ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪

রোহিঙ্গা ফেরত পাঠানোই একমাত্র সমাধান

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৯:৩৮, ২৪ জানুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ১৯:৫১, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

অধ্যাপক ড. এহসানুল হক

অধ্যাপক ড. এহসানুল হক

মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর দেশটির সেনাবাহিনী যে নিপীড়ন-হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে সেটি পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। নির্যাতনের মুখে প্রাণ বাঁচাতে নাফ নদী হয়ে দলবেঁধে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে লাখ লাখ রোহিঙ্গা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যখন উদ্বাস্তু-শরনার্থী প্রবাহ ঠেকাতে তৎপর তখন বাংলাদেশ বিপদগ্রস্ত এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়ে মানবিকতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। শুধু আশ্রয়ই নয়; তাদের খাদ্য-বস্ত্র, চিকিৎসাসহ প্রয়োজনীয় সব ধরণের সহায়তা দিয়ে আসছে।

রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশ শুরু থেকেই বলে আসছে। এ সংকট সমাধানে দেশীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নানা আলাপ-আলোচনা ও উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে দেশি-আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। যদিও ইতোমধ্যে মিয়ানমারের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান কি?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সর্ম্পক বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এহসানুল হক মনে করেন সব রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর মধ্যেই সঙ্কটের স্থায়ী সমাধান নিহিত। সম্প্রতি তিনি একুশে টেলিভিশন অনলাইনের সঙ্গে বর্তমান রোহিঙ্গা পরিস্থিত সংকট ও তার উত্তরণের পথ এবং শরণার্থী ব্যবস্থাপনার নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইটিভি অনলাইন প্রতিবেদক তবিবুর রহমান  

পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকারটি ইটিভি অনলাইনের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-

একুশে টিভি অনলাইন : রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়াটার সঙ্গে নি:সন্দেহ মানবিক বিষয়টি জড়িত। একইসঙ্গে আমাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও জড়িত। আপনি কিভাবে দেখছেন?

অধ্যাপক এহসানুল হক : নিরাপত্তার বিষয়টা অবশ্যই জড়িত। যে মুহুর্তে তাদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে সেই মুহুর্ত থেকেই আমার দেশ জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে হুমকির মুখে পড়েছে। হুমকি তৈরি হয়েছে সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও। তাদের খাদ্যের যোগান দেওয়া আমাদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়টা যদি আমরা দেখি, তারা বিদেশি নাগরিক। রাষ্ট্রহীন নাগরিক। তাদের সরকার তাদের স্বীকৃতি দিচেছ না। তাই তাদের মধ্যে এক প্রকার হতাশা দেখা দিয়েছে। এই হতাশা থেকে তার নানা ধরনের অপরাধমুলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হতে পারে। এছাড়া আমাদের দেশের জঙ্গিবাদও পুরোপরি নির্মূল হয়নি। ফলে এসব রোহিঙ্গাদের তাদের (জঙ্গি) সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ার একটা বড় আশংকা দেখা দিয়েছে।

অর্থের অভাবে এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ব্যবহার হাওয়ার শংকাও রয়েছে। যদি প্রত্যাবসনের সময় দীর্ঘমেয়াদী হয় তবে আমাদের দেশের জনগণের হুমকি আরও বাড়বে। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোহিঙ্গারা আমাদের নিরপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদে যদি রোহিঙ্গারা আমাদের দেশে আবস্থান করে তবে সেটি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এ কারণে রোহিঙ্গা ফেরত পাঠানোই সমস্যা লাঘবের একমাত্র পথ। 

একুশে টিভি অনলাইন : রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক ফোরামে এবং আঞ্চলিক বিভিন্ন বহু সস্মেলনে আলোচনা হচ্ছে। সবাই যার যার অবস্থা থেকে পরামর্শ দিচ্ছে। তবে সমস্যা সমাধানে কিন্তু দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ খুব একটা চোখে পড়ছে না। কেন সেটি ?

অধ্যাপক এহসানুল হক: এটা মূলত দু’দেশের সমস্যা। সমাধানের জন্য দু’দেশ একসঙ্গে বসে সমাধান করা উচিত। কিন্তু রোহিঙ্গা ফেরত নেওয়ার বিষয়ে মিয়ানমার থেকে তেমন সাড়া পাচ্ছি না। সমস্যাটা দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধান হওয়া উচিত। তবে দ্বিপাক্ষীয়ভাবে সমাধানের সুযোগ আছে বলেও মনে হচ্ছে না। আন্তর্জাতিকভাবে চাপ দিলেও খুব বেশি লাভ হবে না। যদি না মিয়ানমার এ বিষয়ে আগ্রহ না দেখায়। মিয়ানমারের আন্তরিকতার উপর নির্ভর করছে এ সম্যসার সমাধান। আন্তর্জাতিকভাবে অনেকে সমর্থন দিয়েছে বাংলাদেশকে। এটা শুধু সমর্থন ছাড়া আর কিছু না। কারণ মিয়ানমারের পক্ষে রাশিয়া ও চীন সর্বোতভাবে বস্থান নিয়েছে। তারা বাংলাদেশকে বন্ধু রাষ্ট্র মনে করে। কিন্তু মিয়ানমার অস্থিতিশীল হক এটা তারা চায় না। এর একটি মাত্র কারণ মিয়ানমারে তাদের বিনিয়োগ করছে। এ কারণে সমাধান যে আমার শুধু মিয়ানমারের সঙ্গে করবো এর সুযোগও অনেক কম। আমরা সব সময় বলি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের সঙ্গে রয়েছে। কিন্তু দেখছি তিনটি বড় রাষ্ট্র মিয়ানমারের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। সে কারণে আমরা এখনও দাবি করতে পারি না পুরো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এ তিন রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক, আয়তনের দিক থেকে শক্তিশালী। সুতরাং রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের থেকে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে এই তিন রাষ্ট্র মিয়ানমারের পক্ষে থাকায়।

একুশে টিভি অনলাইন :  বাংলাদেশ সরকার ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো বহুদিন ধরে রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে বলে আসছে। এমনকি সম্প্রতি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এসংকট টেকসই সমাধানে এগুলো কতটা কাজে আসবে।

অধ্যাপক এহসানুল হক: টেকসই সমাধান হাওয়ার বিষয়ে আমরা সবাই আশাবাদী। বাংলাদেশ এককভাবে এ সমস্যা সমাধান করতে পারে না। বাংলাদেশের পক্ষে রোহিঙ্গাদের বহন করা অসম্ভব। যতটুকু করছি তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা। টেকসই সমাধানের জন্য বাংলাদেশের সামনে যেসব সুযোগ তৈরি হচ্ছে তার সবটুকুই গ্রহণ করা।

মিয়ানমারের সঙ্গে যে চু্ক্তির কথা বারবার বলছি সেটি কিন্তু চুক্তি নয়। কারণ চুক্তিতে প্রত্যাবসের সময় উল্লেখ থাকে। কিন্তু মিয়ানমারের সঙ্গে যে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে তাকে প্রত্যাবাসনের সময়সীমা লেখা নেই। এদিকে মিয়ানমার কিন্তু চুক্তি সই করতে রাজি নয়। তাহলে আপনি কি করবেন? তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তো কোনো লাভ হচ্ছে না। এখন যুদ্ধ করার মতো ক্ষমতাও বাংলাদেশের নেই। তাই যদি আমরা দেশটির সঙ্গে অবন্ধুসুলভ আচরণ করি সেটি হবে আমাদের জন্য ক্ষতিকারক। বাংলাদেশকে অবশ্যই ধৈর্য্য ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজ করতে হবে।

গণহত্যার দায়ে মিয়ানমারের বিচারের কথা বারবার উঠে আসছে। আন্তর্জাতিক আদালতে এর বিচার হবে। আমার তাদের বিচারের কথা বারবার সামনে আনলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে।  

একুশে টিভি অনলাইন :  শুধু রোহিঙ্গা পাঠানো নয়, মিয়ানমার নানাভাবে আমাদের জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। যেমন মাদক বাণিজ্য। মিয়ানমার থেকে কোটি কোটি ইয়াবা আমাদের সীমান্তে ঢুকে পড়ছে। এতে আমাদের তরুণরা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এবিষয় কেউ কিছু বলছে না। বিষয়টি নিয়ে এখনি ভাবার দরকার কি না?

অধ্যাপক এহসানুল হক : মাদকের কারণে আমাদের দেশের জনসমাজ ধ্বংসের মুখে। আর এর সিংহভাগ আসে মিয়ানমার থেকে। বহু বছর ধরে মিয়ানমার থেকে এসব মাদক আসছে। বাংলাদেশ সরকারের এখনি উচিত এ বিষয়ে ব্যবস্থা কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। এখনি এটাকে রোধ না করতে পারলে আমাদের দেশের যুবসমাজ বিপথগামী হয়ে যাবে। বাংলাদেশে মাদক আসার কারণে মিয়ানমার কিছু মানুষ লাভবান হচ্ছে আবার বাংলাদেশের কিছু মানুষ লাভবান হচ্ছে। এসব ব্যবসায়ী মনভাব ত্যাগ করে করতে হবে। এ বিষয়ে সরকারকে কঠোর হতে হবে। এটা রোধ করতে না পাররে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।   

একুশে টিভি অনলাইন :  শুধু চাপের মধ্য দিয়ে এ সংকট সমাধান হবে কি না। নাকি অন্য কোনো কৌশল নেওয়া যেতে পারে?

অধ্যাপক এহসানুল হক: আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। সেই সঙ্গে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের দ্বিপক্ষীয় আলোচনাও চালিয়ে যেতে হবে। আজকে এই সঙ্গে যদি ভারতের সঙ্গে মিয়ানমারের হতো। তবেই বহু আগেই সমাধান হয়ে যেতো। কারণ ভারতের চাপ প্রয়োগসহ ব্যবস্থা নেওয়ার মত শক্তি আছে। আমাদের কিন্তু সেটি নেই।  

একুশে টিভি অনলাইন :  সম্প্রতি মিয়ানমারের সঙ্গে যে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। অনেকেই এটাকে ফাঁদ বলছে আপনি কি মনে করেন?

অধ্যাপক এহসানুল হক: আমি এটাকে ফাঁদ বলবো না । বাংলাদেশের জন্য একটা বড় সুযোগ তৈরি হয়েছে। আমার মনে হয় সরকার সঠিক কাজই করছে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে আমাদের সামনে যেকোনো সুযোগ আসলে তা গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে মিয়ানমার অন্তর্জাতিক মহলে বলার সুযোগ পাবে বাংলাদেশ তাদের আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে না।  

/ এআর /


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি