ঢাকা, শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪

১৫ এবং ২১ অগাস্টের রূপকার এক ও অভিন্ন!

সাব্বির খান

প্রকাশিত : ১২:৫৬, ২৪ আগস্ট ২০২০

সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে, ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলার ‘পেপারবুক’ সরকারী ছাপাখানা (বিজিপ্রেস) থেকে প্রস্তুত হয়ে হাইকোর্টে পৌঁছেছে। একটা মামলার যাবতীয় নথি, অর্থাৎ নিম্ন আদালতের রায়, সাক্ষীদের সাক্ষ্য, জেরা, আসামীর জবানবন্দিসহ যাবতীয় নথিপত্রগুলোকে বই আকারে একত্রে বাঁধাই করা নথিকে ‘পেপারবুক’ বলে। ২১ অগাস্টের গ্রেনেড হামলার পর ‘হত্যা’ এবং ‘বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে’ দুইটি মামলা করা হইয়েছিল, যার রায় দেওয়া হয়েছিল ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর এবং রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের সাজা অনুমোদনের জন্য দুইটি মামলায় ৩৭ হাজার ৩৮৫ পৃষ্ঠার রায়ের কপি (ডেথ রেফারেন্স) ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর হাইকোর্টে পাঠানো হয়েছিল। 

রায়ের বিরুদ্ধে আসামীরা উচ্চ আদালতের স্মরণাপন্ন হলে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন ‘পেপারবুক’ প্রস্তুত করার নির্দেশ দেন। নিয়মানুযায়ী মামলার ‘পেপারবুক’ প্রস্তুত না হলে উচ্চ আদালতে শুনানি হতে পারে না। দীর্ঘদিন পর এই ‘পেপারবুক’ প্রস্তুত হওয়ায় উচ্চ আদালতে আসামীদের আপিলের শুনানিতে আর কোন বাঁধা রইলো না।

২১ অগাস্টের গ্রেনেড হামলা মামলায় জামায়াত-বিএনপি জোট সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, ডিজিএফআই এর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, এনএসআই মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার (অব.) আবদুর রহিমসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, সাবেক সাংসদ কায়কোবাদসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেওয়া হয়েছিল। প্রায় ১০ বছর রাজধানীর নাজিমুদ্দিন রোডে পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে স্থাপিত ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার আদালতের কার্যক্রম শেষে এ রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে নৃশংস এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার কার্যক্রম শেষ হয়েছিল।

২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে যে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা হয়েছিল, তার প্রধান লক্ষ্য ছিল তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা, যারা সেদিন অল্পের জন্য বেঁচে গেলেও আইভি রহমানসহ আওয়ামী লীগের ২২ নেতা-কর্মী নিহত হয়েছিলেন এবং আহত হয়েছিলেন শতাধিক। বেঁচে যাওয়া অনেকেই পরবর্তীতে চিরতরে পঙ্গুত্বের অভিশাপ বরণ করে আর কখনোই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেননি।

পল জোসেফ গোয়েবল‌স ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত হিটলারের নাৎসি জার্মানিতে তথ্য ও প্রচার মন্ত্রণালয়ের প্রধান ছিলেন। তার অত্যন্ত বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য এবং ইহুদিবিরোধী অপতৎপরতার জন্য তিনি অত্যন্ত সুপরিচিত ছিলেন। জার্মানিতে ইহুদিদের বিরুদ্ধে যে ধারাবাহিক আক্রমণ ও হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছিল, তাতে তার প্রোপাগান্ডা, মিথ্যাচার ও মনগড়া বক্তব্য বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। সেই থেকে ‘গোয়েবলস’ নামটি বিশ্বে মিথ্যাচারের জোরালো প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

অনেকের হয়ত স্মরণ আছে জামায়াত-বিএনপি জোট সরকার আমলের কথা। সে সময়টিও হিটলারের ‘গোয়েবলস’ সময়ের মত মিথ্যাচারে পূর্ণ ছিল। ২১ অগাস্টের গ্রেনেড হামলার পর ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পক্ষ থেকে এমন কুরুচিপূর্ণ অবিশ্বাস্য কথা প্রচার করা হয়েছিল যে, আওয়ামী লীগ নাকি নিজেরাই জনগণের সহানুভূতি ও সমর্থন পেতে ওই গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল। তারা তখন বলেছিল যে, গ্রেনেড হামলা এমনভাবে করা হয়েছে যেন শেখ হাসিনা বেঁচে যান এবং জোট সরকারকে একটি বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়। অথচ তাদের সেই মিথ্যাচার জনগণ কখনোই বিশ্বাস তো করেইনি, উল্টো অমানবিকতার সর্বোচ্চ শৈলী দেখে সবাই তখন বিস্মিত ও স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।

২০০৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদেও জোট সরকারের সাংসদেরা, বিশেষ করে তদানিন্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া নিজে ২১ অগাস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেদিন তারা বলেছিলেন, জনগণের ভোটে ক্ষমতায় যেতে ব্যর্থ হয়ে নাকি নৈরাজ্যের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যেতে চেয়েছিল। সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই আওয়ামী লীগের সমাবেশে ২১ অগাস্টের গ্রেনেড হামলা ঘটানো হয়েছিল। সেদিন ওই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য আওয়ামী লীগ ছাড়াও প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রতিও অঙ্গুল তুলেছিল খালেদা-নিজামীর জোট সরকার। 

গ্রেনেড হামলায় সেদিন যদি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাসহ দলের মূল নেতৃত্ব নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত, তাহলে তা দেশের জন্য এক ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনত। ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠী হরকাতুল জিহাদের নেতা মুফতি হান্নান ও গ্রেপ্তার হওয়া অন্যান্য জঙ্গিদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী পরবর্তীতে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়েছিল যে, ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের হত্যা করা। তারা সফল হলে এ হত্যাকাণ্ড হতো ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্টে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যারই পরিবর্ধিত নীলনকশার ধারাবাহিকতা মাত্র!

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার হিটলারের প্রিয় সহচর ‘জোসেফ গোয়েবলস’ স্টাইলে সেদিন সবাইকে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করেছিল যে, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্রেনেড হামলার ঘটনা সাজানো হয়েছিল। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরিকল্পনানুযায়ী কলকাতায় পলাতক বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় সন্ত্রাসীদের ১৪ জনের একটি দল গঠন করা হয়েছিল, যারা ২১ অগাস্টের গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল। চারদলীয় জোট সরকার ও গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে ওই সব মিথ্যা তথ্য জোট সরকারের সমর্থক পত্রপত্রিকাগুলোও তখন ঢালাও প্রচার করেছিল। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সমর্থক, লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা সভা-সেমিনারে একই সুরে বক্তব্য দিয়ে, কলাম লিখে সেই মিথ্যাচার প্রচারে সহায়তা করেছিলেন। 

সিআইডি এবং পুলিশ যৌথভাবে ‘জজ মিয়া’ আখ্যান সাজানোর পরে দেশবাসী তখনই এর সত্যতা নিয়ে সন্দেহ করেছিল। বিষয়টি নিয়ে সুধীমহল ছাড়াও সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে কথা শুরু হলে এক অনুষ্ঠানে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবর বলেছিলেন, ‘আমরা সত্য প্রকাশ করে প্রমাণ করে দেব, কীভাবে সীমান্তের ওপার থেকে পরিকল্পনা হয়েছে, কীভাবে সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও তার সঙ্গীরা এই গ্রেনেড হামলা চালিয়েছে।’ চারদলীয় জোট সরকার আর তার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সে সত্য আর প্রকাশ করতে পারেনি! তত দিনে সবাই সত্যটা জেনে গিয়েছিল।

জোট সরকারের আমলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) তখনকার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ ধরনের অজস্র মিথ্যা তথ্য মিডিয়াতে ও সভা-সেমিনারে সরবরাহ করেছিলেন এবং প্রচার করেছিলেন। সে সময় প্রধান বিচারপতি জয়নুল আবেদীনকে দিয়ে এক সদস্যের একটা বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করেছিল চারদলীয় জোট সরকার। বিচারপতি জয়নুল আবেদীন প্রায় ৪০ দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে যে তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছিলেন, সেখানেও তিনি সব মনগড়া তথ্য-উপাত্ত দিয়েছিলেন, যা জোট সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা বলে বেড়াচ্ছিলেন। 

আর তদন্ত কমিশনের কাছে জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার সাবেক প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহীম যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, তাও ছিল সেই একই কথা, যা চারদলীয় নেতা-মন্ত্রীরা বলেছিলেন। ২১ অগাস্টের ঘটনার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াও দেশের দৈনিক সংবাদপত্রগুলোর সম্পাদক ও ব্যবসায়ী নেতাদের সাথে বৈঠক করে ঠিক একই কথা বলেছিলেন। কিন্তু ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলার সত্য যখন থেকে হওয়া শুরু করলো, তারপর থেকে বিএনপির নেতারা মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন এবং এ বিষয় নিয়ে তারা আর একটা টু-শব্দটিও করেননি।

তবে জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার তৎকালীন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা পরবর্তীতে তাদের ব্যর্থতার দায় পুলিশের উপরে চাপিয়ে বলার চেষ্টা করেছিলেন যে, ‘পুলিশ ও সিআইডি তাদের ভুল বুঝিয়েছিল। মনগড়া ও উদ্দেশ্যপূর্ণ তথ্য দিয়ে তাদের বিভ্রান্ত করেছিল পুলিশ। পরে যখন সত্য জানতে পারেন, তখন আর তাদের কিছু করার ছিল না’। তাদের এসব বক্তব্য অবশ্য জনগণের কাছে কখনোই গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেনি। বরং সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা ও সরকারের মন্ত্রী-নেতারা পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে ২১ অগাস্টের ঘটনার জন্য আওয়ামী লীগ ও ভারতকেই দায়ী করছিলেন এবং এ কথাই তারা বারংবার প্রচার করেছেন অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে। 

তৎকালীন জোট সরকারের উচ্চপর্যায়ের পরামর্শেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা, সিআইডি ও পুলিশের তখনকার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ২১ অগাস্টের গ্রেনেড হামলার তদন্তকে ‘গোয়েবলস’ স্টাইলে ভিন্নখাতে প্রবাহিতের চেষ্টা করেছিলেন। তারা পেশাদার খুনি চক্র, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব এবং ভারতের ওপর এই হামলার দায়ভার চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত থেকে প্রকৃত অপরাধীদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে মামলার আলামত নষ্ট করেছিলেন। ঠিক একইভাবে ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্টের পর বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সুরক্ষা দিতে জেনারেল জিয়াউর রহমান সমস্ত আলামত ধামাচাপা দিয়ে ইনডেমনিটি আইন জারি করেছিলেন এবং খুনিদের বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যেতে সহায়তা করেছিলেন।

তৎকালীন জোট সরকারের আহ্বানে বিদেশ থেকে আসা ইন্টারপোল ও এফবিআইয়ের বিশেষজ্ঞদের কাছেও ভুল তথ্য সরবরাহ করে বিভ্রান্ত সৃষ্টি করেছিলেন তারা। অবশ্য খুব অল্প সময়ের মধ্যে কারও বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকার’ মত বিদেশি বিশেষজ্ঞদের আনাটা ছিল মূলত লোক দেখানোরই একটি উচ্চ মার্গীয় অপকৌশল মাত্র! বিভিন্ন সূত্রে তখন শোনা গিয়েছিল যে, জোট সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরকে (ডিজিএফআই) ২১ অগাস্টের গ্রেনেড হামলা সম্পর্কে কোনো ধরনের তদন্ত করতে নিষেধ করেছিলেন। 

খালেদা জিয়া তার পছন্দের সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের দিয়ে ২১ অগাস্টের হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্যমূলক তদন্ত করার আদেশ দিয়েছিলেন। সে তদন্ত প্রতিবেদন আর কোনো দিন আলোর মুখ দেখেনি এবং তার আলামতও পরবর্তীতে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এসব নানাবিধ ক্রিয়াকর্মের পটভূমিতে একটা বিষয় অত্যন্ত পরিষ্কার হয় যে, ২১ অগাস্ট হামলার সঙ্গে জোট সরকার উচ্চপর্যায়ের সুপরিকল্পিত যোগসাজশ ছিল এবং তাতে ইন্ধন ও রসদ জোগাতে অন্তরালে তৎপর ছিল একাত্তরের পরাজিত দেশের গোয়েন্দা সংস্থা ‘আইএসআই’।

২১ অগাস্টের গ্রেনেড হামলার পর তৎকালীন ঢাকাস্থ পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, ‘এটা আওয়ামী লীগেরই কাজ। এ ঘটনায় তারাই (আওয়ামী লীগ) তো লাভবান হয়েছে এবং সহানুভূতি পেয়েছে।’ শেখ হাসিনার জ্ঞাতসারেই নাকি ২১ অগাস্টের ঘটনা ঘটেছিল বলেও পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত তখন ঘরোয়া এক অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেছিলেন। ঘটনার পর যে কথা সংসদে দাঁড়িয়ে খালেদা এবং নিজামী বলেছিলেন, যে কথা জোট সরকারের প্রতিটা মন্ত্রী-এমপিরা বলেছিলেন এবং সেই একই কথা কথা যখন পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতও বলেন, তখন বুঝতে কারো অসুবিধা হয় না যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা, ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সহ আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতৃত্বের উপর গ্রেনেড হামলা, ২০০৫ সালের ১৭ অগাস্ট সারাদেশে একযোগে বোমা হামলা ছাড়াও অদ্যাবধি বাংলাদেশে যত জঙ্গি ও মৌলবাদী হামলাগুলো হয়েছে, তা একই সূত্রে গাঁথা।

রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জঙ্গি ও মৌলবাদের ক্ষেত্র পরিচালিত হলে তা প্রতিরোধ করা যায় না। তারা হয়ে ওঠে আরো অপ্রতিরোধ্য, হিংস্র। তার প্রমাণ আমরা দেখেছি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরেও বাংলার মাটিতে একের পর এক জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের হামলা হতে। জঙ্গি ও মৌলবাদের ক্ষেত্র রচিত হয়েছিল জামায়াত-বিএনপির জোট সরকারের আমলে। ২১ অগাস্টের মতো ভয়ংকর ঘটনায় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ন্যাক্কারজনক ভূমিকা পরবর্তীতে দেশের মানুষ কিভাবে নিয়েছে, তাও আমরা দেখেছি। বিএনপি-জামায়াতের এই কলঙ্কিত অধ্যায়ের পুনরাবৃত্তি বাংলাদেশ আর কখনোই দেখতে চায় না।

জননেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির জনকের হত্যাকারীদের বিচার করেছেন এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও বৃহদাংশে সম্পন্ন করেছেন। জাতি দেখতে চায়, ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলায় যে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছিল, তার প্রত্যক্ষ ও পর্দার আড়ালের কুশীলবদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমে দেশকে কলঙ্কমুক্ত করা হয়েছে। একাত্তরে পাকিস্তান ধর্মের নামে এদেশের মানুষকে হত্যা ও নির্যাতন করেছিল। 

যে কারণে দেশ স্বাধীনের পর জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার আলোকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাহাত্তরের সংবিধান রচনা করেছিলেন এবং ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন, যাতে ধর্মের নামে বাঙালিদের আর শোষণ, নির্যাতন করা না যায়। ১৯৭৫ এর ১৫ অগাস্টের পর জেনারেল জিয়া এবং জেনারেল এরশাদ সে সংবিধান পরিবর্তন করে তা আবার পাকিস্তানের আদলে ধর্মীয় অনুশাসনের দিকে নিয়ে যায়। ফলে এর ধারাবাহিকতায় বাংলার মাটিতে আবার জন্ম নেয় ধর্মীয় উগ্রবাদ, মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদ। ভবিষ্যত প্রজন্মকে যেন আর কখনো ‘২১ অগাস্ট’ ধরনের ঘটনার সাক্ষী হতে না হয়, সেজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাহাত্তরের আদি-সংবিধানে ফিরে যাওয়ার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলেই আমি বিশ্বাস করি।

লেখকঃ বিশ্লেষক, লেখক ও সাংবাদিক

এমবি//


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি