ঢাকা, শুক্রবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

হারিয়ে যাচ্ছে শীতের পিঠা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৫:১৭, ১৮ জানুয়ারি ২০২৩

Ekushey Television Ltd.

ভোজনরসিক বাঙালির চিরোচেনা ঐতিহ্য শীতের পিঠা। এক সময় হেমন্তের পাকা ধান কৃষক ঘরে তুলতেই ধুম পড়ে যেত পিঠা বানানোর। খেজুরের রস, গুড়, চালের গুড়ার মিশ্রণের মৌ মৌ ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ত পাড়াজুড়ে। কিন্তু কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী গ্রাম বাংলার বাহারি পিঠার সেই আয়োজন। গ্রামের গৃহিণীদের মধ্যে আগের মত পিঠা বানাননোর সেই উৎসব নেই। হরেক রকমের পিঠ আমাদের নতুন প্রজন্ম থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। পিঠার সেই ঐতিহ্য এখন অনেকটা স্মৃতি হয়ে গেছে।

অথচ ঐতিহ্যবাহী শীতের বাহারি পিঠা খাওয়ার রীতি বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতির অংশ। একসময় পাড়া, মহল্লায় ছোট-বড় সকলেই পিঠা খাওয়ার আনন্দে মেতে উঠতেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রা, বদলে যাচ্ছে রুচি। হারিয়ে যাচ্ছে পিঠা তৈরির সেইসব উৎসবমুখর আমেজ। 

এক সময় শীত আসলেই নতুন ধানের নতুন পিঠা, পোলাও, পায়েস, ক্ষীর এবং রকমারি খাবার তৈরি করা হতো কৃষকের ঘরে ঘরে। প্রতিটি পাড়া-মহল্লা এবং বাড়ি বাড়ি নতুন চাল রান্নার মৌ মৌ ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ত, খেতেও লাগত বেশ। ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসব উপলক্ষে গ্রামগঞ্জের কৃষক পরিবারের ঝি-জামাই এবং আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত করে নতুন চালের বিভিন্ন রকমের পিঠা তৈরি করে ভূরিভোজের আয়োজন করা হতো। তারাও নবান্ন উৎসবের দাওয়াত পাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন।

শীতের সাথে পিঠার যোগসূত্র 
পিঠা নিত্যদিনের খাবার না হলেও শীতকালে বাঙালির ঘরে ঘরে ব্যাপক কদর রয়েছে। উৎসব আয়োজনে পিঠা নামের বাড়তি খাবার তৈরি করা হয়। আগে শীতের শুরুতেই দাদী-নানী, মা, খালারা পরম মমতায় তৈরি করতো বিভিন্ন ধরনের রসালো পিঠা। সে সময় সন্ধ্যা হলেই গ্রামে চাল গুঁড়া করার শব্দে মুখরিত হতো চারদিক। রাতভর চলতো পিঠা তৈরির কাজ। অনেকে আবার পিঠা তৈরির সময় গীত গেয়ে রাত পার করতেন। পিঠার অন্যতম উপাদান চালের গুঁড়ো হলেও এর সঙ্গে লাগে গুড়, ক্ষীরসহ নানা উপকরণ। এ উপকরণের সঙ্গে শীতের একটা যোগসূত্র আছে। তাই হেমন্ত থেকে শীতকাল পর্যন্ত পিঠা তৈরির ধুম পড়ে।

শীতের আদুরে রোদে উঠোনের এক কোণে দুই-তিনজনের গল্পে গল্পে নারকেল কুড়ানো, কুয়াশা চাদর ভোরে জোগাড় করা খেজুর রস, সেই নতুন রসের থেকে তৈরি পাটালি গুড় আর খাঁটি ঘন দুধ, তেল ইত্যাদি সব উপকরণে তৈরি হয় মনকাড়া, নজরকাড়া অমৃত স্বাদের পিঠা।

বেশিরভাগ পিঠা মিষ্টি হলেও স্বাদ কিন্তু একরকম নয়। এদের কোনটা রেখে কোনটা বেশি মজাদার তা বলা কঠিন। বলতে পারেন পিঠা পুলিও যেন তাদের নিজেদের মধ্যে স্বাদের প্রতিযোগিতা করে। শুধু স্বাদই নয়, নামেও এদের বিশেষত্ব রয়েছে। যেমন- গরম ভাপে তৈরি ভাপা পিঠা, সুন্দর নকশা আঁকা হয় বলে নকশী পিঠা, দুধে ভিজে চিতই হয় দুধ চিতই, লবঙ্গের ঘ্রানে সাজে লবঙ্গ লতিকা, মুঠ পাকিয়ে সেদ্ধ দিলেই মুঠোপিঠা। আবার গোলাপ ফুলের আকারে হল গোলাপ পিঠা। এছাড়াও মুখে রোচে পাটিসাপটা, কুলি, দুধ কুলি, চিতই, বিয়ের বিশেষ বিবিয়ানা, মেরা পিঠাসহ আরও কত কী?

পিঠার যত পদ
বাংলাদেশে কত রকম পিঠা হয় তা বলে শেষ করা কঠিন। তবে এর মধ্যে- সবজি কুলি, পুলি পিঠা, তারা পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা, নারু পিঠা, পায়েস পিঠা, সুজি পিঠা, সেমাই পিঠা, ভাঁপা পিঠা, নৌকা পিঠা, পয়সা পিঠা, নুডুলস পিঠা, কাঁটা পিঠা, ম্যারা পিঠা, বেনী পিঠা, তালের পিঠা, ক্লিপ পিঠা, কলা পিঠা, শামুক পিঠা, ফুলকপি পিঠা, আঙ্গুরী পিঠা, চপ পিঠা, গজা পিঠা, টক পিঠা, বৈশাখী পিঠা, সেমায় বরফি, পাক্কন পিঠা, চিতই পিঠা, স্পেশাল নক্সা পিঠা, ডোনাট পিঠা, শিমফুল পিঠা, নকশি পিঠা (ঝাল), ঝুড়ি পিঠা, নকশি পিঠা (মিষ্টি), গোলাপ ফুল পিঠা, মসলা পিঠা, বস্তা পিঠা, তেজপাতা পিঠা, লবঙ্গ পিঠা, পাকান পিঠা, পাকড়া পিঠা, তেলে ভাজা পিঠা, ডিমের ঝাল পিঠা, দুধ চিতই পিঠা, ঝাল মসলা পিঠা, দুধ পুলি পিঠা, চকলেট পিঠা, সংসারী পিঠা, বিস্কিট পিঠা, পুলি পিঠা (ভাঁপা) ও মালাই পিঠা ইত্যাদি অন্যতম।

পিঠাপুলি ও শহুরে বাঙালির উৎসব
বর্তমানে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পিঠার দেশীয় ঐতিহ্যের স্বকীয়তা ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে। আয়োজন করা হচ্ছে পিঠা মেলার। তাছাড়া চিত্র বদলেছে, শহরবাসীর পিঠার চাহিদা মেটাতে অলিতে গলিতে, রাস্তার মোড়ে, বাসস্ট্যান্ড ও বাজারে বসেছে ছোট ছোট পিঠার দোকান।

তবে খাঁটি গ্রামে এখনও পিঠা ধরে রাখছে আত্মীয়তার বন্ধন। আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি পিঠা পাঠানোর রীতি এখনও কোথাও কোথাও পালন করা হয়।

ব্যস্ত জীবনে শহরের ইট-কাঠের খাঁচায় পিঠার দৃশ্য কম হলেও গ্রামের মেঠোপথ ধরে ঝাপসা কুয়াশায় এখনও কোন কোন গ্রামে পাওয়া যায় খেজুরের রস। সূর্যের কোমল মিষ্টি রোদের হাসিতে তারাও মেতে ওঠে শীতের আমেজে।
এসএ/


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি