ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ১৩ নভেম্বর ২০২৫

ডিসএবিলিটি মানেই ডিজেবল নয়, অক্ষমতা জয় করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৮:৪৫, ১৩ নভেম্বর ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

বাংলাদেশে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ স্ট্রোক, আঘাতজনিত অক্ষমতা, দুর্ঘটনা ও বার্ধক্যজনিত নানা সীমাবদ্ধতায় ভোগেন। এসব মানুষদের অনেকের জন্যই ওষুধ বা অস্ত্রোপচার যথেষ্ট নয়—তাদের প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি ফিজিক্যাল মেডিসিন ও রিহ্যাবিলিটেশন (পিএমএন্ডআর) চিকিৎসা। এই শাখার চিকিৎসকরা শুধু চিকিৎসা দেন না, বরং মানুষকে নতুনভাবে বাঁচতে শেখান—তাদের হাতে আসে নতুন শক্তি, নতুন দক্ষতা ও নতুন জীবনের আশা।

জাতীয় ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন দিবস উপলক্ষে বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) সকালে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএমইউ) এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল “সমন্বিত পুনর্বাসনে চাই সম্মিলিত প্রচেষ্টা”।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ সোসাইটি অব ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশনের (বিএসপিএমআর) সভাপতি অধ্যাপক ডা. মো. তসলিম উদ্দিন। উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল, বিএমইউর প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ, অধ্যাপক ডা. মো. মুজিবুর রহমান হাওলাদার, অধ্যাপক ডা. এম এ শাকুরসহ অনেকে।

বক্তারা বলেন, দেশে স্ট্রোক, আর্থ্রাইটিস, দুর্ঘটনা ও স্পাইনাল ইনজুরির মতো জটিল রোগ দ্রুত বাড়ছে। এসব রোগীর জন্য ওষুধ বা সার্জারি যথেষ্ট নয়। বরং ফিজিক্যাল মেডিসিন ও রিহ্যাবিলিটেশনের মাধ্যমে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

তাদের মতে, পিএমএন্ডআর এমন একটি চিকিৎসা পদ্ধতি যা শারীরিক প্রতিবন্ধকতা, ব্যথা, পেশী ও স্নায়ুজনিত সমস্যায় আক্রান্ত রোগীদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে জীবনে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করে। এটি “জীবন পুনরুদ্ধারের চিকিৎসা”—যা শুধুই চিকিৎসা নয়, বরং মানবিক পুনর্জাগরণের প্রক্রিয়া।

বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকস (বিবিএস) সূত্রে অনুষ্ঠানে জানানো হয়, দেশে বর্তমানে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪৩ লাখ ৩০ হাজার ৭১০ জন, যা প্রতি হাজারে ২৫.৫ জন।
তবে বাস্তবে এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের। কারণ গ্রামীণ অঞ্চলে যথাযথ তথ্য সংগ্রহের অভাব রয়েছে।

বক্তারা বলেন, প্রতিবন্ধীদের সেবা ও পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে—জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে পর্যাপ্ত সেবা কাঠামোর অভাব, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত থেরাপিস্টের ঘাটতি, সহায়ক প্রযুক্তির স্বল্পতা, সামাজিক সচেতনতার অভাব এবং তথ্যসংগ্রহে সীমাবদ্ধতা।

বাংলাদেশের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বার্ধক্যজনিত রোগ ও অক্ষমতাও বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্যমতে, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯.৮% মানুষ এখন ষাটোর্ধ্ব—২০৫০ সালের মধ্যে এ সংখ্যা তিনগুণ হতে পারে। ফলে বয়স্কদের চলাচলজনিত অক্ষমতা, শ্রবণ ও দৃষ্টির সমস্যা, হাড়-পেশি দুর্বলতা ইত্যাদি ভবিষ্যতে বড় স্বাস্থ্যঝুঁকি হয়ে উঠবে।

বিএসপিএমআরের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ডা. এম এ শাকুর জানান, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের প্রথম রোবোটিক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার চালু হয়েছে। এটি পুনর্বাসন চিকিৎসায় প্রযুক্তির এক নতুন অধ্যায় উন্মোচন করেছে।

তিনি বলেন, “রোবোটিক থেরাপির মাধ্যমে রোগীরা আগের চেয়ে দ্রুত ও কার্যকরভাবে সুস্থ হয়ে উঠছেন। এটি চিকিৎসা বিজ্ঞানে বাংলাদেশের এক বড় পদক্ষেপ।”

তিনি আরও বলেন, “আমাদের লক্ষ্য শুধু চিকিৎসা নয়—রোগীদের জীবনে নতুন আলো ফেরানো। এজন্য সরকার, প্রতিষ্ঠান ও জনগণের সম্মিলিত উদ্যোগ দরকার।”

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বিসিবি সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল বলেন, “আমরা ক্রিকেট খেলি, কিন্তু চিকিৎসকেরা আসলে আমাদের জীবনের খেলোয়াড়। তারা প্রতিদিন হাজারো মানুষের জীবন ফেরান—যা কোনো পরিসংখ্যানে আসে না।”

তিনি বলেন, “আধুনিক ক্রিকেটে চারটি বিষয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—টেকনিক্যাল, ট্যাকটিক্যাল, ফিজিক্যাল ও মেন্টাল। আন্তর্জাতিক মানে উন্নতি করতে হলে ফিজিক্যাল ও মেন্টাল ফিটনেস অপরিহার্য, আর এই জায়গায় ফিজিক্যাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞদের ভূমিকা বিশাল।”

সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক ডা. মো. তসলিম উদ্দিন বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, ‘ডিজএবিলিটি’ মানে ‘ডিজএবল’ নয়—এটি আসলে ‘ডিফারেন্ট এবিলিটি’। রোগীদের সীমাবদ্ধতার সঙ্গে যদি কিছু সক্ষমতা যোগ করা যায়, তবে অক্ষমতাও অনেকটা কমে যায়। ফিজিক্যাল মেডিসিন সেই সক্ষমতা তৈরি করে মানুষকে নতুন আশার আলো দেয়।”

তিনি আরও বলেন, “সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী ও মানবিক পুনর্বাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। এজন্য সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব বাড়াতে হবে, এবং প্রতিটি মেডিকেল কলেজে আধুনিক ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগ চালু করা জরুরি।”

অনুষ্ঠানে বক্তারা আরও বলেন, বিদ্যমান আইন কার্যকর করা ও নতুন নীতিমালা বাস্তবায়নের উদ্যোগ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি দেশের প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে রিহ্যাবিলিটেশন ইউনিট স্থাপন, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনবল নিয়োগ ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেন তারা।
স্কুল, কলেজ, অফিস, কর্মক্ষেত্র, সড়ক ও পরিবহন ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধিবান্ধব “ইউনিভার্সাল ডিজাইন” নিশ্চিত করার আহ্বানও জানান তারা।

দিনটি উপলক্ষে সকালে বিএমইউ ক্যাম্পাসের বটতলায় একটি বর্ণাঢ্য র‍্যালির আয়োজন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. মো. মুজিবুর রহমান হাওলাদার র‍্যালির উদ্বোধন করেন। র‍্যালি শেষে শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান, যেখানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও এনজিও প্রতিনিধিরা অংশ নেন।

বাংলাদেশে প্রতিবছর লাখো মানুষ প্রতিবন্ধিতা বা অক্ষমতার মুখোমুখি হলেও, ফিজিক্যাল মেডিসিন ও রিহ্যাবিলিটেশন চিকিৎসার মাধ্যমে অনেকেই নতুন জীবন ফিরে পাচ্ছেন। প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক পুনর্বাসন সেবা এবং সরকারের সক্রিয় ভূমিকা ভবিষ্যতে এই খাতকে আরও এগিয়ে নিতে পারে।

মানুষকে কর্মক্ষম ও আত্মনির্ভর করে তোলা—এটাই ফিজিক্যাল মেডিসিনের মূল লক্ষ্য। তাই বলা যায়, এটি কেবল চিকিৎসা নয়, বরং মানবতার এক নবজাগরণ।


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি