ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

সবচেয়ে বেশি সাইবার ঝুঁকিতে তরুণরা : জোহা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৮:০৯, ২৫ নভেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ২০:২০, ২৫ নভেম্বর ২০১৭

সময়ের পরিক্রমায় আমাদের জীবনযাত্রা বাস্তবের চেয়ে অনেক বেশি ভার্চুয়াল হয়ে উঠেছে। সাইবার জগতের সঙ্গে আমাদের সার্বক্ষণিক সম্পর্ক তৈরি হয়ছে। প্রযুক্তির সদ্ব্যবহারে মানুষ নানাভাবে উপকৃত হচ্ছেন। অপরদিকে কিছু মানুষের অশুভ প্রয়াসে অনেকেই নানামুখী সমস্যায়ও পড়ছেন।

ডিজিটাল যুগে সারাবিশ্বে আনুপাতিক হারে সাইবার হামলার সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। ভার্চুয়াল জগতের বহুমুখী সমস্যা তার সমাধান নিয়ে ইটিভি অনলাইনের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় অংশ নেনপোলারিস ফরেনসিক লিমিটেড প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সাইবার বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইটিভি অনলাইনের সহ সম্পাদক সোলায়মান শাওন

ইটিভি অনলাইন : শুরুতেই জানতে চাই- সাইবার ক্রাইম কী?

জোহা : সাইবার ক্রাইমের আগে বুঝতে হবে ‘সাইবার স্পেস’। ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমরা বিশাল এক নেটওয়ার্কের সঙ্গে জড়িত। এ জগটতা ঠিক ‘শুন্য’র মতো। এখানে আমরা কেউ আলাদা নই। এই সাইবার স্পেসে কম্পিউটার বা মোবাইল- যে ডিভাইস দিয়েই প্রবেশ করি না কেন, তা নিজ নিজ মানবিক সত্তাকেই প্রতিনিধিত্ব করে। এখন কেউ যদি আমার এই মানবিক সত্তালোকে অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করে তখন তাকেই সাইবার ক্রাইম বা সাইবার অপরাধ বলে। খুব সহজ করে বলি, আপনার সম্পত্তি যেমন অন্য কারো ভোগদখল করার অধিকার নেই, তেমনি ভার্চুয়াল জগতে আপনার অধিকারের ওপর যে কোনো আঘাতই সাইবার অপরাধ।

ইটিভি অনলাইন : সাইবার স্পেসে কী কী ধরনের অপরাধ হয়?

জোহা : সাইবার স্পেস বা সাইবার জগতে অনেক ধরনের অপরাধ হয়। এর মধ্যে হ্যাকিং শব্দটার সঙ্গে আমরা সবচেয়ে বেশি পরিচিত। এছাড়া তথ্য চুরি, অনুমতি ছাড়া ছবি কিংবা তথ্য ব্যবহার করে হেনস্তা করার চেষ্টা, ইমেইল বম্বিং অর্থাৎ অপ্রয়োজনীয় ইমেইল পাঠিয়ে অ্যাকাউন্ট ব্লক করে দেয়াও এক ধরনের অপরাধ। আরেক ধরনের অপরাধ আছে- সাইবার বুলিং। ব্ল্যাকমেইল তো নিত্যদিনের ঘটনা। এছাড়া পর্নোগ্রাফি সাইবার জগতের আরেকটি বড় ধরনের অপরাধ।

ইটিভি অনলাইন : এ ধরনের অপরাধ সচরাচর কেন হচ্ছে? অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে কী?

জোহা : অপরাধের সঙ্গে জড়িত কিছু ব্যক্তিকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। তবে সবাইকে আনা সম্ভব হচ্ছে না। আপনাকে মনে রাখতে হবে, সাইবার অপরাধ আদালতে প্রমাণ করা খুবই কষ্টসাধ্য। এরপরও কিছু সমস্যা আছে। যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি আইনের দোহাই দিয়ে মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলো আইন-শৃংখলা বাহিনীকে তথ্য দিতে চায় না। এছাড়া ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট ছাড়া অন্য সংস্থাগুলো এ ধরনের কাজে খুব একটা দক্ষ নয়। বিশেষ করে রাজধানীর বাইরের পুলিশ। তাদের কাছে দরকারি হার্ডওয়্যার সংশ্লিষ্ট জিনিসপত্রও থাকে না। এছাড়া অনেকেই মানসম্মানের ভয়ে কিংবা অন্য কোনো কারণে সামনে আসে না। এ কারণে অনেক অপরাধের কথা আড়ালেই থেকে যায়।

ইটিভি অনলাইন : সাইবার ক্রাইম ইস্যুতে বাংলাদেশ কতটুকু ঝুঁকিতে আছে?

জোহা : সাইবার ক্রাইম মূলত ৩ ধরনের প্ল্যাটফর্মে হয়ে থাকে। রাষ্ট্রীয় অর্থাৎ রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আঘাত, ব্যক্তিগত এবং অর্থনৈতিক বিষয় সংশ্লিষ্ট অপরাধ। এরমধ্যে ব্যক্তিগত বিষয়ের ওপরই অধিক আঘাত হয়। আর বাংলাদেশেও এ ধরনের অপরাধের ঝুঁকি বেশি।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ‘ব্যক্তিগত’ পর্যায়ের সাইবার অপরাধের পরিমাণ শতকরা ৭০ ভাগ, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তা ৬০ ভাগ। তবে আশার কথা, ২০১০ সালেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর পরিমাণ ছিল ৯০ ভাগ। অর্থাৎ সবার সহযোগিতা এবং সচেতনতায় অপরাধের সংখ্যা কমে এসেছে। এই কৃতিত্বের অন্যতম দাবিদার ঢাকা মহানগর পুলিশের ‘সাইবার ক্রাইম ইউনিট’-এর।

ইটিভি অনলাইন : সাইবার ক্রাইমের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় বিষয়াদি কতটা ঝুঁকির মধ্যে আছে? এর জন্য সরকার যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে সেগুলোকে কীভাবে দেখছেন?

জোহা : বাংলাদেশে ইতোমধ্যে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সাইবার ক্রাইম হতে দেখা গেছে। সরকারি সংস্থার বিভিন্ন ওয়েবসাইট হ্যাক হওয়া ছাড়া আরও বড় বড় কিছু বিষয়ের কথা আমরা জানি। এসব ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট সকলেই নড়েচড়ে বসে। তবে এখনো সাইবার অপরাধ মোকাবেলায় আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা অপ্রতুল। আরও বড় ধরনের কোনো আঘাত আসার আগেই পর্যাপ্ত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা উচিত। তবে একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, সাইবার জগতে শতভাগ ‘নিশ্ছিদ্র নিরাপদ ব্যবস্থা’ বলে কিছু নেই। সবধরনের পূর্ব প্রস্তুতির পরেও আঘাত হানা সম্ভব। আমাদের যে বিষয়ে প্রস্তুত হতে হবে, তা হল- এ ধরনের কোনো হামলার শিকার পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে যেন আমাদের সিদ্ধানহীনতা এবং কালক্ষেপণে ভুগতে না হয়।

ইটিভি অনলাইন : বাংলাদেশে ই-কমার্স এর বাজার খুব দ্রুত গড়ে উঠছে। আমাদের দেশে অনলাইনে টাকা লেনদেন কতটুকু নিরাপদ?

জোহা : শুধু ই-কমার্স সেক্টরেই নয়, অনলাইনে যে কোনো ধরনের আর্থিক লেনদেনে বাংলাদেশ খুবই ঝুঁকির মধ্যে আছে। বিশেষত, অনলাইন ব্যাংকিংয়ে আন্তঃ ব্যাংকিং খুবই ঝুঁকিতে আছে। যে ধরনের ‘ফায়ারওয়াল’ বা নিরাপত্তা বেষ্টনী এখন আছে, তা যথেষ্ট নয়। বিশেষ করে মোবাইল ব্যাংকিং খাতে আমরা প্রচুর ঝুঁকিতে আছি। আমরা কিন্তু মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অনেক লেনদেন করি। পুরো ব্যবস্থাটাই কিন্তু ঝুঁকির মুখে আছে। বরং আমি বলব, সব থেকে বিপজ্জনক এবং ভয়ংকর সেক্টর এটাই।

ইটিভি অনলাইন : মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে এক ধরনের ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড বা ওটিপি ব্যবহার করা হয়। সেটা?

জোহা : ওটিপি হচ্ছে আপনি যখন কোনো লেনদেনের জন্য অনুরোধ করেন, তখন আপনার মোবাইলে বা ইমেইলে একটি অস্থায়ী পাসওয়ার্ড আসে। ওই নির্দিষ্ট লেনদেনের জন্যই পাসওয়ার্ডটি প্রযোজ্য। খুব অল্প সময়ের জন্য পাসওয়ার্ডটি সচল থাকে। নিঃসন্দেহে এটি দ্বিস্তর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ভালো একটি সিস্টেম। তবে আমাদের কাছে অনেক উদাহরণ আছে, এই ব্যবস্থাটাকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে হ্যাকাররা। এর কারণ হচ্ছে, যে সার্ভার থেকে এই ওটিপি তৈরি করা হয় তা তৃতীয় পক্ষের। এ কারণে সেখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও শংকা থেকে যায়। অনেক ক্ষেত্রেই হ্যাকাররা ওই সার্ভারটিকেও হ্যাক করে থাকে।

একটা ব্যাপার খেয়াল করে থাকবেন, কোনো ব্যাংক ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডে অনলাইন লেনদেনের নিরাপত্তার দায়ভার নেয় না। অর্থাৎ অনলাইন লেনদেনে আপনার টাকা খোয়া গেলে ব্যাংক দায়ভার নিবে না। এর কারণটাও নিশ্চয়ই অনুমান করা যায় সহজেই।

ইটিভি অনলাইন : সাইবার অপরাধ মোকাবেলায় আমাদের করণীয় কী?

জোহা : আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, ওষুধ খেয়ে সুস্থ হওয়ার চেয়ে অসুখে না পরাটাই ভালো। সাইবার জগতটা খুবই বড়, আবার ছোটও। এখানে যে কোনো কিছু খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। যে কারণে অপরাধ সংঘটনের পর ব্যবস্থা নিতে নিতে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে যায়। তাই আমার পরামর্শ থাকবে সাইবার জগতে আমরা যেন সচেতনতার সঙ্গে বিচরণ করি। এ বিষয়ে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং সর্বোচ্চ সতর্কতা থাকা উচিত। প্রতিদিন আপনার অ্যাকাউন্টে কী কী কাজ হচ্ছে অর্থাৎ ‘এক্টিভিটি লগ’- এসবের দিকে নজর দিতে হবে। সন্দেহজনক কিছু পেলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। ফেসবুকের ক্ষেত্রে অনেকেই এন্টিভাইরাস ব্যবহার করি না। এটা উচিত নয়। বাজারে ক্যাসপারস্কিসহ ভালো ভালো এন্টিভাইরাস পাওয়া যায়। মোবাইলে এবং কম্পিউটারের জন্য এগুলো ব্যবহার করা উচিত।

অন্যদিকে আমরা এখন চারপাশে ‘ফ্রী ওয়াইফাই’ খুঁজি। ফ্রী ওয়াইফাইয়ের সুযোগ নিয়ে আমরা অনেক সংবেদনশীল কর্মকাণ্ড অনলাইনে করে থাকি। কিন্তু আমরা ভুলে যাই, এসব পাবলিক ওয়াইফাই আমাদের গোপনীয়তার জন্য মারাত্মক হুমকির।

আরেকটা ব্যাপার এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। আমি আগেও বলেছি, সাইবার হামলার শিকার হলে অনেকেই তা প্রকাশ করেন না। শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে নয়; প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়েও অনেকেই হামলার কথা প্রকাশ বা স্বীকার করে না। কিন্তু এ কথা স্বীকার করা উচিত। সাইবার আক্রমনের কথা স্বীকার করলে আক্রান্ত প্রতিষ্ঠানের যে দুর্বলতার কারণে ঘটনাটি ঘটেছে, অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো সেই দুর্বলতার বিষয়ে আগেভাগেই সচেতন হতে পারে।

ইটিভি অনলাইন : বাংলাদেশে সাইবার হামলার শিকার বেশি হচ্ছেন কারা? নারী নাকি পুরুষ?

জোহা : আমরা নারী-পুরুষ আলাদা করে কোনো হিসাব করি না। আমাদের হিসাব হচ্ছে বয়সে। সেদিক থেকে বললে, বাংলাদেশে ব্যক্তি পর্যায়ে সাইবার হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের ৯০ ভাগের বয়স ১৫ থেকে ৩৫ এর মধ্যে। বাকি ১০ ভাগের বয়স ৪৫ থেকে ৬০ এর মধ্যে। সেদিক থেকে তরুণ সমাজ অপেক্ষাকৃত বেশি সাইবার ঝুঁকিতে আছে।

ইটিভি অনলাইন : আক্রান্ত ব্যক্তির করণীয় কী?

জোহা : সবার আগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে নিকটস্থ থানায় বিষয়টি অবহিত করতে হবে। ঢাকার মধ্যে হলে সাইবার ক্রাইম ইউনিটের সাহায্য নিতে পারেন। এর জন্য তাদের ফেসবুক পেজের মাধ্যমে ক্রাইম ইউনিটের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। এছাড়া পুলিশের মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমেও সাহায্য পাওয়া যেতে পারে। অন্যদিকে বেসরকারি পর্যায়েও অনেক সেবা পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে ক্রাইম রিসার্চ এন্ড এনালাইসিস ফাউন্ডেশনের (ক্রাফ) সঙ্গে যোগাযোগ করে সাহায্য পাওয়া যেতে পারে।

ইটিভি অনলাইন : বিশেষ করে ফেসবুকের বিষয়ে আলোচনা করা যাক। আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ফেসবুক নির্ভর হয়ে পড়েছে। এখানে নিয়মিত সাইবার অপরাধ সংঘটিত হওয়ার কথা শুনি। বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?

জোহা : এটি আসলেই সত্যি কথা। আমরা তো এখন খাবার খাই পরে, আগে খাবারের ছবি দেই ফেসবুকে। খাবার কতটা সুস্বাদু এবং স্বাস্থ্যকর তার থেকে বেশি খেয়াল করি খাবারের ছবিটিতে কত সংখ্যক লাইক বা কমেন্ট এলো। আসলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিপ্লবের কারণেই এমনটা হয়েছে।

তবে এক্ষেত্রে আমরা অনেকেই অসচেতনভাবে সাইবার হামলার ঝুঁকিতে পরছি। আমাদের প্রতিদিনের কর্মকান্ডের ছবি ও তথ্য ফেসবুকে দিচ্ছি। এর ফলে একজন হ্যাকার বা অপরাধীর জন্য অপরাধ সংঘটন খুবই সহজ হয়ে যাচ্ছে। আমরা নিজেদের অজান্তেই ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করে থাকি। খুব ছোটখাট একটা অপরাধের কথা বলি। আপনি যে ফেসবুকে ছবি দেন, তা দিয়ে একটি ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে কোনো অনৈতিক কর্মকান্ড সংঘটিত হলে সবাই আগে আপনাকেই দোষী ভাববেন। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে করতে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে যায়।

এছাড়া ফেসবুক আইডি হ্যাক বা অন্যের দখলে চলে যাওয়াটা তো এখন সচরাচর হচ্ছে। আমাদের তরুণদের মধ্যে অনেকেই ব্যক্তিগত সংবেদনশীল ছবি বা ভিডিও ফেসবুকে আদান-প্রদান করে। তাই যখন তাদের আইডি হ্যাক হয়, তখন সমস্যা আরও গুরুতর আকার ধারণ করে। আবার হ্যাক না হলেও, আজকে যাকে বন্ধু মনে করে সংবেদনশীল ছবি বা ভিডিও আদান-প্রদান করছি, সেই বন্ধুই পরবর্তীতে সুযোগ বুঝে তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করতে পারে। 

ইটিভি অনলাইন : এজন্য আমরা কী করতে পারি?

জোহা : সাইবার জগতের ক্ষেত্রে প্রকৃতপক্ষে ‘নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা’ বলে কিছু নেই। ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গের নিজের আইডিও কিন্তু হ্যাক হয়েছিল। তবুও ফেসবুকের নিরাপত্তায় কিছু কাজ করা যেতে পারে। ফেসবুকে ‘ট্রাস্টেড কনট্যাক্ট’ নামের একটি নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে। এখানে ৫ জন ব্যক্তি, যাদের আপনি বিশ্বাস করেন তাদের নাম উল্লেখ করতে হয়। এমনটা করা থাকলে একজন অপরাধীর জন্য আইডি হ্যাক করা কষ্টসাধ্য হবে। এছাড়া শুধুমাত্র নির্দিষ্ট একটি ডিভাইস দিয়েই আপনি ফেসবুকে লগইন করতে পারবেন- এমনও কিছু ফিচার আছে ফেসবুকে। এগুলোর সুবিধা নেয়া যেতে পারে।

ইটিভি অনলাইন : শুনেছি, ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়েও নাকি আইডি হ্যাক করা যায়?

জোহা : জ্বী। আগে জাতীয় পরিচয়পত্র আইডির নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ব্যবহার করা হত। এখন অপরাধীদের অনেকেই ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে আইডি হ্যাকিংয়ের কাজে ব্যবহার করছে। এক্ষেত্রে সাধারণ কম্পিউটারে আমাদের জাতীয় পরিচয়পত্রের মতো পরিচয়পত্র  ডিজাইন করে তা প্রিন্ট বা ছাপানো হয়। তারপর সেটিকে স্ক্যান করে ফেসবুককে দেয়া হয়। এক্ষেত্রে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ তো সরেজমিনে এসে তা যাচাই করতে পারে না। তারা একে সত্য পরিচয়পত্র ভেবে নেয়। এক্ষেত্রে আইডির দখল হ্যাকারের কাছে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে এ ধরনের কাজে ১ থেকে ২ দিন সময় লাগে। এজন্য আমাদের প্রতিদিন অন্তত একবার নিজেস্ব আইডি লগইন করে দেখা উচিত যে, সেখানে সন্দেহজনক কোনো কর্মকান্ড হচ্ছে কী না।

ইটিভি অনলাইন : স্মার্টফোনের ব্যাপারে একটু আলোচনা করি। এখন আমাদের প্রায় সবার হাতে স্মার্টফোন আছে। সাইবার অপরাধে স্মার্টফোন কতটা ঝুঁকিতে আছে?

জোহা : স্মার্টফোনের মাধ্যমে হ্যাকিং হচ্ছে আরও বেশি। এমনকি এমন অপরাধও হচ্ছে যেখানে জানেনই না, আপনার স্মার্টফোনের ক্যামেরা আরেকজন ব্যবহার করছে। ফোনের মাইক্রোফোনের মাধ্যমে আপনি কাদের সঙ্গে কী কথা বলছেন, তাও দূরে বসে কেউ একজন শুনছেন। আসলে আমরা স্মার্টফোনে কিছু থার্ড পার্টি সফটওয়্যার ব্যবহার করি। এগুলোতে অনেক সময় আপনার ফোনের গ্যালারি, মেসজ, মাইক্রোফোন ইত্যাদিতে প্রবেশের অনুমতি দিয়ে সেই অ্যাপসটি ব্যবহার করতে হয়। আর সমস্যার শুরু হয় সেখান থেকেই। এছাড়া আমরা স্মার্টফোনে এন্টিভাইরাস ব্যবহার করি না। এটা একেবারেই উচিত নয়। আমরা অনেক সময় ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি এবং ভিডিও আমাদের ফোনে ধারণ করি। আবার সেটিকে ফোনে সংরক্ষণও করে রাখি। আমি বলব, সংরক্ষণ তো দূরের কথা; এসব সংবেদনশীল বিষয় মুঠোফোনে ধারণ না করাই বুদ্ধিমান এবং সচেতন ব্যক্তির কাজ।

ইটিভি অনলাইন : কখন বুঝবো, আমার মুঠোফোনের দখল অন্য কারও কাছে? এর প্রতিরোধে কী করণীয়?

জোহা : আসলে এ বিষয়টি বুঝতে পারাটা খুবই কষ্টকর। তারপরও সাধারণ একটা বিষয় খেয়াল করলে আন্দাজ পাওয়া যেতে পারে। আপনি যদি দেখেন, আপনার মুঠোফোনটি কোনো কারণ ছাড়াই গরম হয়ে যাচ্ছে এবং চার্জ শেষ হয়ে যাচ্ছে– তাহলে তা উদ্বেগের বিষয়। এ দুটো লক্ষণে নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না আপনার মুঠোফোন অন্য কারও দখলে আছে। তাই যাদের মুঠোফোন গরম হয়, তাদের আতংকিত হওয়ার কিছু নেই। তবে এটি একটি আলামত।

আর করণীয় হচ্ছে, কেউ যদি মনে করেন তার মুঠোফোনে সন্দেহজনক কর্মকান্ড হচ্ছে তাহলে সেটটি ফ্ল্যাশ করে নেয়া ভালো। এর বাইরে মুঠোফোনে হালনাগাদ করা এন্টিভাইরাস সফটওয়্যার রাখতে হবে। অবিশ্বস্ত সোর্স থেকে অ্যাপস ইন্সটল করা যাবে না।

আর অবশ্যই মুঠোফোনে প্যাটার্ন লক, কোড লক- এগুলো চালু রাখতে হবে। এখন তো অনেক সেটে ‘ফিঙ্গারপ্রিন্ট লক’ রাখার সুযোগ আছে। এগুলোকে ঝামেলা মনে না করে ব্যবহার করতে হবে।

ইটিভি অনলাইন : তাহলে কী পুরনো মডেলের ফিচার ফোনগুলোই নিরাপদ?

জোহা : স্মার্টোফোনের থেকে সেগুলো আসলেই অনেক নিরাপদ। তবে সেসব মুঠোফোনে আইন-শৃংখলা বাহিনী সহজেই আড়ি পাততে পারে। তো ঘুরেফিরে সেই গোপনীয়তার লংঘনই হয়ে গেল। আর আমাদেরকে তো প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে, তাই না? আমরা স্মার্টফোনই নিরাপদে ব্যবহার করতে পারব। যদি বুঝে ও সচেতনভাবে ব্যবহার করি, তাহলে কোনো সমস্যা নেই।

ইটিভি অনলাইন : হালের আলোচনা ‘ব্লু হোয়েল’। কেউ বলছেন বাংলাদেশে ‘ব্লু হোয়েল’ আছে, আবার কেউ বলছে এসব গুজব। সাইবার বিশেষজ্ঞ হিসেবে আপনার কাছে কী তথ্য আছে?

জোহা : যারা বলছে বাংলাদেশে ‘ব্লু হোয়েল’ প্রবেশ করেনি, তার কী বুঝে বলছে তা জানি না। তবে এসব বিষয় নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, ‘ব্লু হোয়েল’ গেমস খেলে এমন কিছু ব্যক্তির অভিজ্ঞতা আমার জানার সুযোগ হয়েছে। দেখেন, আমরা বাইরে থেকে ইন্টারনেটকে যতটুকু দেখি, তার ‘অন্ধকার’ জগতটা এর থেকেও বড়। তাই বলব, সবাই যেন এ ব্যাপারে সতর্ক থাকেন।

ইটিভি অনলাইন : সাইবার ক্রাইম এবং জঙ্গিবাদ। এ দুটোর মধ্যে যোগসাজশ কেমন?

জোহা : ইদানিং সন্ত্রাসী এবং জঙ্গিগোষ্ঠীরাও সাইবার অপরাধের সঙ্গে নিজেদেরকে যুক্ত করছে। সিরিয়ার আইএস অথবা আল-কায়েদার মতো ভয়ংকর জঙ্গিগোষ্ঠী তাদের উদ্দেশ্য সাধনের হাতিয়ার হিসেবে সাইবার জগতকে বেছে নিচ্ছে। আইএস-এর পৃথিবীব্যাপী সদস্য সংগ্রহ কার্যক্রম সাইবার জগতে হয়ে থাকে। তাদেরকে সংগঠিত করা ও তথ্য আদান-প্রদানও এর মাধ্যমে হয়। ইমেইল বম্বিং-এর মতো সাইবার অপরাধ সংঘটনেও তারা পটু। এদের নেটওয়ার্ক এতটা শক্তিশালী যে ভাঙ্গা খুবই কঠিন।

ইটিভি অনলাইন : একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকার্স এবং হোয়াইট হ্যাট হ্যাকার্স-এদের মধ্যে পার্থক্য কী?

জোহা : হ্যাকার তো হ্যাকারই। এদের মধ্যে আসলে কোনো পার্থক্য নেই। তারপরেও উদ্দেশ্যর ওপর ভিত্তি করে এদের দুই বিভাগে ভাগ করা হয়েছে। ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকার বলতে সেসব হ্যাকারদের বোঝায়, যারা অবৈধ এবং অনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে হ্যাকিং করে। অন্যদিকে হোয়াইট হ্যাট হ্যাকার্সরা শুধুমাত্র কৌতুহলবশত হ্যাকিং করে থাকে।

একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝালে সহজ হবে। কোনো একটি ব্যাংকের সিস্টেমে হ্যাকিং করে গ্রাহকদের টাকা হাতিয়ে নিল একজন হ্যাকার। এক্ষেত্রে তাদের ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকার বলা হবে। অন্যদিকে একটি পর্নোসাইটে ভালো এক ব্যক্তির ছবি অনুমতি ছাড়াই প্রকাশিত হল। এ ছবিটিকে সাইট থেকে মুছে ফেলার জন্য তাদের সিস্টেমে হ্যাকিং করল কোনো হ্যাকার। এ ক্ষেত্রে ওই হ্যাকারকে হোয়াইট হ্যাট হ্যাকার বলা হবে।

আরেক ধরনের হ্যাকিং পদ্ধতি রয়েছে। এথিক্যাল হ্যাকিং। কোনো একটি ভালো উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে এটা করে থাকে। অনেক দেশে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন কাজের জন্য সরকারিভাবেই এথিক্যাল হ্যাকিংয়ের কাজ করানো হয়।

ইটিভি অনলাইন : আমাদের দেশে অনেক মেধাবী কম্পিউটার প্রকৌশলী আছেন। এদের অনেকেই সুযোগের অভাবে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন অথবা হ্যাকিংয়ে জড়িয়ে পড়ছেন। তবে অনেক দেশেই এমন প্রতিভাবানদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হয়। আমাদের দেশে এমন কোনো সুযোগ আছে কী না?

জোহা : আসলে হ্যাকিং যে উদ্দেশ্যেই করা হোক না কেন, তা অবৈধ। তবে এটাও ঠিক, হ্যাকিং প্রতিরোধ সম্ভব হ্যাকার দিয়েই। অনেকটা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো। এটা ঠিক যে, অনেক দেশেই রাষ্ট্রীয়ভাবে হ্যাকারদের পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়। রাষ্ট্রীয় সাইবার কর্মকান্ডে হ্যাকারদের সম্পৃক্ত করা হয়। গুগল, ফেসবুকের মতো নামিদামি প্রতিষ্ঠানগুলো হ্যাকারদের নিয়ে মাঝে মাঝেই বিভিন্ন কর্মকান্ড করে থাকে। তবে তারা এথিক্যাল হ্যাকার। আমাদের দেশে এ প্রচলনটা এখনও সেভাবে চালু হয়নি। তবে কিছু সংস্থা এখন তাদের নিয়ে কাজ করছে। অনেকেই আবার সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার আওতায় আসতে চান না। তবে তাদের জন্যও বন্ধুসুলভ পরিবেশ তৈরির কাজ চলছে। 

ইটিভি অনলাইন : সাধারণ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের জন্য আপনার কোনো পরামর্শ আছে কী?

জোহা : ইন্টারনেট অবশ্যই আমাদের দরকার। তবে সাধারণভাবে আমরা ইন্টারনেট সম্পর্কে যতটুকু দেখি বা জানি বাস্তবে এর চিত্র আরও ভয়াবহ। ইন্টারনেটের ‘অন্ধকার’ জগতটা আমাদের ধারণার চেয়েও বড়। প্রতিটি জিনিসের যেমন ভাল আর মন্দ আছে, ইন্টারনেটেরও তেমনি আছে। তাই ইন্টারনেট ব্যবহারে সতর্ক হোন, সচেতন হোন। আর যতটুকু প্রয়োজন আমরা যেন ততটুকুই ইন্টারনেট ব্যবহার করি। ততটুকু সময়ই যেন এর পেছনে ব্যয় করি। আমাদের উচিত অবসর সময়টুকু পরিবার-পরিজনদের দেয়া। আমরা আসলে বাস্তবিক জীবনে একাকী থাকলেই ইন্টারনেটের দিকে ঝুঁকে যাই। তাই আমাদের উচিত পরিবার-স্বজনকে পর্যাপ্ত সময় দেয়া। এতে করে যেমন সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হবে, তেমনি সামাজিক অবক্ষয়ও কমবে।

/ডিডি/ এআর

 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি