ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪

শোষণমুক্ত সমাজ গঠনে এগিয়ে আসুন

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৪:৩৭, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ছবি: সংগৃহীত

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ছবি: সংগৃহীত

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি শহীদ স্মরণ সপ্তাহের প্রথম দিবসে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক বেতার ভাষণে একুশের শহীদানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে এই মর্মে আহবান জানান, আসুন, আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ গড়ি, একটা শোষণহীন সমাজ তৈরি করি। তিনি বলেন, স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি, কিন্তু শোষণহীন সমাজ ছাড়া এর ফল ভোগ করা সম্ভব নয়। তিনি ছাত্র, যুবক ও মেহনতী জনতাকে এই লক্ষ্যে এগিয়ে আসার আহবান জানান। 

বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণের পূর্ণ বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হলো:

দেশবাসী ভাই ও বোনেরা আমার,
আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি আমরা স্বাধীন দেশের মাটিতে প্রথমবারের মতো শহীদ দিবস উদযাপন করতে যাচ্ছি।

১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ থেকেই এ সংগ্রাম শুরু হয়। সেদিন আমরা গ্রেফতার হয়েছিলাম রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে। সেটা শুধু ভাষা আন্দোলনই ছিল না এবং কেবলমাত্র ভাষা আন্দোলনই সেদিন শুরু হয় নাই। এ আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের মানুষের স্বাধিকার আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন। ১৯৪৮ সাল থেকে আস্তে আস্তে এ সংগ্রাম শুরু হয়। ’৫২ সালে এই সংগ্রাম চরম পর্যায়ে উপনীত হয়। সেদিন আমাদের দেশের ছেলেরা রক্ত দিয়েছিল, শহীদ হয়েছিল বাংলাভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। কিন্তু সেটা কি শুধু ভাষা আন্দোলনই ছিল।

সেটা কেবলমাত্র ভাষা আন্দোলনই ছিল না। ছেলেরা রক্ত দিয়েছিল কেবলমাত্র ভাষার জন্য নয়, এর সঙ্গে ছিল সাংস্কৃতিক, স্বাধিকার আর মানুষের মতো বাঁচবার অধিকারের সংগ্রাম। সেদিন অনেকেই বুঝতে চেষ্টা করেন নি যে, বাংলার মানুষ জেগে উঠেছে, বাংলার মানুষকে আর দাবিয়ে রাখা যাবে না। সেদিন থেকে শুরু হয়েছিল চরম সংগ্রামের প্রস্তুতি।

বছরের পর বছর এই দিনটি আমার দেশের ভাইবোনেরা পালন করছে শহীদ দিবস হিসেবে। কিন্তু শহীদ দিবস পালন করলেও বার বার এর উপর আঘাত এসেছে। এ দিনটি সত্যিকার অর্থে আমরা উদযাপন করতে পারিনি। কারণ, শোষকগোষ্ঠী এই দিনটিকে হিংসার চোখে দেখত এবং তারা এটাকে ধ্বংস করতে বার বার চেষ্টা করেছে। এমনকি যে সামান্য শহীদ মিনারটি গড়ে উঠেছিল তার উপরও বার বার এই ষড়যন্ত্রকারী এবং শোষক শ্রেণী আঘাত করেছে।

তারপর থেকে বছরের পর বছর অনেক ভাইবোন, দেশের জনসাধারণ জীবন দিয়েছেন। জীবন দিয়েছেন স্বাধিকারের আন্দোলনে, স্বাধীনতা আন্দোলনে। তারা বাঁচতে চেয়েছে মানুষের মতো। তারা চেয়েছে তাদের অধিকার, তারা চেয়েছে স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে তারা বাস করবে। কিন্তু পৈশাচিক শক্তি সেটা কিছুতেই মানতে চায়নি। হত্যা করেছে আমার ভাই-বোনদের। আঘাত করেছে আমাদের সংস্কৃতির উপর, আঘাত করেছে আমাদের অর্থনীতির উপর। নির্যাতন করেছে আমার মা-বোনদের। ভিখারি করেছে বাংলার সাধারণকে। কিন্তু বাঙালি এমন এক জাতি- যারা রক্ত দিতে জানে। যে জাতি মরতে শিখে, সে জাতিকে কেউ রুখতে পারে না- শোষকগোষ্ঠী বুঝে নাই। তাই, তাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে তারা আক্রমণ করেছিল।

আজ আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি সত্য। কিন্তু তা অনেক রক্তের বিনিময়ে। এত রক্ত কোন দেশ কোন জাতি স্বাধীনতার জন্য দেয় নাই। কিন্তু এ রক্ত আমাদের বৃথা যাবে, এ স্বাধীনতা আমাদের বৃথা যাবে যদি এদেশের মানুষের মুখে আমরা হাসি ফোটাতে না পারি, যদি এদেশের মানুষকে শোষণমুক্ত করতে না পারি, শোষণমুক্ত সমাজ গঠন করতে না পারি। এবং তা যদি করতে হয়, তাহলে এদেশের মানুষকে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে হবে। আমি আশা করি, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ এবারে এ শপথই নেবে।

আমরা স্বাধীন হয়েছি। কিন্তু স্বাধীন হলেও আমরা স্বাধীনতা ভোগ করতে পারব না, যদি শোষণমুক্ত সমাজ গঠন করতে না পারি। সে জন্য জাতি, ধর্ম, দল, মত নির্বিশেষে ছাত্র, যুবক, কৃষক, শ্রমিক সকলকে অগ্রসর হতে হবে- এটাই আমরা আশা করি। এ দিনে আমাদের শপথ হবে, যে স্বাধীনতা আমরা এনেছি, যদি প্রয়োজন হয় রক্ত দিয়ে সে স্বাধীনতা রক্ষা করব। যদি প্রয়োজন হয় দেশ গড়ে তোলার জন্য আরও রক্ত দেব।

আজ প্রতিজ্ঞা করতে হবে শহীদদের রক্তের কথা মনে করে। যাঁরা মনে গেছে, যাঁরা শহীদ হয়েছে, যাঁদের মায়ের বুক খালি হয়েছে, যে বোন বিধবা হয়েছে, যে কোটি কোটি মানুষ আজ গৃহহারা হয়েছে তাঁদের কথা স্মরণ করে শপথ নিতে হবে, বাংলার মাটিতে শোষণহীন সমাজ গড়তে হবে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কায়েম করতে হবে। মানুষ যাতে আর দুঃখ, কষ্ট না পায় আর কোনদিন অত্যাচারিত, নিপীড়িত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখে আমাদের কাজে অগ্রসর হতে হবে। তাই, আমি অনুরোধ করি, বিশেষভাবে যুবসমাজ, ছাত্রসমাজ, কৃষক-শ্রমিক ভাইদের সংঘবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে।

আমরা মহাবিপদের মধ্যে আছি। আমাদের কিছুই নাই। নতুন করে সবকিছু গড়তে হবে। আসুন, আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে দেশকে গড়ে তুলি, একটি শোষণহীন সমাজ তৈরি করি।
শহীদ স্মৃতি অমর হোক। জয় বাংলা।

তথ্যসূত্র : এই দেশ এই মাটি গ্রন্থ।

এএইচ/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি