ঢাকা, রবিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

দেশে মোট বিক্রিত ওষুধের অর্ধেকই গ্যাসের

প্রকাশিত : ১৭:২৬, ৯ জুন ২০১৮ | আপডেট: ১০:১৫, ১০ জুন ২০১৮

Ekushey Television Ltd.

নগর সভ্যতা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবন যাত্রার মানেরও পরিবর্তন হচ্ছে। দিনে দিনে মানুষ যান্ত্রিক হয়ে উঠছে। ঘুম ও খাওয়া থেকে শুরু করে সবক্ষেত্রে আসছে পরিবর্তন। অনিয়মতান্ত্রিক জীবন-যাপনের কারণে বাড়ছে গ্যাস্ট্রিনমিক্যাল ওষুধের উপর নির্ভরতা।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে বর্তমানে ওষুধ শিল্পের বর্তমান বাজার প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকার। এ বাজারের অর্ধেকই ধরে রাখছে গ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ওষুধে। যদিও বাস্তব পরিসংখ্যান এর অনেক বেশি। খাওয়ার আগে বা পরে গলায় কিংবা পেটে জ্বলুনি, খেয়ে নেওয়া যাক একটি ‘গ্যাসের ওষুধ’; এই চিত্র এখন প্রতি ঘরে ঘরে। এছাড়া দেশে সর্বাধিক বিক্রীত ১০টি ওষুধের মধ্যে ছয়টিই গ্যাস্ট্রো-ইসোফ্যাজিল রিফ্লাক্স ডিজিজ (জিইআরডি) ক্যাটাগরির।

স্বাস্থ্যসেবা খাত নিয়ে কাজ করে এমন আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইএমএস হেলথ ও  লংকাবাংলা রিসার্চের তথ্য বলছে, দেশে ওষুধ শিল্পের বর্তমান বাজার প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকার। এ বাজারের অর্ধেকই গ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ও অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের। ২০১৭ সালে দেশের বাজারে সর্বাধিক বিক্রিত ওষুধের ১০টি ব্র্যান্ড হলো—সেকলো, সার্জেল, ম্যাক্সপ্রো, প্যানটোনিক্স, সেফ-৩, মিক্সটার্ড ৩০,লোসেকটিল, নাপা এক্সট্রা, নাপা ও ফিনিক্স। এর মধ্যে শুধু গ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ওষুধই রয়েছে ছয়টি। আর ওষুধ শিল্পের গড় প্রবৃদ্ধি ১৯ শতাংশ হলেও গ্যাস্ট্রোনমিক্যালের প্রবৃদ্ধি ২১ দশমিক ৯৫ শতাংশ। সর্বাধিক বিক্রিত ১০ ওষুধের তালিকায় অ্যান্টি-পাইরেটিক বা প্যারাসিটামল গ্রুপের জ্বরের ওষুধ দুটি, একটি অ্যান্টিবায়োটিক ও অন্যটি ইনসুলিন।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, সময়মতো খাবার না খাওয়া, ভেজাল খাবার, ফাস্টফুড, অতিরিক্ত মসলাযুক্ত খাবার খাওয়া, ধূমপান ও মদ্যপানের কারণে মানুষের মধ্যে অ্যাসিডিটি সমস্যা বাড়ছে। অন্যদিকে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই এ ওষুধ সেবনের সুযোগ থাকায় মানুষের মধ্যে তা গ্রহণের পরিমাণ বেড়েছে। ফলে গ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ওষুধ কেনার প্রবণতাও বাড়ছে।

এবিষয় জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষের অ্যাসিডিটির সমস্যায় ভুগছেন। বিভিন্ন কারণে অ্যাসিডিটি সমস্যা দেখা দিতে পারে। টেনশন, বাহিরের ভেজাল খাবার গ্রহণ। ধুপমান করা, পানের সঙ্গে জর্দা গ্রহণ, এছাড়া জীবন যাত্রার মান পরিবর্তনের কারণে  অ্যাসিডিটি সমস্যা দেখা দিতে পারে। অনেক সময় মানুষ রাস্তার খোলা খাবার গ্রহণ করে থাক। এ কারণেও পেটে সমস্যা দেখা দিতে পারে।

গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ দীর্ঘমেয়াদে গ্রহণ করলে জটিল কোনো সমস্যা তৈরি হবে কি না জানতে চাইলে অধ্যাপক আবদুল্লাহ বলেন, এক সময় ওষুধ না থাকার কারণে গ্যাস্ট্রিকের কারণে মানুষে মারা যেতো। ওষুধ খাওয়ার কারণে ক্ষতি হবে এমন ধরণা ঠিক না। তবে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে খাওয়া উচিত।

গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা দেখা দিলে অবশ্যই ওষুধ গ্রহণ করতে হবে। তবে ধারাবাহিক ওষুধ না খেয়ে অবশ্যই আমার দুই মাস পর পর কিছু দিন বন্ধ রেখে আবার শুরু করতে হবে। অতিরিক্ত তেল মশলা খাবার বাদ দিয়ে খেতে হবে পুষ্টিকর খাবার। সময়ের খাবার সময়েই খেতে হবে। আর যারা ধূমপান করেন তাদের পরিত্যাগ করতে হবে এ অভ্যাস।

এ বিষয়ে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. স্বপন চন্দ্র ধর  বলেন, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম থাকায় মানুষ প্রেসক্রিপশন ছাড়াই ওষুধ কিনতে পারে বলে এ ওষুধ কেনার হার বেশি।

গবেষণার তথ্য অনুসারে, গত বছর সর্বাধিক বিক্রিত ওষুধের তালিকায় শীর্ষে ছিল স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ওষুধ সেকলো। ওষুধটি বিক্রি হয়েছে ৩৭৬ কোটি ৬৫ লাখ ৬০ হাজার টাকার। বিক্রয় প্রবৃদ্ধি ১৮ দশমিক ২ শতাংশ। স্কয়ারের ৮০৪ ধরনের ট্যাবলেট, ক্যাপসুল, লিকুইড ও ইনজেক্টেবল ওষুধের মধ্যে সর্বোচ্চ উৎপাদন ও বিক্রি সেকলোরই। দেশের বাজারে গত বছর কোম্পানির মোট বিক্রি ছিল ৩ হাজার ৩২৯ কোটি টাকা।

তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের সার্জেলের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫৪ দশমিক ১ শতাংশ। ২০১৭ সালে বাজারে ওষুধটির বিক্রি ছিল ২৯৪ কোটি ৮৪ লাখ টাকার। তৃতীয় স্থানে থাকা রেনাটা ফার্মার ম্যাক্সপ্রোর বিক্রি ২২৮ কোটি ৩৯ লাখ টাকার। ভ্যাকসিন উৎপাদনে বিখ্যাত হলেও গ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ওষুধ প্যানটোনিক্সের বাজারের বড় অংশ দখলে নিয়েছে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস। ২০১৭ সালে ২০ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে শীর্ষ তালিকার চতুর্থ স্থানে কোম্পানিটি থাকা ২১৫ কোটি ৬২ লাখ টাকার প্যানটোনিক্স বিক্রি করেছে।

ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল মোক্তাদির বলেন, আর্থিক সচ্ছলতা বৃদ্ধির সঙ্গে মানুষের খাদ্যাভ্যাসেও পরিবর্তন এসেছে। মানুষ সাধারণ খাবার বাদ দিয়ে স্পাইসি খাবারে ঝুঁকছে। এসবের কারণে অ্যাসিডিটি সমস্যা তৈরি হচ্ছে। দেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পাওয়াও গ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ওষুধ বিক্রি বাড়ার কারণ। তবে ভবিষ্যতে এসব ওষুধের পরিবর্তে ডায়াবেটিস ও হার্ট ডিজিজের ওষুধ বিক্রি বাড়বে বলেও মনে করেন তিনি।

শীর্ষ তালিকার সপ্তম স্থানে রয়েছে এসকেএফ ফার্মার লোসেকটিল। ২০১৭ সালে গ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ওষুধটি বিক্রি হয়েছে ২২২ কোটি ১৬ লাখ টাকার। আর দশম স্থানে থাকা অপসোনিন ফার্মার ফিনিক্সের বিক্রি হয়েছে ১০০ কোটি ১৪ লাখ টাকা। গত বছর ওষুধটিতে ৩১ দশমিক ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পেয়েছে অপসোনিন।

অন্যদিকে ওষুধের মূল উপাদান মলিকিউলসের বাজারেও শীর্ষ অবস্থান গ্যাস্ট্রোনমিক্যালের। এক্ষেত্রে ইসমিপ্রাজলের মার্কেট শেয়ার ৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ। তৃতীয় স্থানে থাকা ওমিপ্রাজলের মার্কেট শেয়ার ৪ দশমিক ১৬ শতাংশ।

মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এমএ আজহার বলেন, গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, ২০১৭ সাল শেষে দেশে ২৬৯টি প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন থাকলেও উৎপাদনে রয়েছে ২১৬টি কোম্পানি। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ ওষুধ জেনেরিক। দেশে উৎপাদিত ওষুধের ২৬ হাজার ৬৬১ ব্র্যান্ডের মধ্যে ১ হাজার ৪৪৪টি জেনেরিক। আর প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ মার্কেট শেয়ার নিয়ে সবার উপরে রয়েছে স্কয়ার। দ্বিতীয় স্থানে ইনসেপ্টা, তৃতীয় স্থানে বেক্সিমকো। এরপর রয়েছে যথাক্রমে অপসোনিন, রেনাটা, হেলথকেয়ার, এসিআই, অ্যারিস্টোফার্মা, এসকেএফ ও একমি ল্যাবরেটরিজ।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় বাংলাদেশে এ রোগের প্রকোপ বেশি জানিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতালের গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রায়হান আহমেদ একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, এটা আসলে অনেক জটিল এটা ব্যাপার। আমাদের জীবন যাত্রার মান পরিবর্তন ও  অনিয়মিত খাবার গ্রহণ করার কারণে গ্যাস্ট্রিকজড়িত সমস্যা বেশি দেখা দেয়। এছাড়া ভেজাল খাবার, খাদ্যে রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, ধূমপান, মদ্যপানের কারণে এ রোগের প্রকোপ আরো বাড়ছে। ফলে দিন দিন এ ওষুধের চাহিদা বাড়ছে। অধিকাংশ মানুষকে নিয়মিত এ ওষুধ খেতে হয়। ফলে মানুষের ওষুধের ব্যয়ের একটা নির্দিষ্ট অংশ যাচ্ছে গ্যাসের ওষুধের পেছনে।

 

টিআর/ এআর


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি