশ্য করে তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ যে কতটা সম্পদশালী ছিল তা আপনারা জানেন। কিন্তু একশ’-দেড়শ’ বছরের বিদেশি শাসনে থেকে অনেক কিছুই হারিয়েছে বাংলাদেশ। আমি মনে করি ব্রিটিশ সরকারেরও এখন দায়িত্ব বাংলাদেশকে সহায়তা করা। কারণ বাংলাদেশের সম্পদ আহরণ করেই আজকের ব্রিটেনে অনেক স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। সেই ঋণ আজ পরিশোধের সময় এসেছে। শুধু ব্রিটেন নয়, আমি সারা বিশ্বের প্রতি লাখ লাখ মানুষকে ক্ষুধার জ্বালা থেকে বাঁচানোর আহ্বান জানাই।’

বঙ্গবন্ধু যখন লন্ডনে পৌঁছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ ছিলেন লন্ডনের বাইরে। বঙ্গবন্ধুর পৌঁছানোর কথা শুনে পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি বাতিল করে প্রধানমন্ত্রী হিথ ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ছুটে আসেন। প্রধানমন্ত্রী হিথ তাকে নজিরবিহীন সম্মান দেখান। ওইদিন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিথ নিজে তাঁর কার্যালয়ের বাইরে এসে গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রইলেন, যতক্ষণে না বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব গাড়ি থেকে বেরিয়ে না আসেন।

পরদিন ৯ জানুয়ারি লন্ডন সময় সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে ঢাকায় ফেরার জন্য বঙ্গবন্ধু ওঠেন ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবহরের কমেট জেটে। বাংলাদেশে ফেরার পথে বিমানটি দুই ঘণ্টার যাত্রাবিরতি করে দিল্লিতে। ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নয়াদিল্লিতে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান। পরে ১০ জানুয়ারি সকাল ১০টায় স্বাধীন বাংলার মাটিতে পা রাখেন বঙ্গবন্ধু।

এএইচ/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি