ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪

১৫ আগস্ট: বাঙালির শোকগাঁথা মহাকাব্য

ড. রকিবুল হাসান

প্রকাশিত : ০৯:৪৯, ১৫ আগস্ট ২০২০

১. হাজার বছরের বাঙালির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের উপর যিনি স্থাপন করেছিলেন রাজনৈতিক স্বাধীনতার জয় তিলক, পৃথিবীর মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ, অনেক প্রতিকূলতাকে প্রতিরোধ করে যিনি হাতে নিয়েছিলেন বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির অমলিন কর্মসূচি, ঠিক তখনই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সুপরিকল্পিত মদদে সামরিক বাহিনীর কিছু পথভ্রষ্ট কর্মকর্তা সপরিবারে হত্যা করে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। দিনটি ছিল ১৯৭৫ সালের পনেরই আগস্ট।

এই হত্যাকাণ্ডের মধ্যদিয়ে ঘাতকেরা দেশের স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো ধ্বংস করতে চেয়েছিল, নেতৃত্বশূন্য করতে চেয়েছিল দেশকে। পুরো বাঙালি জাতি তখন নিপতিত হয় এক গভীর শোক সাগরে। এরপর দেশে নেমে আসে চরম অমানিশা। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা শোককে শক্তিতে পরিণত করে নিজেকে বাংলাদেশের কাণ্ডারি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তার সুযোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।

২. বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রায় একুশ বছর স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তির ধারা দেশকে চরম অস্থিরতার দিকে নিয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার মৌল স্তম্ভগুলো সংবিধান থেকে অপসৃত হয়। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সাংবিধানিক সমুন্নতি নির্বাসনে যায়। 

একটা বিরাট প্রজন্মকে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বিভ্রান্ত ও বিদ্রুপের কুজ্ঝটিকায় নিমজ্জিত হয়। কিন্তু এদেশের সচেতন মানুষ তা বেশি দিন চলতে দেয়নি। বঙ্গবন্ধু এই স্বাধীন দেশে আবার ফিরে এসেছেন, অধিক শক্তিশালী হয়ে। স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে শারীরিকভাবে হত্যা করা গেলেও, একটি জাতির চিন্তা চেতনা আদর্শ থেকে কখনোই তাকে হত্যা করা সম্ভব নয়। বরং অন্তর্লোকের মুজিব ১৬ কোটি মানুষের জীবনে এখন আরও বেশি শক্তিশালী। 

শেখ মুজিব হঠাৎ আবির্ভূত কোনো নেতা ছিলেন না। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ইতিহাসের সোপান বেয়ে বাঙালির ভালোবাসা থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়েছিলেন। ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দিয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বেশি স্নেহধন্য এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের আর এক সূর্য সৈনিক তোফায়েল আহমেদ। 

৩. বঙ্গবন্ধু তার সারা জীবন অন্যায় ও অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। তিনি কখনোই তার প্রতিবাদী চেতনা থেকে সরে আসেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারিদের ন্যায় সঙ্গত অধিকার আদায়ের জন্য ছাত্রত্ব হারিয়েছেন, জীবনভর অসংখ্যবার কারাবরণ করেছেন, পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী তাকে বন্দি করে নিয়ে গিয়ে তার সামনে কবর খুঁড়ে ভয় দেখিয়েছে কিন্তু তিনি কোনো অবস্থায়ই কারো সাথেই আপস করেনি। আপস করেননি নিজের জীবন বিপন্ন হবার সমূহ সম্ভাবনার সামনেও। অটুট থেকেছেন মানুষের ন্যায় সঙ্গত  অধিকার আদায় আর বাঙালি জাতিকে মুক্তি দেবার ঐকান্তিক প্রত্যয়ে।

বাঙালি জাতির মধ্যে কৃতিবান মহৎ মানুষ অনেকেই আছেন, স্ব স্ব ক্ষেত্রে তাদের অবদানও অসামান্য সন্দেহ নেই; কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া আর কেউই বাঙালিকে প্রকৃত অর্থে হাজার বছরের গোলামি ও পরাধীনতা থেকে মুক্ত করতে পারেননি। আর এই জন্যই শেখ মুজিবুর রহমান আজ শুধু ‘পোয়েট অফ পলিটিক্সইই নন, ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’।

৪. ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে দেখে তার কাছে এগিয়ে এসেছিলেন কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো। বঙ্গবন্ধু তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলে, তিনি তা উপেক্ষা করে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। 

ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি কিন্তু আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। তার ব্যক্তিত্ব ও সাহসের একমাত্র তুলনা চলে হিমালয়ের সঙ্গে। তাকে দেখেই আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা পেয়েছি।’ 

বিশ্বনন্দিত নেতা ইয়াসির আরাফাত বলেছিলেন, ‘আপসহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব আর কুসুম কোমল হৃদয় ছিল মুজিব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।’ বঙ্গবন্ধুর আন্দোলন-সংগ্রাম মহাত্মা গান্ধী কিংবা মার্টিন লুথার কিংয়ের মতো ধীরস্থির দীর্ঘধারার আন্দোলন ছিল না। তার আন্দোলন ছিল পাকিস্তনি রাষ্ট্রকাঠামো এবং শাসনের বিরুদ্ধে রক্ত কম্পিত দুর্বার গতিতে অধিকার আদায়ের আন্দোলন, স্বাধীন সার্বভৗম বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্রের জন্য আন্দোলন। বঙ্গবন্ধুই বিশ্বে একমাত্র নেতা যিনি স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগেই গণ-মানুষের কাছে স্বাধীনতার নেতা হয়ে বিশ্বমঞ্চে বিশ্বের বিস্ময় হয়ে উঠেছিলেন।

৫. বঙ্গবন্ধু নিজের জীবনের সমস্ত সাধনা, আরাধনা, পরিশ্রম, প্রতিজ্ঞা, আত্মদান আর আত্মত্যাগ দিয়ে রাজনীতি করেছেন। দেশের মানুষের সঙ্গে তিনি কখনো প্রবঞ্চনা করেননি। ১৯৪৭ সালে বঙ্গবন্ধু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শরৎচন্দ্র বসুর সঙ্গে স্বাধীন বৃহত্তর বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্যে আন্দোলন করেন। কিন্তু এ আন্দোলন ব্যর্থ হলে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৪৮-এ ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এবং গ্রেফতার হন।

১৯৪৮ সালের ৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মধ্যেই স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়। মূলত ভাষা আন্দোলনই বাঙালিকে মুক্তির দিশা দেখিয়েছিল। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষিতেই রাজনৈতিক দল ও নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে বিশেষ করে শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ২১ দফার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট। এই ২১ দফার ভিত্তিতেই যুক্তফ্রন্ট মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট অভূতপূর্ব বিজয় লাভ করেছিল।

৬. ১৯৭০ সালের জুন মাসে বঙ্গবন্ধু ঢাকার ভারপ্রাপ্ত মার্কিন কনসাল এ্যান্ডু কিলগোরকে বলেছিলেন, ‘আমি স্বাধীনতা ঘোষণা করব। সেনাবাহিনী বাধা দিলে শুরু করবো গেরিলা যুদ্ধ।’ 

বাংলার মানুষ তখন জেগে উঠেছে। আওয়ামী লীগের ছয় দফা তখন ব্যাপক জনপ্রিয়। ছয় দফা ছিল আপামর জনগণের প্রাণের দাবি-বাঁচার দাবি। এই দফাসমূহে সন্নিবেশিত হয় বাঙালি জাতির ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক দিক-নির্দেশনা। বঙ্গবন্ধুর প্রাণপণ চেষ্টায় এই ছয় দফা সারাদেশের মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে একচেটিয়া বিজয় লাভ করে। কিন্তু ক্ষমতা ছাড়েনি পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী 

৭. ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধু যখন বন্দি, তাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর চেষ্টা চলছিল, তার সেলের পাশে কবর খোঁড়া হয়েছিল। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না। আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার দেশ, আমাকে ফাঁসি দিও দুঃখ নাই, শুধু আমার লাশ বাংলার মাটিতে পৌঁছে দিও।’

নিষ্ঠুর বাস্তবতা হলো, পশ্চিম পাকিস্তানের স্বৈর দানবেরা যা পারেনি, তাই পেরেছে এদেশের মানুষ। যে দেশের মানুষকে তিনি খুব বেশি ভালোবাসতেন।

বিদেশি সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনার সবচেয়ে বড় গুণ কী?’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এই দেশের মানুষকে আমি খুব ভালোবাসি’। বিদেশি সাংবাদিক আবার তাকে প্রশ্ন করেন ‘আপনার সবচেয়ে বড় দোষ কী?’ বঙ্গবন্ধু এবার বলেন, ‘আমি এই দেশের মানুষকে খুব বেশি ভালোবাসি’। এই দেশের মানুষের জন্য তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করে রেখেছিলেন। দেশের জন্য মরতে সবসময় প্রস্তুত ছিলেন তিনি। দেশের মানুষের হাতেই সপরিবারে হত্যা হতে হলো স্বাধীনতার মহান এই স্থপতিকে।

৮. ‘বাংলাদেশ’ নামটিও বঙ্গবন্ধুর দেয়া। বঙ্গবন্ধু ১৯৬৯-এর ৫ ডিসেম্বর ‘বাংলাদেশ’ নাম ঘোষণা করেছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুদিবসে আলোচনা সভায় তিনি বলেছিলেন, ‘আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম হইবে পূর্ব পাকিস্তানের বদলে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’।

৯. বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কথা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের জন্য যখন বঙ্গবন্ধু বাসা থেকে বেরুবেন, তখন বেগম মুজিব বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘নিজের বিবেকের কথা বলবা।’ প্রধানমন্ত্রী হতে নিষেধ করেছিলেন। কারণ প্রধানমন্ত্রী হলে সাধারণ মানুষ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে থাকবে না। বঙ্গবন্ধুর শুধু ব্যক্তি জীবনই নয়, রাজনৈতিক জীবনেও অসামান্য ভূমিকা রেখেছিলেন মহীয়সী এই নারী। 

বঙ্গবন্ধু নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য। আর বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা নিজেকে উৎসর্গ করে রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্য। শেখ মুজিবের ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে বঙ্গমাতার অসামান্য অবদান।
 
১০. বর্তমান সরকার বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ নিয়ে চলছে। ‘ভিশন ২০২১’ বাস্তবায়নে কাজ করছে। উন্নয়নের রোডম্যাপে বাংলাদেশের আপামর জনতা যুক্ত হয়ে গেছে। যে চেতনার মধ্যদিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে, সেই সোনার বাংলা গড়তে সরকার সর্বস্তরে কাজ করছে। ইতিমধ্যেই এদেশের প্রযুক্তিমুখী নবপ্রজন্ম ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের আখ্যা গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছে। করোনার ভয়বহকালে সে সুবিধা গোটা দেশই পাচ্ছে।

শিক্ষা ব্যবসা ও বাণিজ্য বহুমুখী কর্মকাণ্ড বর্তমানে ডিজিটাল পদ্ধতিতে পরিচালিত হচ্ছে। সাবলীলভাবেই বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ‘উন্নয়নের রোল মডেল’। সমুদ্রসীমা জয় থেকে শুরু করে, মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উড্ডয়ন, নিরাপত্তা ও কর্মমুখী উন্নয়নের স্রোতধারায় যুক্ত করা হয়েছে উচ্চশিক্ষাকে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে কাজ চলছে। সারা দেশে উচ্চশিক্ষার যে চমৎকার পরিবেশ বিদ্যমান রয়েছে, তা অচিরেই আমাদের দেশকে বহির্বিশ্বে আরও দায়িত্বশীল ও উন্নত আসনে অধিকৃত করবে। 

১৯৭৫ সালের পনেরই আগস্ট বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে করুণ মৃত্যু পৃথিবীর সব বাঙালির হৃদয়ে বেদনার মহাকাব্য হয়ে ওঠে। তার অশ্রুধারা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা হাজার নদীর অববাহিকা হয়ে চিরকাল প্রবাহমান হয়ে থাকবে। এই শোককে শক্তি করেই বাঙালি আজ বিশ্বের বিস্ময় হয়ে বিশ্বদরবারে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পেরেছে। আর বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছেন বিশ্বমঞ্চে চিরকালের বিস্ময়।

লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক। বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ

এআই//এমবি


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি