ঢাকা, বুধবার   ০৯ জুলাই ২০২৫

রাষ্ট্র পুনর্গঠনে বিএনপির ৩১ দফা : ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার একটি সাহসী প্রস্তাব

শাহেদ শফিক

প্রকাশিত : ২০:১১, ৯ জুলাই ২০২৫ | আপডেট: ২১:৫৫, ৯ জুলাই ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

বাংলাদেশ আজ এক গভীর রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও নৈতিক সংকটে আক্রান্ত। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভাঙন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণমূলক দলীয় প্রভাব, বিচারহীনতা ও জবাবদিহিহীন শাসনব্যবস্থানে প্রভাব এখনো কেটে উঠেনি। এই দীর্ঘস্থায়ী সংকট থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতেই বিএনপি জাতীয় ঐক্যজোট গঠনের মাধ্যমে যে ৩১ দফা রাষ্ট্র সংস্কার কর্মসূচি প্রস্তাব করেছে, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য সময়োপযোগী ও প্রয়োজনীয়। এটি শুধু একটি রাজনৈতিক দল বা জোটের ইশতেহার নয়, বরং এক যুগান্তকারী রূপরেখা যা রাষ্ট্রকে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করার ডাক।

এটা জেরে রাখা ভালো, রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ভাষ্যমতে-  কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি তখনই টিকে থাকে, যখন সেই রাষ্ট্রে জনগণ তাদের নেতৃত্ব নির্ভয়ে ও স্বাধীনভাবে নির্বাচন করতে পারে। বিএনপির কর্মসূচির প্রথম দফাগুলোতেই রয়েছে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের দাবি। ২০১৪ ও ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচন যে মাত্রায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, তা শুধু বিরোধী দলের নয়, আন্তর্জাতিক মহলেরও উদ্বেগের কারণ হয়েছে। তাই ভবিষ্যতের নির্বাচন যাতে স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক এবং গ্রহণযোগ্য হয়, সে লক্ষ্যে নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি আজ আর রাজনৈতিক নয় এটি জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে।

বিএনপির কর্মসূচিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সংবিধানের ৭০ ধারা সংস্কার। বর্তমান ধারা অনুযায়ী সংসদ সদস্যরা দলের বিরুদ্ধে ভোট দিলে তাদের আসন শূন্য হয়ে যায়। এতে তারা জনগণের নয়, কেবল দলের নির্দেশেই কাজ করতে বাধ্য হন। বিএনপি প্রস্তাবিত সংস্কারে বলা হয়েছে, সংসদ সদস্যদের নৈতিক ও স্বাধীন অবস্থান বজায় রাখতে হবে, যা গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত। সংসদ যদি নির্বিচারে দলীয় আদেশ বাস্তবায়নের প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়, তবে সেখানে আইন প্রণয়ন হবে দলীয় স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে নয়।

বর্তমান সময়ে জনগণের সবচেয়ে বড় আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে বিচার বিভাগের প্রতি। বিএনপি বিচারক নিয়োগ ও শৃঙ্খলা নির্ধারণে একটি স্বতন্ত্র বিচার কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেছে। এটি বাস্তবায়িত হলে বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের প্রভাব হ্রাস পাবে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পাবে। আদালতের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনা গেলে গুম, খুন, দমন-পীড়নের বিচারও সঠিকভাবে সম্পন্ন হতে পারবে। বর্তমাণ সময়ে এটি জনগণের মূখ্য দাবিতে পরিণত হয়েছে।

দেশে দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। বিএনপির কর্মসূচিতে রয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও সম্পূর্ণ স্বাধীন প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের প্রস্তাব। একই সঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক খাত সংস্কারের প্রতিশ্রæতি দেওয়া হয়েছে। “লুটের অর্থনীতি” ভেঙে “জনগণের অর্থনীতি” গঠনের লক্ষ্যে এই কর্মসূচির প্রস্তাবগুলো অত্যন্ত সময়োপযোগী ও বাস্তবমুখী।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বর্তমান সময়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সবচেয়ে বন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, এমনকি সাধারণ জনগণও সামাজিক মাধ্যমে মতপ্রকাশ করে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। বিএনপি এই আইন বাতিলের প্রস্তাব দিয়েছে। এর পাশাপাশি গুম-খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ, ও মানবাধিকার কমিশনকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ একটি মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে।

দেশে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান দিনে দিনে বাড়ছে। দুর্নীতি ও পুঁজিপতিদের আধিপত্যে সাধারণ মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। বিএনপি কর্মসূচিতে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, নূন্যতম মজুরি নির্ধারণ, কৃষককে ন্যায্য দামে পণ্য বিক্রির নিশ্চয়তা, এবং গরিব-অসহায়দের জন্য ‘অর্থনৈতিক নিরাপত্তা আইন’ প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। এটি কেবল একটি রাজনৈতিক ঘোষণা নয়, বরং সমাজে ন্যায়ের ভিত্তি গড়ে তোলার একটি সাহসী প্রস্তাব।

বিএনপি শিক্ষা খাতে সামগ্রিক সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে যাতে থাকবে একক, বৈজ্ঞানিক ও যুগোপযোগী পাঠ্যক্রম, মেধাভিত্তিক নিয়োগ, এবং শিক্ষা ব্যবস্থার রাজনীতিমুক্তিকরণ। একইভাবে স্বাস্থ্যখাতে রয়েছে দুর্নীতি রোধ, চিকিৎসা ব্যবস্থায় ডিজিটাল সেবা ও গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণের প্রস্তাব। এগুলো বাস্তবায়ন হলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে।

তরুণ প্রজন্মের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং প্রযুক্তিনির্ভর কর্মক্ষেত্র গড়ে তোলার বিষয়টিও ৩১ দফার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দেশে প্রতিদিন হাজার হাজার শিক্ষিত তরুণ বেকার থাকছেন, যাদের অনেকেই বিদেশ পাড়ি দিচ্ছেন অনিশ্চিত জীবনের পথে। বিএনপি দক্ষতা উন্নয়ন, উদ্যোক্তা সহায়তা ও বিদেশগামী শ্রমিকদের সুরক্ষার প্রতিশ্রæতি দিয়েছে। এটা ভবিষ্যতের জন্য একটি বিনিয়োগ।

সবশেষে বলা যায়, বিএনপি যে বিষয়টি পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছে, তা হলো ক্ষমতায় গেলে ২ বছরের মধ্যে রাষ্ট্র সংস্কার বাস্তবায়নে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি অন্তর্র্বতী সরকার গঠন করা হবে, যারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে নতুন নির্বাচন করবে। এটি একমাত্রিক ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির বিপরীতে একটি অংশগ্রহণমূলক ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার প্রস্তাব।

বিএনপির ৩১ দফা কর্মসূচিকে কেবল একটি রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে দেখলে ভুল হবে। এটি বাস্তব সংকট থেকে মুক্তির জন্য একটি সুসংহত ও যৌক্তিক রূপরেখা। গণতন্ত্র, সুশাসন, মানবাধিকার ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে এটি সময়ের দাবি। বিরোধীদল হিসেবে নয় একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিএনপি রাষ্ট্রের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে তার সমাধানের পথ দেখিয়েছে। এটি কেবল একটি রাজনৈতিক ঘোষণা নয়, বরং সমাজে ন্যায়ের ভিত্তি গড়ে তোলার একটি সাহসী প্রস্তাব।

এখন প্রয়োজন জনগণের সচেতন অংশগ্রহণ, নাগরিক সমাজের মূল্যায়ন এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা যাতে এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি ন্যায্য, মানবিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা পায়।

লেখক: প্রবাসী সাংবাদিক, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

এসএস//
 


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি