ঢাকা, সোমবার   ২৯ এপ্রিল ২০২৪

সাংবাদিকতা ও নারী

স্মৃতি মণ্ডল

প্রকাশিত : ১৩:৫৯, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | আপডেট: ১৫:৫৭, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩

নারীর চলার পথ কখনই মসৃণ নয়। ঘরে-বাইরে বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে এগিয়ে চলার জন্যই যেনো জন্ম নারীর।  সেখানে একজন নারী পেশা হিসেবে যদি বেছে নেন সাংবাদিকতা; সেই নারীর চ্যালেঞ্জ কয়েকগুণ। সাংবাদিকতা পেশায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে তবে এখনও নগন্য।

সাংবাদিকতা নয়টা-পাঁচটার চাকরি নয়। পারিবারিক জীবন বিসর্জন দিতে হয় একথা পুরোপুরি মিথ্যে নয়। এখানে খবরের পেছনে ছুটতে হয় যেখানে টাইমফ্রেম বলে কিছু থাকেনা। সাংবাদিকতায় নিজের এমনকি অনেক সময় পরিবারকেও ঝুঁকির মধ্যে ফেলে কাঙ্খিত সংবাদ তুলে আনতে হয়। চাকরির নিরাপত্তা নেই বললেই চলে। কম বেতন একইসাথে বেতন বৈষম্য প্রকট; মাস শেষে বেতন না পাওয়ার রেকর্ড রয়েছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এবং টেলিভিশনে। এমন নানা সমস্যার ভিড়ে টিকে আছে সাংবাদিকতা; আর নারীরাও পিছিয়ে নেই। সবকিছু জেনেবুঝেই এই পেশায় আসছেন নারীরা।

একজন মেয়ে যখন সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় সেই পথে প্রায়শই বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় পরিবার, সমাজ। পড়াশোনা শেষে ক্যারিয়ার গড়ার অনেক মাধ্যম থেকে পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকে বেছে নিতে দিতে নারাজ অনেক পরিবার। সাংবাদিকতা মানেই তাদের কাছে একটি ভীতিকর, নিরাপত্তাহীন পেশা যা মেয়েদের জন্য নয় এমনটাই ভাবা হয়। 

আমাদের সমাজ আজও একটি মেয়ে যখন কাজ শেষে মধ্যরাতে কিংবা ভোরে বাড়ি ফিরছে এটিকে সহজভাবে নিতে শেখেনি। কটূক্তি করতে তারা পিছপা হয়না; সুযোগ পেলেই ইনিয়ে বিনিয়ে মেয়েটি ও তার পরিবারকে কথা শুনানোর চেষ্টা করে।  

মেয়ে সাংবাদিক, এমন পরিচয়ে বিয়ে দিতে গিয়েও পরিবারকে নাজেহাল হতে হয়। শিক্ষকতা বা নিয়মে বাঁধা চাকরি না করে কেনো সাংবাদিকতা? এমন প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়া হয়। সাংবাদিকতায় নিরাপত্তা নেই, ভালো বেতন নেই, পেনশন সুবিধা নেই, সময় অসময় অফিস, ঝুঁকিপূর্ণ নানা কারণ দেখিয়ে সাংবাদিক হয়ে উঠার স্বপ্নকে ভুল প্রমাণিত করতে চেষ্টার কমতি থাকেনা।

এতো গেলো সমাজের কথা; মেয়েটি যে অফিসে কাজ করে সাংবাদিক হবে বলে সেখানেও তার চ্যালেঞ্জ কম নয়। পুরুষশাসিত সমাজে নিউজ স্টেশনগুলোতে নেই নারী বান্ধব পরিবেশ। নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে নারী নেই বললেই চলে। পুরুষ সহকর্মীর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থাকতে প্রতিদিন যেনো নতুন নতুন পরীক্ষা। নারী হিসেবে অনেক ক্ষেত্রেই বাদ দেয়া হয় গুরুত্বপূর্ণ এসাইনমেন্ট থেকে; ঢাকার বাইরে কাজ করতে না দেয়ারও প্রবণতা দেখা যায়। পিরিয়ডকালীন সময়েও নারীর কাজ থেমে থাকেনা; কিন্তু অফিসগুলোতে সেই বিষয়টি মাথায় রেখে নেই কোনধরণের ব্যবস্থাপনা। 

কর্মক্ষেত্রে নানাভাবে হয়রানির শীকার নারীরা; সহকর্মী এমনকি অনেক সময় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দ্বারা হয়রানি সহ্য করতে হয়।  বিবাহিত নারী যারা সাংবাদিকতায় আছেন তাদের চ্যালেঞ্জ আরও অধিক। শ্বশুরবাড়ি, সন্তান সবকিছু সামলে এমন এক পেশায় দায়িত্ব পালন কতখানি কঠিন সে শুধু তারাই জানেন। অফিসগুলোতে নেই ডে কেয়ার ব্যবস্থা। মানসিক অস্থিরতা তাদের নিত্যসঙ্গী। এত সবকিছুর ভিড়ে সাংবাদিকতায় নারী এগিয়ে যাচ্ছে অদম্য গতিতে।

সাংবাদিকতায় বিট এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলা যায়। যদিও একজন সাংবাদিক সবধরণের খবরের কারিগর হিসেবে প্রস্তুত। গুরুত্বপূর্ণ বিটগুলোতে নারীদের প্রাধান্য দেয়া হয়না। যদিও নারীরা নিজ কর্মদক্ষতায় বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী বিট থেকে শুরু করে অপরাধ, আদালত, পররাষ্ট্র, নির্বাচন কমিশনসহ গুরুত্বপূর্ণ বিটগুলোতে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করছে। কিন্তু সংখ্যায় বেশি নয়। বিটে দায়িত্ব পালন নিয়েও অফিস পলিটিক্সের বলি হতে হয়।

প্রতিবন্ধকতাকে পদদলিত করেই নারীর এগিয়ে চলা; সাংবাদিকতায় নারীর সাফল্য কোন অংশে কম নয়। পরিবার, সমাজের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে নারীরা বেছে নিচ্ছে সাংবাদিকতাকে। সাংবাদিকতায় পড়াশুনা না করেও পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে সাফল্যের স্বাক্ষর রাখছেন নারীরা। সাংবাদিকতা একটি বোধের নাম, যেখানে খবরের ভেতর থেকে খবর বের করে আনার জন্য প্রয়োজন হয় প্রখর অনুভূতি, তীক্ষ্ম দৃষ্টি, তুখোড় চিন্তাশক্তি নিরলস শ্রম আর অধ্যাবসায়। সাংবাদিকতা সততা ধরে রাখার ক্ষেত্রে নারীরা এগিয়ে; তারা নত হতে জানে না; বিবেক বিসর্জন না দিয়ে নিজের কাজটুকু শতভাগ সততার সাথে সম্পন্ন করার ব্রত নিয়ে দায়িত্ব পালন করে। পরিবারের প্রতিটি সদস্যের যেভাবে যত্ন নিতে জানে নারীরা ঠিক তেমনি প্রতিটি সংবাদের পেছনে থাকে তাদের মমতা আর যত্নের ছাঁপ। কিভাবে সমন্বয় করে কাজ করতে হয় এবং তা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ সেটি নারী তার কাজের মধ্য দিয়েই প্রমাণ করে যাচ্ছে।

সাংবাদিকতায় নারী কত শতাংশ সেই পরিসংখ্যান স্পষ্ট নয়। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে তরুণদের মধ্যে অনেকেই ঝুঁকছেন এই পেশায় বিপরীতে কর্মক্ষেত্রের নানা জটিলতায় এই পেশা থেকে ঝড়েও পরছেন অনেক নারী। পরিস্থিতি বদলাতে সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় বেশিসংখ্যক নারী থাকা বাঞ্ছনীয়। কর্মক্ষেত্রে নারীবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে এবং সাংবাদিকতায় নারীর নিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। নারী-পুরুষকে সমানভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। যোগ্যতার ভিত্তিতে কাজের সুযোগ ও প্রমোশন দিতে হবে। হয়রানির ঘটনা বন্ধে তৎপর হতে হবে অফিসগুলোকে। সাংবাদিকতায় নারীর অংশগ্রহণ নিয়ে পরিবার ও সমাজের সংর্কীণ মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। 

বর্তমান প্রেসক্লাব সভাপতি একজন নারী; যা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গৌরবের। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন গণমাধ্যমে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে; যা আশার আলো ছড়াচ্ছে। পত্রিকা সম্পাদনা থেকে শুরু করে চিফ রিপোর্টারের দায়িত্ব পালন করছেন নারীরা। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পুরুস্কার ও সম্মান বয়ে আনছেন নারীরা। 

সাংবাদিকের পরিচয় কখনও আলাদা করে পুরুষ কিংবা নারী হতে পারেনা। নারী সাংবাদিক নয় ‘সাংবাদিক’ হিসেবেই এই পেশায় নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হউক। তবে বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে এগিয়ে চলা নারীর জন্য সেই পথ কন্টকমুক্ত করার দায়িত্ব সকলের। সাংবাদিকতায় নারীর অবস্থা ও অবস্থান কি? কেমন এবং কেন? এই প্রশ্নগুলো অনুধাবন করতে হবে নীতি নির্ধারকদের।

এএইচ


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


টেলিফোন: +৮৮ ০২ ৫৫০১৪৩১৬-২৫

ফ্যক্স :

ইমেল: etvonline@ekushey-tv.com

Webmail

জাহাঙ্গীর টাওয়ার, (৭ম তলা), ১০, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

এস. আলম গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান

© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি